জালাল উদ্দিন আহমেদ
ছটা
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ১৬ ডিসেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২১ | আপডেট: ১০:৫৩ এএম, ২১ ডিসেম্বর,শনিবার,২০২৪
আজকাল পত্রিকা পড়ার অভ্যেসটা একটু একটু করে কমে যাচ্ছে। তবে পড়ি। আগের মত হয়তো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়া হয় না। বাছাই করা পাতাগুলি বরাবরের মতই সময় নিয়ে পড়া হয়। আমার হিসেবটা আবার উল্টো দিক দিয়ে শুরু হয়। হেডলাইন গুলোতে চোখ বুলিয়েয়েই পিছনের পাতার হেডলাইন। এক্ষেত্রে শুধু হেডলাইনটা পড়া হয়। ভিতরে কি লেখা আছে তা দেখার আগ্রহ থাকে না। পরবর্তীতে চলে যাই প্রিয় আইটেম খেলার পাতায়। পরে সম্পাদকীয় এবং শেষে আন্তর্জাতিক পৃষ্ঠায়। এই হোল আমার পত্রিকা পড়ার রোজ নামচা। অবশ্য মোবাইল থেকে গুগল নিউজটা পড়ার চেষ্টা করি। তবে সবচেয়ে বেশী টানে ইউ টিউব এর ভিডিও ভিত্তিক বিভিন্ন ধরনের খবরের উপর নির্মিত আইটেমগুলি। তাছাড়া আজকাল তো বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের ইউ টিউব সংস্করনের সংবাদ পর্যালোচনা এবং ব্যক্তি পর্যায়ের নিউজ পোর্টাল আমাদের আবাল বৃদ্ধ বনিতাকে চুম্বকের মতই টেনে রেখেছে।
সত্যি কথা বলতে কি, ইদানীং কালে এসব ইউ টিউব ভিত্তিক নিউজ, আলোচনা, পর্যালোচনা এবং চমক জাগানিয়া আইটেমগুলির ছটায় আমাদের বিবেক নিয়ে বসে থাকা ষাটোর্ধ মানুষগুলোর হতচকিত হয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া আর কিছুই থাকে না।কোনটা নিয়ে শুরু করবো, সেটা নিয়েই ঠেলাঠেলি শুরু হয়ে যায়৷ সবই তো টাটকা তরতাজা। প্রতিটি আইটেমই নিজস্ব ছটায় উদ্ভাসিত" । বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রীর অসুস্থতা, চিকিৎসা ইত্যাদি নিয়ে রাজনীতির ডামাডোল। রাজনীতির বাক্য সংস্কৃতি ও শিষ্টাচার। দেশের ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে শপথ ভঙ্গের অভিযোগ। ভিপি নূরকে নিয়ে নাটক এবং হালের সাবেক হয়ে যাওয়া তথ্য প্রতিমন্ত্রী 'টাঁকলার' চমক। আরো হাজারো চমক লাগানো নতুন নতুন আইটেম মাঝে মধ্যে সমাজ ও রাষ্ট্রে এমনভাবে ছটা মারে, তখন সুর্যের আলোক ছটাও সে সবের কাছে হার মানে। মানুষ তথা আম জনতাকে মন্ত্র মুগ্ধের ন্যায় বিহ্বল করে দেয় সেসব ঘটনা বা বিষয় বস্তু। এমন সব ঘটনা বা রটনা সামনে চলে আসে বা আনা হয় যা মানুষ তথা সমাজ ও রাষ্ট্রকেও অনেক সময় বিব্রত করে দেয়। এছাড়া ধর্ষন, খুন, সড়ক দুর্ঘটনা ও অন্যসব নৈমিত্তিক গদ বাঁধা অপ ঘটনার বিষয়গুলি তো আমাদের 'জন্ম থেকে জ্বলছি'র আদলেই সমাজ তথা রাষ্ট্রে বিদ্যমান রয়েছে।
রাজনীতির পঠন পাঠন এবং অনুশীলন আজকাল চোখে পড়ে না। দেশে রাজনীতি নামের প্রহসন চলছে এখন। এক দলীয় শাসনের ছক কেটে দেশ এখন শাসিত হচ্ছে। গনতন্ত্রের ন্যুনতম মূল্যবোধ নেই দেশের বর্তমান প্রচলিত শাসন ব্যবস্থায়। দেশ পরিচালনায় আলোচনা সমালোচনা বা সহমতের কোন সুযোগ নেই। বিরোধী মানেই পরিত্যক্ত। বিরোধী মানেই নাশকতা। বিরোধী মানেই হিংসা, ঘৃণা, ধ্বংস ও বিশৃংখলার একগাদা ফিরিস্তি। বিরোধ মানেই তথাকথিত উন্নয়নের ক্ষতি সাধন। ক্ষেত্র বিশেষে দেশ দ্রোহিতার খড়্গ। রাজনীতি মানে ব্যক্তি বিদ্বেষ, হিংসা ও ষড়যন্ত্রের কাহিনী এবং ব্যক্তি চরিত্র হননের বড়সড় উপাখ্যান। যে মূল্যবোধ, শিষ্টাচার, নৈতিকতা ও সহমর্মিতার কাঠামোয় রাজনীতি সমাজ তথা রাষ্ট্রে বিকশিত হয় সেই সব সুবিবেচনার চারিত্রিক বৈশিষ্ঠ্যে রাজনীতি এখন দাঁড়িয়ে নেই। রাজনীতি এখন ব্যক্তি ক্যারিশমার হেমিলিয়ন হয়ে বংশ পরম্পরার শিকড় বাকড়ের ঘোরটপে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে গেছে। রাজনীতি এখন জনগনের কথা বলে না। রাজনীতি তার জনগন তন্ত্রের মন্ত্র ছেড়ে ব্যক্তি বা পরিবার তন্ত্রের নতুন সংজ্ঞায় রচনা লিখতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। আর কর্তৃত্ববাদী শাসনের খড়্গে পড়ে গনতন্ত্র দুর্বল থেকে দুর্বলতর হচ্ছে। ফলে রাজনীতির মাঠে অপরাধী মাসলম্যানদের আগমনের পথ সুগম হচ্ছে। সময় পরিক্রমায় এরাই একসময় রাজনীতির ধারক বাহক হচ্ছে। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরের রাজনীতির পঠন পাঠনে এসবের চালচিত্রই তো আজ মুর্তমান আতংক হয়ে বাংলার জমিনে সাধারনে ঘৃনার আসর ছড়িয়েছে।
প্রবাদ প্রতিম নমস্যদের সামনে রেখে রাজনীতি আজ মাসলম্যানদের হাতে কুক্ষিগত হয়েছে। ফলে রাজনীতির শিষ্ঠাচার বলে অবশিষ্ঠ কিছু নেই। আজকের দিনে রাজনীতির পদাধিকারীরা রাজনৈতিক শিষ্টাচার সহমর্মিতা ও মানবিক মুল্যবোধকে শিকেয় তুলে উষ্মা বিদ্বেষ ও ঘৃনার আসর ছড়িয়ে এই পবিত্র অঙ্গনকে কলুষিত করে রেখেছে। রাজনীতি এখন জনগনের কথা বলে না। জনগনের কল্যানের কথা বলে না। সামাজিক সুষ্টতা ও সামঞ্জস্যতার নৈতিক তুলাদন্ডে রাজনীতির বিচরন এখনকার দিনে অলীক স্বপ্ন বলে মনে হয়। পারস্পরিক ঘৃনা ও হিংসা বিদ্বেষ এবং একে অপরের চরিত্র হননের উলঙ্গ স্টেজ হয়ে রাজনীতি এখন ক্ষমতার দাম্ভিকতায় শৈরাচারী ভুমিকা নিয়ে জনগনকে বিভাজন ও হিংস্রতার পঠন পাঠনে দুর্বার গতিতে এগিয়ে নিয়ে চলেছে। ক্ষমতা লাভের দুর্বার আকাঙ্ক্ষায় রাজনীতি আজকাল পতিত শক্তি, স্খলিত রাজনৈতিক প্ল্যাটফরম কিংবা যুবশক্তির দুর্বার ভিপি নুরদের লালন পালন করে নিজেদের পায়ের মাটি শক্ত করার অশুভ নক্সার বিনি সুতো গাঁথে।
স্বাধীনতার সুবর্ন জয়ন্তীর পাদপীঠে দাঁড়িয়ে এখনও আমরা গনতান্ত্রিক চর্চার ন্যুনতম পর্যায়ে নিজেদেরকে মেলে ধরতে পারলাম না। মধ্যযুগীয় না হলেও বিংশ শতাব্দীর রাজা রাজড়া, জমিদারীয় এবং মোড়ল মাত্ববরীয় আদলেই চলছে আমাদের সমাজ সংস্কৃতি ও দেশীয় রাজ। গনতান্ত্রিক অনুশীলন না থাকার বদৌলতে আমাদের রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়েও শপথ ভঙ্গের মত ঘটনাগুলোও হর হামেশায় ঘটে চলেছে। জবাবদিহিতার সংস্কৃতি আজ রাষ্ট্রাচারের আঙ্গিনায় খুব একটা পরিলক্ষিত হয় না। এবং এসবের লাগাম ধরে টানার সহিসও আজকাল চোখে পড়ে না। ফলশ্রুতিতে রাজনীতি আজকাল লাগামহীন অসহিষ্ণুতা ও অনৈতিক গতিপথে সাবলীল হচ্ছে। মহান নেতাদের ব্র্যাকেট বন্দি করে আমরা আজকাল পারিবারিক পরম্পরার খোলসে দেশকে গোষ্ঠীতন্ত্রে আবদ্ধ করার প্রয়াসে নিমগ্ন রয়েছি। ফলে বাঙালীয়ানার সামগ্রিকতায় কোথাও না কোথাও যেন একটা ব্ল্যাকহোল তৈরী হচ্ছে বলে বিদগ্ধজনেরা কানাকানি করেন। এবং এসবের ছটায় বিচ্ছুরিত হয়েই বাঙালী ও বাংলাদেশী মেরুকরনের যে অপরাজনীতি চলছে তা আখেরে তাদেরই লাভবান করবে যারা সাতচল্লিশে র্যাডক্লিপকে দিয়ে শ্রী ও জনাব বানিয়ে বাংলা ও বাঙালীকে দ্বিখন্ডিত করেছিল।