জালাল উদ্দিন আহমেদ
খাদ্য শস্য রপ্তানী
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ১৭ নভেম্বর, বুধবার,২০২১ | আপডেট: ০৬:৪২ এএম, ১৯ ডিসেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
একজন রাজনৈতিক নেতা হিসাবে দেশের সরকার প্রধান এরকম উচ্চাশা পোষন করতেই পারেন। কিন্তু ঐ যে পারিষদবর্গ! নেত্রীর কথা মাটিতে পড়ার আগেই যেন দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়ে যায়। তখন “বাবু যত বলে পারিষদ দলে বলে তার শতগুন” হয়ে দাঁড়ায়। চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে ভলিয়্যুম আকারে এর সম্ভাব্যতা যাঁচাইয়ের চমৎকার রিপোর্ট তৈরী হয়ে যায়। মন্ত্রী সভায় উঠে যায় সেই চকচকে রিপোর্ট। পরিকল্পনার একপ্রস্থ প্রশংসা পেয়ে তা পরিপত্র আকারে সর্বোচ্চ কলমের খোঁচায় সোজা বিজি প্রেসের গেজেট নোটিফিকেশন সেকশনে চলে গিয়ে তা নির্বাহী আদেশের রূপ নেয়। পরবর্তীতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয়ের মাধ্যমে তার বাস্তবায়নের নির্দেশনা চলে যায়।
এ এক আজব বসবাস আমাদের। “নিজে পাই না ভাত/ শংকরাকে ডাক”, এই প্রবচনটা ছোট বেলায় মা'র মুখ থেকে শুনেছিলাম। জানিনা কতটুকু যথার্থতা নিয়ে আমার এই কলম ধরা। কিন্তু যে মুখের উচ্চারনে এই নিত্য প্রয়োজনীয় আনাজ দ্রব্যের রপ্তানীর কথা উঠে এসেছে তাতো চমকে উঠার মতই একটা বিষয়। মাননীয় প্রধান মন্ত্রীর অতি আত্ম বিশ্বাসী এই উচ্চারনটি বাস্তবায়ন না করতে পারলে তো পারিষদ দলের মুখ থাকে না। আবার চরম সুবিধাভোগী দেশপ্রেমিক নয়-ছয়ের পরিযায়ী ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এটার বাস্তবায়ন করার জন্য মুখিয়ে থাকেন। পরিযায়ী বলছি এই কারনে যে, যারা এসব ব্যবসা বাণিজ্যের ধারক তারা কখনোই মূল স্রোতের দেশ গড়ার স্টেক হোল্ডারদের মত বনেদি ব্যবসায়ী বা আড়তদার নন। বলছি- উন্নয়নের রূপকথার মত এগিয়ে নেয়ার কান্ডারী আমাদের মাননীয় প্রধান মন্ত্রীর মুখ নিসৃত বাক্যটির কথা। তিনি কোন এক সরকারী সভায় বাংলাদেশ হতে সবজি-আনাজ ইত্যাদির রপ্তানী বৃদ্ধির আশা প্রকাশ করেছেন। এবং সেটা নিয়েই এই ব-কলমের কলম ধরার প্রয়াস।
আচ্ছা বলুন তো, নিত্য প্রয়োজনীয় কোন্ পন্যটি বিশেষ করে কৃষি পন্যতে আমরা স্বয়ং সম্পুর্ন? চাল গম ডাল চিনি তেল পিয়াজ আদা রসুন হলুদ ফল মুল শুকনো সবজি থেকে শুরু করে বাংলার হেঁসেলের কোন্ মসলাটি আমাদের আমদানি করতে হয় না। পরিসংখ্যা বলছে – আমাদের বছরে চাল আমাদানি করতে খরচ হয় ১০০০ কোটি টাকা। গম আমদানিতে খরচ হয় ৯৫০০ কোটি টাকা। ভোজ্য তেল আমদানিতে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে গুনতে হয় ১৪০০০ কোটি টাকা। আবার তেলবীজের জন্যও ৫৫০০ কোটি টাকার আমদানি খরচ হয়। এই ডাইবেটিস সমৃদ্ধ যুগেও চিনি আমদানি করতে হয় আমাদের। অথচ শ্বেতহস্তি হিসাবে আমাদের বৃহৎ আকৃতির বেশ কয়েকটি চিনিকল লোকসানী প্রতিষ্ঠান হিসাবে সরকারী ভর্তুকিতে দাঁড়িয়ে আছে। সেই চিনি আমদানি করতে বাংলাদেশকে গুনতে হয় ৫০০০ কোটি টাকা। আর ডাল আমদানিতেও ৩০০০ কোটি টাকা প্রয়োজন হয়। এছাড়াও পিয়াজ রসুন আদা চা হলুদ মরিচসহ নিত্য প্রয়োজনীয় আনাজের আমদানি খরচও কিন্তু কম নয়। পরিসংখ্যান ব্যুরোর ভাষ্যমতে বাংলাদেশের আমদানি পন্যের ব্যয় বছরে ৪,৩৮,০০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে এক পঞ্চমাংশই নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্য পন্যের আমদানিতেই ব্যয় হয়। নিত্য প্রয়োজনীয় এই খাদ্য পন্যের মধ্যে কি নেই সেখানে! চাল ডাল চিনি চা মধু খেজুর ভুট্টা তেল পিয়াজ দুধ দুগ্ধজাত খাবার কোমল পানীয় চিপস বিস্কুট চকলেট ক্যান্ডি মাংস ফল মসলাসহ আরও সব জানা অজানা খাদ্য পন্য।
এক কোটির মত বাঙালী বিদেশ বিভুঁইয়ে আছেন। তাদের জন্য আলু পটল ঝিঙ্গা আম কাঁঠাল ইত্যাদির যোগান দেয়া খারাপ কিছু নয়। অর্থাৎ রথ দেখাও হলো কলা বেচাও হলো। বিদেশে থেকে বাঙালী তার মাটির গন্ধ মিশ্রিত শাক সবজির স্বাদ গ্রহন করে বাঙালীয়ানায় নিজেদেরকে ঝালিয়ে রাখলো, পাশাপাশি দেশের জন্যও দশ- বিশ কোটি ডলার রপ্তানী বানিজ্য হলো। তবে এটা যদি রপ্তানী পন্য হিসাবে ওজিএল দেয়া হয় তখন তা হবে দেশের জন্য এক বিদ্ধংসী বার্তা। কৃষি তথ্য সার্ভিস সেন্টারের ভাষ্যমতে গত বছর বাংলাদেশে সবজি আনাজের উৎপাদন হয়েছে এক কোটি ষাট লক্ষ মেট্রিক টন। সেখান থেকে রপ্তানী হয়েছে ১২৫ কোটি ডলারের সবজি আনাজ। কিন্তু কত টন রপ্তানী হয়েছে তার হিসাব তারা দেয়নি। অথচ লক্ষ্যনীয় যে সরকারী সংশ্লিষ্ট দপ্তর অধিদপ্তর গুলি তাদের কর্ম সাফল্য্যের অতি কথনে সরকারকে বুঝাতে চাইলো যে আমরাই বা কম কিসে! সরকারও ভাবছে, বেশ তো!১০০০ কোটি টাকা তো কম নয়। কিন্তু অন্দর মহলের খবর কি? সুষ্ঠ বাজার ব্যবস্থা, বিতরন ও বন্টন ব্যবস্থা, সংগ্রহ ও পরিসেবা উন্নয়নের কোন একশ্যান প্ল্যান সেখানে আছে কি? কৃষক হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খেটে ফসল উৎপাদন করছে। আর সেই উৎপাদের বাজারজাত করনের জন্য তারা ফড়িয়া মধ্যস্বত্ত্ব ভোগীদের কাছে জিম্মি হচ্ছে। বিশ টাকার মাল পাঁচ টাকায় বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে। কেননা সাধারন কৃষকের কাছে পচনশীল ওইসকল সবজি আনাজ সংরক্ষন করে রেখে বিক্রি করার কোন পথ জানা নেই। অথচ এসব দেখভাল করার জন্য সরকারী ডজন ডজন দপ্তর পরিদপ্তর রয়েছে। যদি সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলো সুষ্ঠভাবে পরিচালনা করে কৃষিপন্য সরবরাহ ও সংরক্ষনের দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা করতো কিংবা কর্পোরেট হাউজগুলো এসব কাজে এগিয়ে আসতো তাহলে সবজি আনাজের পচে যাওয়া, পড়ে থাকা বা বিক্রি না হওয়ার কোন কারন ছিল না। তাইতো আমাদের বিশ টাকার আলু চল্লিশ টাকা কিংবা দশ বিশ টাকার টমেটো এক'শ দেড়'শ টাকায় কিনতে হয়।
সত্যি কথা বলতে কি,সবজি আনাজ ইত্যাদির উৎপাদনশীলতায় আমরা এখনও স্বয়ং সম্পুর্নতা অর্জন করতে পারিনি। নইলে আজকে কেন আমাকে বিশ টাকার বেগুন আশি টাকায় কিনতে হয়। তিরিশ টাকার করল্লা নব্বই টাকায় কিনতে হয়। দশ টাকার শাক সবজি কিনতে তিরিশ চল্লিশ টাকা গুনতে হয়। বাজারে লেবু কিনতে গেলে তিরিশ চল্লিশ টাকা হালি কিনতে হয়। অথচ রাজধানীর মহা সড়কের ফুটপাতে হবিগঞ্জ সিলেটের সুগন্ধি লেবু দশ টাকা হালি বা অনেক সময় দশ টাকায় দশটা হিসাবে নেটের জালে বিক্রি করতে দেখি। আবার বাজার বা শপিং মলে ওই লেবু কিনতে হয় দশ বারো টাকা পিস হিসাবে। সরকারী ঘোষনার দশ টাকার চাউল এখন চল্লিশ টাকা আর চল্লিশ টাকার চিকন চাল পঁয়ষট্টি সত্তর টাকা। এই বাড়তি টাকাগুলো কে নিচ্ছে? এখানে সুষ্ঠ বাজার ব্যবস্থাপনা কোথায়?
দেশের সিংহভাগ মানুষ আজ কি অবস্থায় আছেন, বিশেষ করে দুবেলা অন্ন যোগনে তাদের কি অবস্থা তা সমাজ বিজ্ঞানী বা রাষ্ট্র পরিচালনা কারী যারা আছেন তারাই ভাল জানেন। কিন্তু দিন আনে দিন খাওয়া মানুষগুলোর কি অবস্থা তা কি অনুমান করা যায় না? কোভিডের এই গৃহবন্দি নিষ্কর্মা মানুষগুলো যারা বাংলার সিংহভাগ অংশে পড়ে তাদের রোজ নামচা কিভাবে চলছে তা কি আমরা জানি? এসব কথা বলতে গেলে শুধু কষ্টের কথাগুলোই বেরিয়ে আসে। সুতরাং রপ্তানী হোক। কিন্তু ওইসব কৃষিপন্যের সুষ্ঠ সংগ্রহ ও বাজার ব্যবস্থার সুষম করন করেই তো তা করা উচিত। ঐ এক'শ বা দুশো কোটি বা পাঁচ'শ কোটি ডলার নিয়ে আমি কি করবো? ওদিকে তো আমার পঞ্চাশ হাজার জোটি টাকা বেরিয়ে যাচ্ছে বাংলার আঠার কোটির মুখের আহার যোগাতে। আলু রপ্তানী কেন? চিপস আমিদানী বন্ধ করুন। আমি যেখানে দশ টাকায় চিপস পাচ্ছি সেখানে কোন দুঃখে আমার মধ্যবিত্তের বাচ্চাটাকে পঞ্চাশ টাকার leys চিপস খাওয়াতে হবে? সবজি আনাজের জন্য দূরপ্রাচ্য ও পশ্চিমের দেশগুলোর মত সেরকম সংরক্ষন ব্যবস্থা গড়ে তুলুন। নিজের বন্টন ব্যবস্থায় সামঞ্জস্যতা আনুন। খামোখা ভোক্তা অধিকার বিএসটিআই বা হেন তেন করে কি হবে। ওরা চেয়ার চায়, ক্ষমতা চায়, এসি রুম চায়। বিনীতভাবে বলতে চাই কৃষিবিদদের একটি দেশ প্রেমিক অংশ ছিল বলেই হয়তো আজকে খাদ্য উৎপাদনে আমাদের এইরকম রমরমা অবস্থা। কিন্তু বাকীরা কি করছে?
ছোট্ট ভূখন্ডের দেশে মানুষের জায়গা সংকুলানে আমরা হিমশিম খাচ্ছি। কৃষিজমি শিকস্তির পর্যায়ে থাকলেও আমাদের অদম্য কর্ম প্রচেষ্টা ও কৃষিবিদদের উদ্ভাবনী সহয়তায় বাংলার কৃষক আজ হালে পানি পেয়েছে। সেক্ষেত্রে শুধুমাত্র ধান নয়, পাশাপাশি নিত্য প্রয়োজনীয় অন্যান্য কৃষিপন্য উৎপাদনের জন্য আমাদের মাঠমুখী হতে হবে। প্রাপ্ত সুবিধা অসুবিধা দিয়েই আমাদের অন্যান্য সবজি আনাজের উৎপাদন ব্যবস্থায় শৃংখলা এনে তাতে স্বয়ম্ভরতা আনার উদ্যোগ নিতে হবে। এতে করে আমাদের আমদানি নির্ভরতা কমে যাবে। সর্ব প্রকার খাদ্যপন্য উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারন করে আমাদের নিজস্ব খাদ্য ভান্ডারের স্বয়ং সম্পুর্নতা আনার প্রচেষ্টা নিতে হবে। তামাক চাষ নিয়ে এখনো কেন আমরা মাতামাতি করি। ওসব হিসেবের খরচায় ফেলে কেন আমরা সয়াবীন চাষে মনোযোগী হচ্ছি না?
রপ্তানী যখন আমাদের রাষ্ট্রীয় পলিসির প্রাধিকারের প্রথম সোপান তখন শিল্পোন্নয়নের দিকে এগিয়ে যাওয়াটাই তো সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। মনে পড়ে বছর কয়েক আগে মাননীয় প্রধান মন্ত্রী বেশ উচ্চাশা নিয়েই বলেছিলেন, এবং একটা মানসিক প্রশান্তির আত্মবিশ্বাস ছিল তার সেদিনের সেই উচ্চারনে। তিনি জানতেন এবং এখনো বিশ্বাস করেন যে পাট চা চামড়া হচ্ছে আমাদের অভ্যন্তরীন কাঁচামাল সমৃদ্ধ শিল্প সেক্টর। সুতরাং এসব নিয়ে একজন দেশ নেতার উচ্চাশা থাকতেই পারে। তিনি খুব বড় মুখ করে সেদিন ঘোষনা দিয়েছিলেন যে চামড়া সেক্টর থেকে আমরা পাঁচ বিলিয়ন ইউএস ডলারের রপ্তানী আয় আশা করছি। এমন কি তিনি চামড়াকে সে বছরের Product of the year ঘোষনা করেছিলেন। কত বড় সৌভাগ্য ও সুনজর থাকলে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আধিকারিকের মুখ দিয়ে এত বড় উচ্চাশা উচ্চারিত হয়, বলতে পারেন? অথচ কি দেখলাম আমরা! সরকারী প্রতিষ্ঠানের অজ্ঞতা ও ব্যর্থতা, কিছু মধ্যস্বত্ত্ব ভোগীর অবিমৃষ্যকারিতা এবং স্টেক হোল্ডারদের অসহায় আত্মসমর্পনের কারনে সরকারী সর্বোচ্চ পর্যায়ের সেই সদিচ্ছার অপমৃত্যু ঘটলো। আজকের দিনে চামড়া শিল্পের নিজস্ব বুনিয়াদ থাকা সত্ত্বেও তারা গার্মেন্টস শিল্পের মত Supporting Industries এর রূপ নিতে চলেছে। এছাড়া পাটজাত পন্য উৎপাদন ও তার বিকাশেও সেরকম কোন আহামরি কিছু দেখা যাচ্ছে না। এক সময় যে চা রপ্তানী করে আমরা গর্ব করতাম এখন সেই চা আমদানী করে আমাদের চলতে হয়। সুতরাং সরকারী মেকানিজমের কাছে সনির্বন্ধ অনুরোধ, দেশের শিল্প বিকাশে উন্নয়নের গতি প্রবাহ বাড়ান। বিশেষ করে অভ্যন্তরীন কাঁচামাল সমৃদ্ধ শিল্পের বিকাশ ও তার রপ্তানীর গতিপথের মসৃনতায় দেশের প্রকৃত বুনিয়াদ লুকিয়ে আছে। পর নির্ভর কাঁচামাল সমৃদ্ধ শিল্প ক্ষনিকের জৌলুশ দিবে হয়তো, কিন্তু আভ্যন্তরীন কাঁচামালের উপর ভর করে আমরা এই শিল্পকে বহুভাবে বহুদূর এগিয়ে নিতে পারি। তেমনি সবজি আনাজের বেলাতেও product diversification এর চিন্তায় আমাদের এগিয়ে যাওয়ার অনেক পথ খোলা আছে। অবশ্যই তা শিল্প উন্নয়নের মাধ্যমে। খামোখা হাদরিদ্র বাঙালীর পেটে লাথি মেরে তাদের দুবেলা পাতে পড়া সবজি আনাজের রপ্তানীর জোশ তুলে দেশের শ্রেষ্ঠতম আধিকারিককে বিভ্রান্ত করবেন না। আশা করি রাজনৈতিক বিচক্ষনতার কড়িকাঠে ফেলে সরকার তার মেকানিজমকে দেশের শিল্পায়নের্ যথার্থতা নিরূপনে কাজে লাগাতে কামিয়াব হবেন।