জালাল উদ্দিন আহমেদ
যে কথা বলতে নেই
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ২০ সেপ্টেম্বর,সোমবার,২০২১ | আপডেট: ০৬:৫১ এএম, ১৯ ডিসেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
আমরা যে কতবড় দুর্ভাগা তা আমরা নিজেরাই জানিনা। ধর্ম করি, কর্ম করি, সমাজ করি, রাষ্ট্র করি। সবকিছুই আমরা আমাদের সুনির্দিষ্ট গন্ডির মধ্যে আবদ্ধ রেখেই করি। এই ধর্মের কথাই ধরুন না। দু'পাঁচটা সুরা মুখস্ত, কতকগুলো ছোটবড় দোয়া। ব্যাশ! এই দিয়েই তো চলছে আমাদের ধর্মের প্রাথমিক বাধ্যবাধকতার পর্বটি। কিন্তু আমরা জানিনা সে সবের অর্থ। ব্যাখ্যা তো দূরের কথা। তারপরে ধরুন এই যে নামাজ কায়েম করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু আমরা তো পড়ি। স্রেফ মুখস্ত বিদ্যার চর্চা। স্কুলের মাস্টার মশাই বা মৌলভি ওস্তাদের কাছে যেমন গড়গড় করে মুখস্ত বলে পার পেয়ে যেতাম ঠিক সেরকমই বটে আমাদের নামাজ রোজা বা অন্যান্য এবাদতগুলি। অন্যান্য ধর্মের কথা বেশী জানা নেই বিধায় ও সম্পর্কে খুব বেশী আলোচনা করার স্পেস এখানে নেই। মৌলভী সাহেবেরা যে ওয়াজ তাফসির ইত্যাদির বয়ান করেন তা কোরান হাদিসের সাযুজ্যে কতটুকু স্বতঃসিদ্ধ তা মিলিয়ে নেয়ার অক্ষমতা আমাদের শতভাগ। বন্ধুরা বা মুরুব্বীরা তাগিদ দেয় কোরান শিখ। আরবী শিখ। কিন্তু ওই শেখার মধ্যে কি আছে! শুধু হরফগুলি চিনে কোরান পড়া কি উদ্দেশ্য হওয়া উচিত? আর সহিভাবে বা শুদ্ধভাবে পড়া! সেতো দিল্লি হনুস্ত দূর! উচ্চারনের দ্ব্যার্থতায় যেখানে অর্থটাই উল্টে যায় সেখানে কিভাবে আমাদের ধর্ম চর্চা এগোবে? সেক্ষেত্রে ভাষাগত বুৎপত্তি ও ব্যাকরন জানা না থাকলে কোরান পড়ার যথার্থতা কোথায়? আমি তো বলি এক্ষেত্রে ৯০%ই আমরা ব-কলম। শুধু পড়লে কি হবে? গ্রামের যে কৃষক ছোটবেলায় কায়দা আমপারা পড়ে কোরান পড়া শিখেছেন তিনি কতটুকু জেনেছেন কোরানের বার্তাগুলি! যে পল্লীবধু ছোটবেলায় হুজুরের কাছে আলিফ বা তা শিখে কোরান পড়া ধরেছেন বা কোরান খতম করেছেন, তিনি কি জানেন তিনি কি পড়েছেন। বরং এটা কি সহি হোত না যদি শিক্ষিত আলেমরা প্রতি জু'মায় সেই চৌদ্দ'শ বছর আগেকার কাহিনীর রেকর্ড বার বার না বাজিয়ে অন্ততঃ নামাজের ছোট ছোট সুরাগুলির উচ্চারনসহ বাংলা অর্থ বয়ান করতেন। বিষয়টি যদি প্রতি জু'মায় অন্ততঃ আট সপ্তাহের টার্গেট নিয়ে ইমাম সাহেবরা করেন তাহলে মুস্ললিদের মধ্যে নামাজ ও ইসলাম চর্চার স্বতঃস্ফুর্তিতা অনেকাংশে বৃদ্ধি পাবে বলে আমি মনে করি।
যাক, আমার আজকের বিষয় কিন্তু ধর্ম নিয়ে নয়। ধর্মীয় চেতনার কোন মৌলিক বিষয়ও আমার প্রতিপাদ্য নয়। কিন্তু যখনই কিছু লিখি বা লেখার জন্য বসি তখন ধর্মীয় বিধি বিধানের আলোচনাগুলি সামনে চলে আসে। ছোটবেলা হতে জেনে এসেছি বাবা আদম ও মা হাওয়ার “গন্ধম” ফল খাওয়ার কাহিনী। তারপরে তাঁদের অভিশপ্ত হওয়ার কাহিনীগুলোও জেনেছি। কিন্তু গন্ধম ফলটি কি তা কিন্তু জানতে পারিনি। গত সপ্তাহে সোলেমানিয়া বুক হাউসের “ আল কোরানের শ্রেষ্ঠ কাহিনী” ( লেখক অধ্যাপক আবু তৈয়ব মোহাম্মদ সাদিকুল্লাহ) গ্রন্থটি দ্বিতীয়বার পড়লাম। পড়ার সময় এক স্থানে গিয়ে বার বার থেমে যাই। আবার পড়ি, আবার বুঝার চেষ্টা করি। কিন্তু মগজে ঢুকতে চায় না। এই পুস্তকে এক জায়গায় বলা হয়েছে 'যখন ওই ফল খেয়ে তিনি অভিশপ্ত হলেন তখন সাথে সাথে তার গায়ের বস্ত্র খুলে গেল। তিনি বিবস্ত্র হয়ে স্বর্গের মধ্যে ছুটাছুটি করেছেন নিজের আব্রু ঢাকার জন্য। অবশেষে তারা দুজনে ডুমুর পাতা দিয়ে নিজেদের লজ্জা নিবারন করলেন। পরের প্যারায় বলা আছে আল্লাহ তায়ালা আদম(আঃ)কে ওই গাছ সম্পর্কে একথাও বলেছিলেন যে ওই গাছের কাছে যেও না। ওই গাছের ফল, পাতা, কান্ড কিছুই খাবে না। কিন্তু বাবা আদম সেই কথাটি ভুলে গিয়েছিলেন । সেক্ষেত্রে বাবা আদম ও মা হাওয়াকে স্বর্গে রাখলেও মহান সৃষ্টিকর্তা তাদের মধ্যে যে মনুষ্য প্রবৃত্তির রিপুগুলি ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন তার প্রতিফলন আমরা সেই কথিত গন্ধম ফল ভক্ষনের বিষয় থেকেই উপলব্ধি করতে পারি। তবে লিখিত পুস্তকের এই বাক্য থেকে আমরা গন্ধম ফল সম্পর্কে কিছুই জানতে পারলাম না। প্রথমে ভুল করে ওই ডুমুর ফলকেই গন্ধম ভেবে নিয়ে কলম ধরেছিলাম। কিন্তু গন্ধম ফল খাওয়া ইত্যাদি অনেক উচ্চ মার্গের পর্যায়ে পড়ে বিধায় সেই ডুমুর ফলে পাক ধরিয়েও আর পাকাতে পারলাম না।
যাহোক যেসব বিষয়বস্তু সামনে রেখে আমার এই গদ্য লেখার সুত্রপাত তা কিন্তু খুব সহজ একটি বিষয় নয়। সেজন্যই হয়তো এত লম্বা উপক্রমনিকার আশ্রয় নিতে হোল আমাকে। ধর্মীয় সামাজিক এমনকি রাষ্ট্রীয় আচার আচরনে যে ছয়টি শব্দ ছয় টনি পাথর হয়ে প্রতিটি মানুষের অস্থি মাংসে মিশে আছে তা নিয়েই আমার আজকের কথকতা। বিষয়টি হচ্ছে ষড়রিপু বা ছয় শত্রু। প্রতিটি মানুষের অস্তিত্বে এই ছয়টি কাঁটা বা শত্রু সব সময় কিলবিল করতে থাকে। কিন্তু মানুষ তার বিবেক বুদ্ধি বিচক্ষনতা ও আত্মনিয়ন্ত্রনের মাধ্যমে এই ষড়রিপুর মোকাবিলায় এগিয়ে চলে। ন্যায় অন্যায় ভাল মন্দ ধর্ম অধর্ম বিচার বিশ্লেষন করার ক্ষমতাই হচ্ছে বিবেক। পারিপার্শ্বিক জীবন ও জগতের যাবতীয় ক্রিয়াকলাপে খাপ খাইয়ে নেয়ার বিজ্ঞান সম্মত ক্ষমতা ও দক্ষতাই হচ্ছে বুদ্ধি। পরিবেশ পরিস্থিতির আলোকে সব কিছুকে আত্মস্থ করার অর্থই হচ্ছে বিচক্ষনতা। আর সংযম, সংযত, শৃংখলা ও জীবন বোধের সম্মিলিত নিয়ন্ত্রনের আত্মকেন্দ্রিকতাই হচ্ছে আত্মনিয়ন্ত্রন। লক্ষনীয়ভাবে সত্য যে কথিত এই সূচকগুলি যে সমস্ত কারনে বাধাগ্রস্থ হয়ে মানব জীবন, সমাজ ও রাষ্ট্র ক্ষেত্রে শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থার সৃষ্টি করে সেই কারনগুলিই হচ্ছে ষড়রিপু। যার সুত্রপাত কিন্তু ঐ স্বর্গে অবস্থানরত মানব জাতির আদি পিতা ও মাতার নিষিদ্ধ ফল ফল খাওয়া থেকেই শুরু হয়েছিল। কারন ইবলিশ শয়তান সে সময় মানব জাতির আদি পিতাকে স্বর্গের চিরস্থায়ী সুখ স্বাচ্ছন্দের “লোভ” দেখিয়েই তাঁকে পথভ্রষ্ট করেছিল। এই লোভ ষড়রিপুর একটি অংশ। এক্ষেত্রে ষড়রিপুর “মোহ” বা “কাম”ও এখানে প্রযোজ্য হতে পারে। মাথাওয়ালা আলেমরা বোধ হয় এব্যাপারে ভালই বলতে পারবেন। ষড়রিপুর বিষাক্ত ছোবলের এতই তেজ যে আমাদের অজান্তেই আমরা এর দ্বারা এমনভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ি যে তখন আত্মীয় পরিজন, প্রতিবেশী, সমাজ এমনকি রাষ্ট্রের ক্ষতি সাধনেও আমরা দ্বিধা করিনা।
যে ষড়রিপু বা ছয়টি প্রতিবন্ধকতা মানব জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে তা হোল – কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ ও মাৎসর্য। এই শব্দ চয়নগুলি পৌরানিক। বিভিন্ন কাহিনী ও কল্পকথা দিয়ে এর ব্যাখ্যা করা হয়েছে। সাধারনভাবে শিক্ষালাভ করে আমরা এ সমন্ধে যতটুকু জেনেছি তাতে এই ষড়রিপুর শব্দ চয়ন ও ব্যাখ্যাগুলো সংস্কৃত সংস্কৃতির পরম্পরা বলেই মনে হয়। কারন এই শব্দ সমূহ সংস্কৃত তৎসম শব্দ ভান্ডার হতে প্রসূত। ধর্মীয় ব্যাখ্যায় না গিয়েও বলা যায়, প্রতিটি ধর্মের বেসিক স্টাকচারে এই ষড়রিপুর অনিষ্টকারী ফলাফল সমন্ধে সম্যক ধারনা দেয়া আছে এবং ধর্ম শিক্ষায় তা অন্তর্ভুক্ত আছে বলে মনে করার যথেষ্ট কারনও রয়েছে।
কাম অর্থ হচ্ছে শারিরীকভাবে মিলিত হওয়ার অনিয়ন্ত্রিত ইচ্ছা বা আকাংখা। প্রানী মাত্রেই কামুক। এই কামুকতা যখন বহু গমনে সিদ্ধ হতে চায় তখনই এটাকে মানব জীবনের কন্টক বা শত্রু হিসাবে গন্য করা হয়। এতে পারিবারিক সামাজিক ও ব্যক্তিজীবনে অশান্তি বয়ে আনে। অবিশ্বাস অপমান ও লাঞ্চনায় তখন ব্যক্তি মানুষ সমাজে চরিত্রহীন হিসাবে বিবেচিত হয়। তার কামুক চরিত্রের বৈশিষ্ঠ্যে সে তখন সমাজে ধিকৃত হয়।
ক্রোধ হচ্ছে রাগ। মনুষ্য চরিত্রে রাগ থাকবে এটা স্বাভাবিক। কিন্তু এই রাগ বা ক্রোধ যখন গর্জনে রূপান্তরিত হয় তখন মানুষ প্রতিষোধের আগুনে অন্ধ হয়ে যায়। ফলে হানাহানি হিংসা দ্বেষ ইত্যাদির প্রকোপে সমাজ সংসারে অনাচারের সুত্রপাত হয়।
অপ্রাপ্ত বস্তুকে প্রাপ্তির প্রবল ইচ্ছা কিংবা অতৃপ্ত মনোস্কামনায় তৃপ্ত হওয়ার অসম ইচ্ছার নাম হোল লোভ। এ থেকে মানুষের বিবেক বুদ্ধির লোপ পায়। আত্মনিয়ন্ত্রন ক্ষমতা ও সৎবুদ্ধির বিনাশ ঘটে। ফলে সেই লোভাতুর স্বপ্নচারিতায় সংসার সমাজে সর্বনাশ ডেকে আনে।
মোহ এমন এক বিষয় যা থেকে মুক্ত হতে না পারলে ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে সর্বনাশের মাত্রা বেড়েই চলে। অর্থ সম্পদের মোহ, পরস্ত্রীতে মোহ, রূপের মোহ, নেশার মোহ ইত্যাদি ইত্যাদি। অর্থাৎ অলীক স্বপ্নের বিষয়টিকে বাস্তবতায় চিন্তা করলেই তা মোহের পর্যায়ে পড়ে।
কাম, ক্রোধ ও লোভের মাত্রাতিরিক্ত বহিঃপ্রকাশের অপর নাম হচ্ছে মদ বা অহংকার। আমরা জেনেছি অহংকার পতনেরমূল। এই মদ বা অহংকার মানুষকে ধংসের দিকে নিয়ে যায়।
মাৎসর্য বা হিংসা হচ্ছে এমন এক রিপু যা মানব জীবনে ধংসাত্মক রূপ নিয়ে প্রকাশিত হয়। পরশ্রীকাতরতা, ঈর্ষা, অনিষ্ট করার বদচিন্তা ইত্যাদির অনুপ্রবেশে মানব জীবনে অশান্তি ছাড়া আর কিছুই দিতে পারেনা এই মাৎসর্য।
সুতরাং জীবনে চলার পথে উল্লিখিত রিপু বা প্রতিবন্ধকতা গুলি পরিহার করার জন্য মানব সমাজকে ধর্মীয় তথা মানবতার শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ করতে হবে। প্রতিটি ধর্মে এবং তাদের ধর্মগ্রন্থে এই সকল জীবন দর্শনের কন্টকময় উপাদান হতে নিয়ন্ত্রিত হওয়ার উপদেশ দেয়া আছে। সেক্ষেত্রে আমাদের সকলের উচিত কাম-ক্রোধ-লোভ-মোহ-মদ-মাৎসর্যকে নিয়ন্ত্রন করে জীবনের শান্তি ও সমৃদ্ধির সঠিক পথ অনুসরন করা। প্রতিটি ক্ষেত্রেই স্রষ্টাকে স্মরন রেখে পরিচ্ছন্ন জীবনবোধে এগিয়ে চললে কোন বাধাই আমাদের প্রতিবন্ধক হতে পারবে না বলে আমাদের বিশ্বাস রাখা উচিত।