জালাল উদ্দিন আহমেদ
স্মৃতি দীপ
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ২২ অক্টোবর,শুক্রবার,২০২১ | আপডেট: ০৬:৪১ এএম, ১৯ ডিসেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
কবি বলেছেন, 'ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বালু কণা বিন্দু বিন্দু জল গড়ে তুলে মহাদেশ সাগর অতল'। মানব জীবনে বালু কণা ও জল কণার প্রভাব স্থান-কাল-পাত্রের উপর ভর করে তার ভূ-ভৌগোলিক অবস্থানকে নিশ্চিত করে। তবে একটি কণা প্রতিটি মানুষের জীবনের আনাচে কানাচে বুদবুদ আকারে ভুটভাট করতে থাকে যা দিয়ে সে তার মনের মাধুরী সাজিয়ে স্মৃতিকণার ডালি সাজাতে পারে। প্রতিটি মানুষের স্মৃতি দীপে টিমটিম ক'রে ওসব কণাগুলো বিচ্ছিন্নভাবে বুদ বুদ করতে থাকে। সেই স্মৃতি কণা গুলিকে কেউ ধরে রাখে কেউবা গুছিয়ে সাজিয়ে তার আকার দেয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু অন্তর্যামীর ইচ্ছার অদৃশ্য হাত অনেক সময় তাকে নিরুৎসাহিত করে থামিয়ে দেয়। মানুষকে মহান সৃষ্টিকর্তা আশরাফুল মোখলুকাত করে সৃষ্টি করেছেন। সুতরাং সৃষ্টির সেরা জীব হিসাবে তার স্বকীয়তা থাকবেনা তা তো হতে পারে না। তাইতো মানুষ তার নিজের জীবনের আয়ুষ্কালে ঘটে যাওয়া স্মৃতিগুলিকে ব্যঞ্জন সহকারে উপস্থাপন করে তার পরবর্তী প্রজন্মের জন্য রেখে যায় অনুভূতির ইনস্টিংটস হিসাবে। এতে ক'রে মানব জীবনের ব্যক্তি পর্যায়ে তার জীবন নির্ঘন্টের ভিন্ন ভিন্ন ঘটনাচক্র কখনও আবেগী কখনোবা বাস্তবতার নির্যাসে তার উত্তর পুরুষদের জ্ঞানার্জনের সহায়ক হিসাবে কাজ করে।
শ্রেণী বিভেদের এই সমাজে স্মৃতি কথার স্বতঃস্ফুর্ততা কখনোই সমান ভাবে বিকশিত হয় না। এখানে 'বিকশিত' শব্দটি প্রায়োগিক অর্থের সাযুজ্যে সামনে চলে আসে। রাজা বাদশাহর বিষয়টি একবিংশের বর্তমান উঠানে বেমানান হলেও ক্ষমতার দন্ড হাতে নিয়ে যারা দেশ বা ভূখণ্ডের কর্তা সেজে বসেন, তাদের দোর্দন্ড প্রতাপ তখন প্রচার ও প্রসারের মানদণ্ডে একাকার হয়ে যায়। ওই প্রফাইলে হাঁটা চলায় তখন তারা এত দ্রুততার সহিত সব কিছুকে নিজের বজ্র মুষ্টিতে ধারন ক'রে ফেলে যে, সে সময় দীন দুনিয়ার সব কিছুই এক মুখী হয়ে চলতে স্বচ্ছন্দ বোধ করে। নিজেদের জৌলুশের যাত্রাপথে ওটাকেই চলার পথ ভেবে নেয় তারা। ফলে তাদের দুর্দমনীয় একনায়ক সুলভ কার্যকলাপ বা চলার গতি পথ লিপিবদ্ধ আকারে প্রকাশিত হয়ে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে স্বতঃসিদ্ধ হয়ে বিচরন করার মর্যাদা পায়। আর এই মর্যাদা বা স্বতঃসিদ্ধতা দেয়ার এন্তেজামে ওইসব প্রভাবশালী নেতা মহারথীদের উত্তর পুরুষ ও তাদের বেষ্টিত মোসাহেবরা আদা জল খেয়ে মাঠে নেমে পড়েন।
তত্ত্ব কথা ছেড়ে এখন বাস্তবতায় আসা যাক। ইদানীং দিনকাল এমন হয়েছে যে ব্যক্তি নির্বিশেষে এখন বিশেষণ, পদবি কিংবা নামের পূর্বে বা পরে তাদের উচ্চ শিক্ষার ডিগ্রি বা খেতাবগুলি জুড়ে না দিলে যেন সব কিছুই ধুসর হয়ে যায়। অন্ততঃ ব্যক্তি বিশেষের রেখে যাওয়া অবশিষ্টরা এসবের শো-অফে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েন। আজকাল রাজনীতি ও সমাজ নীতির প্রকাশ ভঙ্গি ও তার আলোচনায় এসব ডিগ্রী বা খেতাবের বেশ পসার দেখা যায়। ক্ষমতার বরপুত্র হয়ে কেউ যখন তার জীবন যুদ্ধের স্মৃতিগুলি ছয়কে নয় করে উপস্থাপন করেন এবং তার উত্তর পুরুষেরা সেসব স্মৃতি কণাগুলিকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বয়ান করেন তখন সেটা হয়ে পড়ে সমাজ পাঠের শ্রেষ্ঠ উপন্যাস। আবার ক্ষমতাহীন ও আদর্শিকতার পাদপীঠে বিররন করা নেতা নেত্রীদের কালজয়ী উচ্চারনের শব্দগুলি যখন নিপীড়িত জনগনের মুক্তির পথ দেখায় তখন তা লিপিবদ্ধ আকারে কালোত্তীর্ণ স্মৃতিদীপ হয়ে পরবর্তী প্রজন্মকে দেশ মার্তৃকার লড়াকু সৈনিক বানায়। কালের বহমানতায় কোন বিপ্লবী জন নেতার স্মৃতি কথা একটি গোষ্ঠীয় আবরনে আলোক বর্তিকা ছড়িয়ে ভবিষ্যতের প্রজন্ম তৈরীতে সমাজ গঠনের উপাদান হয়ে বিচরন করে। ক্ষমতার পালকিতে না চড়ে একজন সমাজ পতি কিংবা শিল্প পতির স্মৃতিচারন মূলক দস্তাবেজ সমাজ গঠনে কার্যকরি হয় তখনই, যখন সমাজ ও রাজনীতি নীতি-নৈতিকতার কথা বলে। সমাজ ও রাষ্ট্রের সুষ্ঠ বিকাশে যার স্মৃতিকথা ও দিক নির্দেশনামূলক উচ্চারন সবচেয়ে টেকসই হয়ে সমাজে প্রতিধ্বনিত হয় তিনি হচ্ছেন শিক্ষক। শিক্ষকের নৈতিকতার আলোক ছটার বিচ্ছুরন বা তার স্মৃতি কথার অমিয় বাক্যগুলি যখন সমাজ ও রাষ্ট্রের পরতে পরতে সুবাস ছড়ায় এবং তা সমাজ ও রাষ্ট্র পর্যায়ে আলোচিত হয় তখন সত্যিকার অর্থে তা আশীর্বাদ হয়ে সমাজ জীবনের শ্রীবৃদ্ধি ঘটায়। একজন পদস্থ কর্মচারীর স্মৃতি কথাও কখনো সখনো তার কর্ম জীবনের সততা ও সুবিন্যস্ত গতি পথের আলোক বর্তিকায় তার উত্তর সূরীদের সরল পথ দেখাতে সাহায্য করে। কবি সাহিত্যিকদের সুবচনের স্মৃতিগুলি ব্যক্তির চরিত্র গঠন ও সামাজিক বিন্যাসের মেল বন্ধন ঘটায়। এরকম হাজারো স্মৃতি কথার ভিন্ন ধর্মীয় উপাদানের ম্যাসেজ গুলো ছাঁকনির জালে পরিশুদ্ধ হয়ে একটি জাতি ও সমাজ গঠনের মোহনায় অবগাহন করে।
স্মৃতি কথার ম্যাসেজ গুলি যেমন সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনে বর্তমান প্রজন্মকে তার পুর্ব পুরুষের জ্ঞান গরিমা কিংবা তাদের চলা ও বলার বিশুদ্ধতায় আলোকিত করে তেমনি চিন্তার বিশুদ্ধতায় তারা সমৃদ্ধ হয়। সেক্ষেত্রে ব্যতিক্রমী ঘটনাগুলি ঘটে তখনই যখন ওইসব স্মৃতিকথা বা ব্যক্তি বিশেষের শৌর্য বীর্য এবং তার গোত্রীয় দাম্ভিকতায় জাতিগত বিভেদের সৃষ্টি করে। গোষ্টীয় বা গোত্রীয় অহংকার ও দাম্ভিকতায় বহু জাতিস্বত্ত্বা এই পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। আবার ধর্ম কর্ম আচার অনুষ্ঠানের ভিন্নতায় সৃষ্ট জটিলতায় বহু জাতিস্বত্ত্বা বহুধা বিভক্ত হয়ে গেছে। ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের ব্যবহারিক প্রয়োগ ও তাদের পুর্ব পুরুষের রেখে যাওয়া বিধি বিধান ও বয়ানের ব্যাখ্যা বা অপ ব্যাখ্যা নিয়ে একই জাতিস্বত্ত্বার চলার পথ দ্বিধা বিভক্ত হয়েছে। ফলে জাতি স্বত্ত্বার অন্তর জ্বালায় তারা প্রতি নিয়ত দগ্ধ হচ্ছে।
ধর্ম কখনও হিংসা বিদ্বেষ ছড়িয়ে পর ধর্মকে বিব্রত করে না। অন্ততঃ আমাদের ক্ষুদ্র পরিসরের ভারতীয় উপমহাদেশে ধর্মীয় অবস্থান সব সময় শান্তিপুর্ণ সহাবস্থানে সমৃদ্ধ ছিল। তাছাড়া প্রকৃত ধর্মগুরুরা কখনোই নিজ ধর্ম সামনে রেখে পর ধর্মের কুৎসা রটানো বা তাদেরকে হেয় করার হীন অপকর্মে কখনোই লিপ্ত হন নি। কিন্তু ধর্মের নাম করে ধর্ম ব্যবসায়ীরা কিংবা তাদের পোষ্য রাজনীতির ফেরিওয়ালারা যখন ধর্মকে নিয়ে উড়নচন্ডি হয়, বিপত্তিটা ঘটে তখনই। রাজনীতির কুট চক্রে ধর্ম নিয়ে ভেদাভেদ ও ঝগড়া ঝাঁটি সেই যে শুরু তা এখনো থামেনি। পূর্ব পুরুষের রেখে যাওয়া চিন্তা চেতনার স্মৃতি এবং তাদের বলে যাওয়া কথাবার্তার বিষাক্ত থাবায় (অর্থাৎ স্মৃতি কথায়) জাতি প্রথার অখন্ডতা ধর্মীয় জাতি প্রথায় রূপ নিয়েছে। আমরা এখনো তাদের উচ্চারিত সেইসব ধর্মীয় বিষাক্ত কথাবার্তা ছড়িয়ে সমাজকে কলুষিত করছি। এর শেষ কবে হবে–জানি না। তবে পূর্ব পুরুষদের স্মৃতিকথা বা আত্মকথা যা বাণী আকারে এখন বিভাজিত সমাজে প্রচলিত হয়েছে তার অনেক কিছুই আজকের এই একবিংশের আলো ঝলমলে উঠানে অসাড় বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে।
স্মৃতি কথা, আত্ম কথা, জীবনী কথা সব কিছুই ভাল। কিন্তু সেইসব স্মৃতি কথা যখন সমাজে বিভাজনের বিষ বাষ্প উদগীরনে একই উঠানের ভাইয়ে ভাইয়ে হিংসা ও বিভেদ সৃষ্টি করে তখন তা অমিয় বাণী, অমর বাণী বা শাশ্বত বাণী না হয়ে আমাদের সামনে কন্টক বাণী রূপে প্রতিভাত হয়। ক্ষেত্র বিশেষে তা বিষ বাষ্পের ভিস্যুভিয়াস হয়ে সমাজ কাঠামোকে বিনাশ করে। সেক্ষেত্রে জাতিস্বত্ত্বার আত্ম শ্লাঘায় আমরা তখনই উচ্চকিত হব যখন পুর্ব পুরুষদের স্মৃতি কথার নির্যাস নিংড়ে সেটাকে স্মৃতিদীপ বানিয়ে তার বিচ্ছুরনে আলোকিত হওয়ার শপথ নিব। আসুন আমরা আমাদের মহাপুরুষদের স্মৃতিকণা থেকে উৎসারিত স্মৃতি কথা গুলিকে স্মৃতি দীপ বানিয়ে নিজেদেরকে সমৃদ্ধ করি।