জালাল উদ্দিন আহমেদ
২
সিকস্তি না পয়স্তি
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ১২ ফেব্রুয়ারী,শনিবার,২০২২ | আপডেট: ০৬:৩৮ এএম, ১৯ ডিসেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
সিকস্তি ও পয়স্তি শব্দ দুটির চয়ন সাধারনতঃ নদী ভাঙ্গন ও ভরাটের ক্ষেত্রেই আমরা প্রয়োগ করে থাকি। কিন্তু আমার এই ক্ষুদ্র পাঠশালায় সিকস্তি-পয়স্তির ব্যাপারটি সর্বক্ষেত্রেই প্রযোজ্য বলে আমি মনে করি। আজকের দিনে সমাজ সংসার রাষ্ট্র রাজনীতি এবং জীবন বোধের সর্বক্ষেত্রেই এই শব্দ যুগলের সরল সমীকরনে আমাদের নিত্য পথচলা। ব্যক্তি জীবন বলুন বা সমাজ জীবন, কর্ম জীবন, রাষ্ট্র জীবন এমন কি রাজনৈতিক জীবনাচারেও এই দুই বিপরীত মেরুর শব্দ যুগলের পালা বদল পালাক্রমেই ঘটে থাকে।
রাষ্ট্র ব্যবস্থার দিকে তাকালে এই শব্দ যুগলের পালা ক্রমিক ব্যবহারের যৈক্তিকতা খুঁজে পাওয়া যায়। ক্ষমতার সংযুক্তি ও বিযুক্তির ফলাফলে এক্ষেত্রে রাজনীতির সিকস্তি ও পয়স্তির ছবিটিও স্বচ্ছতায় ধরা পড়ে। কেননা রাজনৈতিক অনুশীলনের ধারবাহিক গতিপথেই আমাদের মত তৃতীয় বিশ্বে ক্ষমতায়নের পালা বদল হয়। রাজনীতির পথ চলায় সেই গনতন্ত্র যখন ক্ষমতা লাভের মোক্ষ হিসাবে রাজনৈতিক আচরনের প্রধানতম ও একমাত্র কার্যধারা হয় তখন ক্ষমতা আরোহনকারী পক্ষ প্রবল প্রতাপে তাদের ক্ষমতার শেকড়কে পোক্ত করার কাজেই ব্যস্ত হয়ে পড়ে। সেক্ষেত্রে রাষ্ট্র ও জনপদ তখন ক্ষমতা প্রাপ্তদের কাছে গৌন হয়ে যায়। আমাদের মত তৃতীয় বিশ্বের গনতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় এভাবেই রাজনীতির সিকস্তি ও পয়স্তির ঘটনাগুলি অহরহ ঘটে চলে। অন্য কোন দিকে তাকানোর দরকার নেই। দক্ষিন এশিয়ার সাত আটটি দেশের রাষ্ট্র ব্যবস্থা ও রাজনৈতিক আচরনের দিকে তাকালেই এই সিকস্তি-পয়স্তির চেহারাটি খোলা চোখেই দেখা যায়। অবশ্য এক্ষেত্রে আফগানস্থানের বিষয়টি ভিন্ন আঙ্গিকে বিবেচ্য। অবশিষ্ট সাতটি দেশের গনতন্ত্রের পথচলার রাষ্ট্র ব্যবস্থায় ভুটান নেপাল এমনকি মালদ্বীপকে নব্য বা নবিশ গনতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও রাজনীতির পথচলার জনপদ বললে ভুল বলা হবে না। একমাত্র ভারত ও শ্রীলঙ্কা ছাড়া গনতান্ত্রিক চর্চায় পরিচালিত দেশ বাংলাদেশের রাজনীতি ও রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সুখকর কিছু পাওয়া যায় কি? আর পাকিস্থান! সেটাও যে ইদানীংকার সামন্ত তান্ত্রিক গনতন্ত্রের চারনভূমি, তাতে অত্যুক্তি হবে কি? সুতরাং এইসব তথাকথিত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় ক্ষমতায় ভর করা রাজনৈতিক আচরনের সরকার যখন রাজ কায়েমের সরকার হয়ে বিচরনের দন্ডটি হাতে নিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনায় অভিষিক্ত হয় তখন সেখানে ক্ষমতা পক্ষীয় প্লাটফরমটি পয়স্তির রসাস্বাদনে নিজেদেরকে ইচ্ছেমত স্ফীত করার মচ্ছবে বেপরোয়া হয়ে পড়ে। ফলে রাষ্ট্রাচারে শুরু হয় এক অলিখিত শ্বৈরাচারী আচার আচরনের বেপরোয়া এবং লাগামহীন কর্মযজ্ঞ। সেক্ষেত্রে বিরোধী পক্ষীয়রা সেই সময়টায় সিকস্তির চরমতম অবস্থানে নিজেদের অস্তিত্বের সলতেই টিমটিম করতে থাকে। আর এর পাশাপাশি ইদানীংকালে সুবিধার রসাস্বাদনে প্রশাসন আইন ও শৃংখলাসহ রাষ্ট্র যন্ত্রের সর্বক্ষেত্রেই পক্ষ বিপক্ষের জোয়ার ভাটা শুরু হয়ে যায়। এই কিছুকাল আগেও প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রীয় মেকানিজমে পক্ষ বিপক্ষের এই বিষয়টি অতি সঙ্গোপনে সংঘটিত হলেও এখনকার দিনে প্রবল পরাক্রমশালী গনতান্ত্রিক আচরনের স্বতঃসিদ্ধতায় তা প্রকাশ্য হয়েছে। ফলে রাষ্ট্র ব্যবস্থার অবিচ্ছেদ্য এই উঠানেও সিকস্তি ও পয়স্তির দৃশ্যমানতা আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়ে।
সামাজিক জীবনেও এই ঘুর্ণিচক্র পারদের মতই উঠানামা করে। যাটের দশকের পরবর্তী সময়ে গ্রাম্য মোড়ল মাত্ববরীয় চাল চলনের মুখে ঝামা ঘষে যখন সমাজতন্ত্রীয় ধারনাটি সাধারনে দ্যুতি ছড়াতে শুরু করে, তখন মধ্য ও নিম্ন মধ্যবিত্তীয় বলয়ে মাথা তুলে দাঁড়ানোর প্রবনতা দৃশ্যমান হয়। ফলে পরবর্তী প্রায় দুই তিন যুগ ধরে আমাদের এই ভারতীয় উপ মহাদেশে নিম্ন ও মধ্যবিত্তের সামাজিক পয়স্তির ব্যপকতা দৃশ্যমান হয়। কিন্তু হাজার বছরের শেকল পরা দক্ষিন এশীয় অঞ্চলের মনুষ্য প্রবৃত্তি আবারও শাসক হওয়ার খায়েসে রাজনীতি এবং পুরনো মদ নতুন বোতলে ঢেলে খাওয়ার সেই চিত্রে গনতন্ত্রকে হাতিয়ার বানানোর মচ্ছ্ববে নিজেদেরকে উপস্থাপন করার সুযোগ করে নেয়। রাজনীতির পরাক্রমশালী নেতা পাতিনেতা সেজে যতসব ভয়ঙ্কর দুর্বৃত্ত ও সন্ত্রাসীরা সমাজপতির ভূমিকায় আজ তারাই দেশের মহান নেতা নেত্রীদের নামে বিকিকিনি করে বিদ্যমান হয়েছেন। ফলে বংশ পরম্পরার আবহে সৃষ্ট সমাজ বিন্যাসের সুষ্ঠতা আজকের একবিংশের বটতলায় খুঁজে পাওয়া বড়ই মুস্কিল। তাইতো দেখি সিকস্তির পরিমন্ডলে বিচরন করা-
“সেদিনের সবজি বাজারের
টোল তুলা সল্যা
আজ সলিম সাহেব।
চারতলা বাড়ী গ্যারেজে গাড়ী
ঢাকা রংপুর রূটে আধা ডজন বাস।
আরো আছে, এই আছের মধ্যেই
ওরা ছেয়ে আছে আমাদের মাঝে।“
এরকম আরো বহু সামাজিক ওলট পালট আজ সিকস্তি পয়স্তির চরমতম দৃশ্যমানতায় সমাজে স্থায়িত্ব পাচ্ছে।
সুতরাং নদী ভাঙ্গনের সিকস্তি যেমন নদী অববাহিকার বিস্তীর্ণ এলাকা এমনকি জনপদকে বিনাশ করে তার গতির পথকে সুগম করে, তেমনি পানির প্রবাহ স্বল্পতা ও পলি প্রাচুর্যে বিস্তীর্ন এলাকা জুড়ে চর সৃষ্টি ক'রে জনপদ পত্তনে পয়স্তির সুযোগ তৈরী করে। আজকের দিনে নদী মার্তৃক এই বাংলাদেশের সর্বক্ষেত্রে নদীর সিকস্তি-পয়স্তির আদলে এই উঠা-নামার বা ক্ষয়ে যাওয়া কিংবা স্ফীত হওয়ার দৃশ্যটি দেখা যায়। সেদিনের মোড়ল মাত্ববরীয় বংশ পরম্পরা যেমন আজকের সিকস্তির উঠানে নুইয়ে পড়েছে তেমনি শাসিত শ্রেনীর একটি উচ্চাভিলাষী পক্ষ, গোষ্ঠিতন্ত্র বা দেশের মহান রাজনীতিকের পারিবারিক বলয় সৃষ্টিকারীদের রাজনীতির শিখন্ডি হয়ে পয়স্তির জোয়ারে সমাজে ছড়ি ঘোরানোর প্রশস্ত পথ পেয়েছে। সেক্ষেত্রে নদীর দুর্বার গতিপথে যেমন সিকস্তি পয়স্তির নিত্য ঘটনাগুলি ঘটেই চলে, মানবিক সামাজিক রাজনৈতিক কিংবা রাষ্ট্রীয় জীবনেও সে রকম চড়াই উৎরাইয়ের ঘটনাগুলি চক্রাকারে ঘটতে দেখা যায়। এবং আমাদের মত তৃতীয় বিশ্বের রাজনীতি ও রাষ্ট্রনীতির দুর্বিনীত কৃষ্টি কালচারে সেটা নদী ভাঙ্গনের সিকস্তি পয়স্তির আদলেই দৃশ্যমান হয় বলে পালা বদলের সেই নির্ঘন্টগুলিকে ওভাবেই বর্ননা করার অবকাশে আমাদের একটুও বেগ পেতে হয় না।
……….......…... (শেষ)...…….…….....