জালাল উদ্দিন আহমেদ
টেনারী শিল্পের অচলাবস্থা নিয়ে লেখা এই নিবন্ধের প্রথম পর্ব প্রকাশিত হয় ৩০ সেপ্টেম্বর
ভূমিষ্ট হওয়ার পুর্বেই শিশুটিকে মেরে ফেলার সুপারিশ
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ৭ অক্টোবর,বৃহস্পতিবার,২০২১ | আপডেট: ১২:৪০ এএম, ২২ ডিসেম্বর,রবিবার,২০২৪
(পুর্ব প্রকাশিতের পর)
যাহোক কাজ শুরু হলো। কিন্তু কিসের কি! আবারো সেই তঞ্চকতা শুরু হয়ে গেল। একদিকে পরিবেশ বাদীদের চাপ, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক বাজারের ক্রেতাদের হাজারো শর্ত। এহেন পরিস্থিতিতে সে সময়ে হাজারীবাগে টেনারী শিল্প সচল রাখা দায় হয়ে পড়ে। এসব ব্যাপারে আইনের সর্বোচ্চ আলয় হতে কোন ব্যাখ্যা চাওয়া হলে চামড়া শিল্প প্রকল্পের তৎসময়ের অতি তৎপর প্রকল্প পরিচালকের তরফ থেকে তাদের সাভার শিল্পাঞ্চলের সাকসেস স্টোরি (success story) শোনানো হয়। এমনকি টেনারী মালিকদের অসহযোগিতার কেচ্ছাই বেশী করে বাজানো হয়। অথচ সরেজমিনে দেখা যায় সিটিপির মূল অংশ অর্থাৎ যে আধার বা ট্যাঙ্ক দিয়ে তরল বর্জ্য গ্রহন করে তা পরিশোধিত হবে সেই ট্যাঙ্ক নির্মানের কাজই ঠিকভাবে শুরু হয়নি। মিডিয়ার কল্যানে দেশবাসী এসব দেখেছে। এভাবেই ২০১২ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত এই নতুন টেনারী শিল্পের বুনিয়াদ নির্মান আর হাজারীবাগের চলমান এক শিল্পাঞ্চলের ভাগ্য নিয়ে সাপ-লুডুর খেলা চলতে থাকে। এক্ষেত্রে টেনারীর মালিক পক্ষ ও বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের কথাবার্তায় শোরগোল শুরু হলে বুয়েট নামক এক মহা প্রসিদ্ধ প্রতিষ্ঠানের তথাকথিত পরামর্শক ও সেসময়ের এক ধুরন্ধর প্রকল্প পরিচালকের যৌথ প্রযোজনায় জাতিকে বিভ্রান্ত করে টেনারী মালিকদের সামনে এসে কথা বলার পথকে সঙ্কুচিত করা হয়।
এখন সংক্ষেপে টেনারী শিল্পের CETP সম্পর্কে একটু ধারনা নেয়া যাক। পরিবেশ বান্ধব চামড়া শিল্প নগরী স্থাপনের মূল লক্ষ্যই ছিল চামড়া শিল্পের পরিবেশ দূষন রোধকল্পে ওই শিল্পাঞ্চলের তরল ও কঠিন বর্জ্য শোধন করে তা প্রাকৃতিক পরিবেশে ছেড়ে দেয়া। এবং প্রস্তাবিত সিইটিপির মাধ্যমেই সেটা বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যেই এই শিল্পাঞ্চলের পত্তন হয়। প্রস্তাবিত সিইটিপির তিনটি শাখার কার্যক্রম পাশাপাশি চালু রাখতে হয়। নইলে পরিবেশ বান্ধবতার মূল প্রস্তাবনাতেই হোঁচট খেতে হয়। টেনারী শিল্পের উৎপাদন ব্যবস্থায় দেখা যায় কাঁচামালের প্রাপ্যতায় উঠানামা থাকায় peak season ও lean season, এই অবয়বে টেনারীর উৎপাদন চক্র নির্ধারিত হয়। সাধারনতঃ কোরবানী ও তার পরবর্তী চার মাস টেনারী উৎপাদনের peak season চলে। হাজারীবাগের স্থিতাবস্থার হিসাব করেই সিইটিপির ক্যাপাসিটি নির্ধারন করা হয়েছে। তাতে দেখা যায় পিক সিজনে হাজারীবাগের টেনারী শিল্পের তরল বর্জ্য নিষ্কাশনের মাত্রা সর্বোচ্চ ২১০০০ মেট্রিক টন/দৈনিক এবং কঠিন বর্জ্যের নিষ্কাশন মাত্রা দৈনিক ১৭০ মেট্রিক টন। সেই হিসাব করেই সাভার টেনারী স্টেটের সিইটিপি চার মডিউল এর আদলে নির্মানের পরিকল্পনা করা হয় যার প্রতিটি মডিউলের ক্যাপাসিটি ৫০০০ কিউবিক মিটার করা হয়। ক্রোম সালফেট টেনারী উৎপাদনশীলতার প্রধানতম কেমিক্যাল যা পরিবেশের সংস্পর্শে এলে তা echo সিস্টেম কে ধংস করে দেয়। এজন্য টেনারী হতে নিষ্কাশিত তরল বর্জ্যের ক্রোম মিশ্রিত তরল আলাদা ভাবে নির্গমনের ব্যবস্থা করে তা তিনটি বা চারটি chrome recovery ইউনিট স্থাপনের মাধ্যমে chrome recover করার ব্যবস্থা করা হয়। আবার নিষ্কাশিত কঠিন বর্জ্য ধারনের জন্য মোটামুটি এক থেকে দেড় লাখ টন ধারন ক্ষমতা সম্পন্ন dumping yard নির্মানের ব্যবস্থাও এই কমপ্লেক্সে রাখা হয়। অর্থাৎ টেনারী সমূহ থেকে সাধারন তরল ও ক্রোম তরল বর্জ্য ভিন্ন ভিন্ন পথে গিয়ে মূল সিইটিপিতে গিয়ে তা প্রাইমারী, কেমিক্যাল ও বায়োলজিক্যাল শোধনের পর সাধারন জলাধার বা নদীতে নিষ্কাশন করা হবে এবং ঐ নিষ্কাশিত তরল সাধারনভাবে দূষণমুক্ত থেকে তা প্রকৃতিতে মিশবে। ক্রোম রিকভারি প্লান্ট থেকে তরলে মিশ্রিত ক্রোম পুনরুদ্ধার করে তা ব্যবহারোপযোগী করার ব্যবস্থা নেয়ার পরই সেই তরল বর্জ্য মূল সিটিপিতে মিশ্রিত হবে। টেনারী নির্গত কঠিন বর্জ্য এবং সিইটিপি হতে নির্গমন যোগ্য স্লাজ (sludge) অর্থাৎ solid waste কনভেয়ার সিস্টেমের মাধ্যমে চলে যাবে Damping yard বা কঠিন বর্জ্য আধারে। সেক্ষেত্রে কঠিন বর্জ্য সংকুলানের ক্ষমতা যেহেতু তিন-চার বছরেই অপ্টিমামে (optimum) চলে যাবে বিধায় সেখানে বিকল্প ব্যবস্থার কথাও বলা আছে। যেহেতু এটা কোন টেকনিক্যাল আলোচনা বা থিসিস পেপার নয়, সুতরাং সাধারনে অবহিতির জন্যই প্রবন্ধ আকারে উপস্থাপন করা হোল।
২০১৭ সালের প্রথম দিকের কথা। ঢাকার হাজারীবাগ সংলগ্ন বসতি স্থাপনকারী জনগনের out cry এবং পরিবেশ বাদীদের বিভিন্ন কর্মসূচিতে তখন টেনারী শিল্পের তথৈবচ অবস্থা। ওদিকে সরকারী বহুমুখী চাপ এবং সরকারী প্রতিষ্ঠান কর্তৃক প্রকল্প পরিচালনার দায়ভার থাকায় চারিদিক থেকে হাজারীবাগের টেনারী বন্ধের একই আওয়াজ উঠতে থাকে। কিন্তু প্রকৃত অর্থে সাভার টেনারী এলাকায় সিইটিপি নির্মানের দৃশ্যমান কোন কাজ তখনও চোখে পড়ার মত হয়নি। তাছাড়া সিইটিপি এমন এক কর্মধারার মিশেল কর্মযজ্ঞ যা একটির সঙ্গে আর একটি পরিপুরক। কিন্তু কে শুনে কার কথা। তাছাড়া শত কোটি ডলার বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা ওইসব ভুক্তভোগী রোজগেরে মানুষগুলির কথা কি সরকারী লাল দেয়ালের এসি রূমে সহজে পৌঁছায়! দুটি পক্ষ দাঁড়িয়ে গেল। একদিকে সরকার অন্যদিকে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বৈদেশিক মুদ্রা আয়কারী চামড়া শিল্প সেক্টর। দুপক্ষের লড়াইয়ে প্রথম পক্ষের জয় হয়। দেশের সর্বোচ্চ আলয়ের হুকুমে হাজারীবাগ টেনারী মুক্ত করা হয়। টেনারী বন্ধ হয়ে পড়ে। কিন্তু অল্প সময়েই টেনারীর মালিকেরা তাদের নিজেদের ব্যবয়ায়িক অস্তিত্ত্বের স্বার্থে অতি দ্রুত সময়ের মধ্যে সাভারের নতুন শিল্পাঞ্চলে টেনারী স্থাপন করে ফেলেন। ওদিকে সাভারে এতগুলো টেনারীরর বর্জ্য conceive করার সক্ষমতায় তখনও ওই শিল্পাঞ্চল প্রস্তুত ছিল না। ততদিনে সবেমাত্র দুটি মডিউলের সিভিল ওয়ার্ক ফিনিসিং পর্যায়ের পথে। কিন্তু সিইটিপি চালু করার অন্যান্য ইলেক্ট্রো মেকানিক্যাল কাজগুলো তখনো পুরোপুরি installed করা হয়নি। ফলে পচনশীল চামড়া শিল্পের নিষ্কাশিত বর্জ্যের অবারিত অপসারন সেই ২০১৭ এর এপ্রিলের মাঝামাঝি সময় থেকেই শুরু হয়ে যায়। অর্থাৎ সেই তখন থেকেই টেনারীর বর্জ্য, অপরিশোধিত ভাবেই পার্শ্ববর্তী ধলেশ্বরী নদীতে ফেলা শুরু হয়। ধারাবাহিক ভাবে প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় এই অসামঞ্জস্যতা নিয়ে রিপোর্ট করেছে। টিভি টক শোও হয়েছে অনেক। কিন্তু কাজ কতটুকু হয়েছে তা বর্তমানের সাভারের হাল হকিকতই বলে দেয়। চামড়া শিল্পনগরীর সিইটিপি তার কার্যকারিতা শুদ্ধাচারের মানদন্ডে আছে কিনা তা বাস্তবতাই বলে দেয়। ক্রোম রিকভারির কোন বালাই নেই, জল সরবরাহের কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপনা হুমকির মুখে। কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কাজটিও ঝুলে রয়েছে। আরো বহু টেকনোলজিক্যাল বিষয় মান্যতায় না এনে হাজারীবাগ স্টাইলেই চলছে সাভারের পরিবেশ বান্ধব টেনারী শিল্পাঞ্চলের টেনারী সমূহ। পরিবেশ দূষন রোধে কোন্ আঙ্গিকে এই নতুন এবং তথাকথিত পরিবশ বান্ধব চামড়া শিল্প নগরী তাদের উৎপাদনশীলতা বজায় রেখেছে সেটা অন্তর্যামীই জানেন। তাই বলে কি বসে থাকলে চলবে! যেটা আছে সেটা নিয়েই এগিয়ে যাওয়ার কর্ম পরিকল্পনা গ্রহন করে এগিয়ে যেতে হবে। কি হয়েছে বা কি হওয়ার কথা ছিল তার দায়বদ্ধতা নিরূপনের দায়িত্ব সরকারের। আমাদের এগিয়ে যাওয়ার কথা ভাবতে হবে। পরিবেশ সহনশীলতার ন্যুনতম প্যারামিটার নির্ধারন করে দেশের বৃহত্তম বৈদেশিক মুদ্রা আয়কারী এই শিল্প সেক্টরটিকে চালু রাখার মানসিকতায় এগিয়ে আসতে হবে। আমরা পারি। তার জল জ্যান্ত উদাহারন আমরা অনেক ক্ষেত্রেই সৃষ্টি করেছি।
ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় দেখেছি, চেন্নাই ও লাহোরের পরিবেশ অধিলদপ্তর তাদের নিজস্ব ক্যাপাসিটিতে টেনারী শিল্প সেক্টরের সাথে যৌথভাবে পরিবেশ দূষন রোধের কর্ম পরিকল্পনায় সরাসরি অংশ গ্রহন করেন। কিভাবে পরিবেশ দূষন রোধে সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এ থেকে পরিত্রান পাওয়া যায় সেটা নিয়ে টেনারী স্টেক হোল্ডারদের সাথে তারা সহযোগী হিসাবে কাজ করেন। ভারতীয় উপমহাদেশের তিনটি দেশের অভিজ্ঞতায় ভিন্নধর্মী ধারনা জন্মেছে। চেন্নাইয়ে দেখেছি সেখানকার পরিবেশ অধিদপ্তরের আধিকারিকরা আন্না ইউনিভার্সিটির সেন্ট্রাল লেদার রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সঙ্গে যৌথ প্রকল্প নিয়ে চামড়া সেক্টরের দূষন মুক্ত পরিবেশ তৈরীতে সম্মিলিতভাবে কাজ করছেন। লাহোরে পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের দেখলাম, তারা টেনারী স্টেক হোল্ডার ও ইউনিডো এক্সপার্টদের সাথে মত বিনিময় করে এই শিল্প সেক্টরের পরিবেশ দূষন নিরোধে অংশগ্রহন করছেন। আর আমাদের দেশে! ব্রিটিশদের অপশাসন মুক্ত হয়েছি সেই পৈনে এক'শ বছর হোল। কিন্তু ব্রিটিশ ডেপুটিদের রেখে যাওয়া সেই বুটেড স্যুটেড রাজ কর্মচারীর গাউনটা আমরা এখনো ঝেড়ে ফেলতে পারিনি। এখনও লক্ষ্য করি সরকারী কর্মচারীদের সেই কলার উঁচু করে চলার মন মানসিকতা। চেয়ার চেম্বার আর দশটা পাঁচটা ছাড়া তাদের আর কি কোন কাজ নেই? কিংবা নোটিশ দেয়া, বর্ধিত করা, অনুমোদন দেয়া কিংবা সার্কুলার জারি করাই কি তাদের মূল কাজ।
সুতরাং ভাবতে হবে এবং নিজের জন্যই সবাইকে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। আজকে দেশে যে কৃষি বিপ্লব ঘটেছে তা কিন্তু এমনি এমনিই হয়নি। পাশাপাশি সব কর্নার থেকে সহযোগিতার সদিচ্ছায় যদি আমরা দেশ গড়ার মানসিকতায় এগিয়ে আসি তবেই বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা বিনির্মানে আমাদের অগ্রযাত্রায় সুফল বয়ে আনবে - এতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই।
(লেখক একজন চামড়া শিল্প বিশেষজ্ঞ)