জালাল উদ্দিন আহমেদ
সিকস্তি না পয়স্তি
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ১০ ফেব্রুয়ারী,বৃহস্পতিবার,২০২২ | আপডেট: ০৬:৩৮ এএম, ১৯ ডিসেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
আমার মত অল্প বিদ্যার লোকজনকে নিয়ে বড় বিপদ এই সমাজ সংসারে। কি হয় আর কি যে ভাবি। জীবনবোধ থেকে শুরু করে রাজনীতি ও রাষ্ট্রাচারের সবখানেই যেন এলোমেলো কি সব ভবিতব্যের আশংকায় ভুগি। এটাকে কি বলে জানি না। তবে কেউ কেউ এটাকে ঘোড়া রোগও বলে থাকেন। অবশ্য প্রথিতযশা যারা তাদের ভাষার মাধুর্য দিয়ে যখন এসব বিষয়গুলি নিয়ে লেখনীর এন্তেজামে পাঠকের হৃদয়গ্রাহ্য করে তোলেন, তখন এসব লেখাজোখা নিয়ে উচ্চ মার্গের আলোচনা হয়, প্রতিলিখন হয়, সংশ্লিষ্ট মহলে টনকও নড়ে। আর আমরা সাধারন লেখালেখির নবিশরা, যখনই এসব ব্যাপারে মাথা ঘামায় বা দু'কলম লেখার চেষ্টা করি তখন তা নিয়ে হই চই পড়ে যায়। তবে সেটা হয় অন্য আঙ্গিকে। সমালোচনার আঙ্গিকে না ফেলে তখন সেটাকে নিয়ে ব্যাঙ্গাত্মক বা বিদ্রুপাত্মক রাশভারি কথকতায় পর্যবসিত করা হয়। সেক্ষেত্রে আমি যদি উঠতি বয়সী লেখক হয়ে এ জগতের কোন এক কেউটের ভাগ্নে বা ভাতিজা হই এবং সদ্য বিশ্ববিদ্যালয় সমাপনীর দ্বার প্রান্তে থাকা এক টগবগে যুবক হই তখন সেই কেউটে বা তার আশে পাশের বহমানেরা সেই লেখনীর পঞ্চমুখে সরব হন। প্রশংসার তুবড়িতে অবগাহন করতে করতে আমাকে মগডাল খুঁজে নিতে তখন আর বেশী সময় ব্যয় করতে হয় না। সেক্ষেত্রে যারা অখ্যাত অজ হয়ে এই জমিনে পা ফেলতে চান তারা সেই তিমিরেই রয়ে যান। হা-পিতেশ তো আছেই। তবুও নিজের মত করে বেঁচে থাকা এই আমাদের মত অযত্নের লেখনী শক্তির পাওয়ার হাউজগুলো কোথাও না কোথাও একটা আত্মতৃপ্তি নিয়ে বিচরন করার স্ফুরন খুঁজে পায়।
সাহিত্য উৎসব বলুন আর কবিতা উৎসব,ল সবখানেই যেন “এ” এবং “বি” এর দৌরাত্ম্য। এসবের প্রকটতা সম্ভবতঃ গত শতাব্দীর নব্বইয়ের গন অভ্যুত্থানের পরেই বেশী করে লক্ষ্য কারা গেছে। এখন তো তা ইনস্টিটিউশনে পরিনত হয়ে গেছে। যেটা বলতে চেয়েছিলাম, তা শুনতে কানে বাজলেও সত্যটা উচ্চারনে অসুবিধা কোথায়! আমি একজন সৌখিন কবি। কোন পেশাদারিত্ব নেই, কোন ধারা নেই আমার কাব্য চর্চায়। যেটা মনে আসে সেটাই লিখে ফেলি। কবিতা হয় কিনা জানি না। তবে বিষযবস্তু যে থাকে তাতে সন্দেহের কন অবকাশ নেই। প্রতি বছরই ঘটা করে এদেশে জাতীয় কবিতা উৎসবের আয়োজন করা হয়। বেশ আগ্রহ নিয়েই সেখানে যাওয়ার তাগিদটা থাকে। মনে পড়ে কোন এক বছরের এমনি এক কবিতা উৎসবে একটু অতি উৎসাহী হয়ে কবি শিরোমনিদের পিছু পিছু হাঁটতে চেষ্টা করলাম। এবং সেই অনুষ্ঠান শুরুর প্ররম্ভিকে(অর্থাৎ প্রখ্যাতদের স্টেজে উঠার আগে) ওই কবিতা উৎসবের শিরোমনিকে নিয়ে লেখা আমার একটি কবিতা তাঁকেই দেখালাম। তিনি কবিতাটি পড়েছিলেন কিনা জানিনা, তবে আমার ডাইরীর পাতাগুলো উল্টিয়ে পালটিয়ে তিনি 'হুম' নামের এই ভয়ংকর শব্দটি উচ্চারন করে স্টেজে উঠে গেলেন। যাহোক, কবিতা উৎসবের সেদিনের গোটা তিরিশেক দর্শকের সারিতে ঘন্টা খানেক থাকার পর আমি আমার কর্মস্থলে ফিরে এলাম। বয়ানটি প্রতীকি হলেও সত্য।
আমার এক কবি বন্ধু আছে। একসঙ্গে বছর বিশেক চাকরীও করেছি। বয়সে বছর তিনেকের বড়ই হবে। বিখ্যাত হায়দার পরিবারের সন্তান। ঐতিহ্যবাহী কবি পরিবার যাকে বলে। সম্প্রতি সে একুশে পদকেও সম্মানিত হয়েছে। অবসরের বছর খানেক আগে দপ্তরের কাজে কম্মে একটু আয়েসী সময় সে পেয়েছিল। তাই যখনই মন চাইতো তখনই সে টেলিফোন করে আমার অফিস চেম্বারে চলে আসতো। শখের ধুমপায়ী ছিল। সুতরাং চা-সিগারেট তার জন্য রেডিই থাকতো। আড্ডাচ্ছলে তাকে আমার কবিতাগুলো পড়ে শোনাতাম। সে বেশ আগ্রহ নিয়েই শুনতো এবং মাঝে মধ্যে সংশোধনও করে দিত। এবং তার উৎসাহেই আমি কবিতা লেখার তাগিদটা অনুভব করতাম। মনে পড়ে দু'একটা দৈনিকে সে আমার কবিতা ছাপানোর সুপারিশও করেছিল। ছাপা হয়েছিল কিনা জানা নেই। তবে এই বয়সে এসে এসব কাসুন্দি ঘাঁটার সময় মান্না দের সেই বিখ্যাত কফি হাউজের গানটির কাঁধে ঝোলানো ব্যাগের অমলের কথাটিই আমাকে স্মরন করিয়ে দেয়।
যাহোক, অনিয়ম অসংগতি গুলোকে নিয়েই আমার যত মাথা ব্যাথা। কিন্তু সমস্যা তো ওই খানে। যেখানে মাথাই নেই সেখানে আবার মাথা ব্যাথা কিসের? মাথা বলতে আমি অনেক কিছুই বুঝাতে পারি। সেই বুঝের মধ্যে সত্যতা আছে বলেই হয়তো এই আর্য অনার্য কিংবা শক হুন দল মোঘল পাঠানের রক্ত পরম্পরার এই আমাদের মধ্যে বৈশাদৃশ্যের এতসব এন্তেজাম। আজকের দিনে রাষ্ট্রাচারের রাজনীতিতে যেসব হৈ হট্টগোল দেখি তাতে কি মনে হয় আমরা একই সমতল ভূখন্ডের একই ভাষাভাষি এবং একই জাতিগোষ্ঠীর মানুষ? আমাদের রাজনীতির ভিন্নতায় এই ভূখন্ডের রাষ্ট্রনীতি কি কখনও একই মোহনায় মিলিত হওয়ার কথা বলে! রাজনীতির ভিন্নতা থাকতেই পারে কিন্তু রাষ্ট্রনীতির দ্বিচারিতা কি আমাদের এগিয়ে যাওয়ার কথা বলে! যে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আমরা এত উচ্ছ্বসিত, এত গর্বিত সেই মহান নেতাকে কি আমরা গণ মানুষের পাদ প্রদীপের সমতলীয় স্বচ্ছতায় গ্রহনযোগ্য করে উপস্থাপন করতে পেরেছি? একতরফা ও একটি সুনির্দ্দিষ্ট ছন্দবদ্ধ পথ সৃষ্টি করে কোন্ অবিমৃষ্যকারিতায় আমরা তৃতীয় বিশ্বের এত বড় একজন মহান নেতাকে বাক্স বন্দি করার হোলি খেলায় মেতে আছি – এর সদুত্তর কি আমাদের কাছে আছে?
মুক্তিযুদ্ধ করে নিজ জন্মভূমিকে স্বাধীন করা এক বীরের জাতি আমরা। যে জজবা ও উচ্ছাসে আমরা মুসলিম জাতিস্বত্ত্বায় নিজেদেরকে সঁপে দিয়ে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় অবগাহন করেছিলাম, সেই মধুচদ্রিমায় ছেদ পড়ায় আমরা আপন অস্তিত্বের শেকড়ের খোঁজে নিজ আঙ্গিনায় নিজেদের থিতু করে নিলাম। এক মহানায়কের জাদুকরী অগ্নিমন্ত্রের সরল পাঠে আমরা আমাদের শেকড়ের সন্ধান খুঁজে পেলাম। সেই শেকড়ের রসাস্বাদনে আজ আমরা পঞ্চাশ বছরের পুষ্টতায় পরিপুর্ণ এক স্থিতিশীল স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রও বটে। চড়াই-উৎরাইয়ের এই অর্ধ শতাব্দীর সময়কালে বাঙালীর হাসি কান্নার অম্ল মধুর অনেক কিছুই যোগ বিয়োগের খাতায় লিপিবদ্ধ হয়েছে। প্রাপ্তির খাতা সমৃদ্ধ না হলেও বিযুক্তির হালখাতায় আমরা নিজেদের পারঙ্গমতা ভালভাবেই সেরেছি। এবং নিজস্ব জাতিস্বত্ত্বা বিনির্মানের ঊষালগ্ন থেকেই আমাদের এই সিকস্তির হাল খাতাটি সচল থেকেছে নির্মোহ ভাবে। অর্থাৎ অর্জনের মোক্ষ লাভের আকাঙ্ক্ষায় আমরা বিসর্জনের পথটাকেই সিঁড়ি হিসাবে সব সময় সামনে এনেছি। ফলে ক্ষণকালীন স্বস্তির আকাঙ্ক্ষায় আমরা আমাদের বুনিয়াদ বিনির্মানের দীর্ঘস্থায়ী অস্তিত্বকে বিসর্জন দিতেও দ্বিধা করিনি। অথচ দেশ ও জনগনের সেই আকাংখিত অস্তিত্বকে মাথায় নিয়েই পথ চলা ছাড়া অন্য কোন বিকল্প আমাদের সামনে একেবারেই অনুপস্থিত।
(ক্রমশঃ)