জালাল উদ্দিন আহমেদ
স্যার(Sir)
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ৪ সেপ্টেম্বর,শনিবার,২০২১ | আপডেট: ০১:১৯ এএম, ১৯ ডিসেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
সম্মান সূচক শব্দ হচ্ছে স্যার। এটি একটি ইংরেজী শব্দ। সাধারনতঃ সম্মানিত ব্যক্তিদেরকে সম্মান প্রদর্শন পূর্বক এই উচ্চারনে সম্বোধন করা হয়। মালিক বা কর্তৃপক্ষকে সম্মান সূচক এই সুবচনে সম্বোধন করা হোত বা হয়। পৃথিবীর সবখানেই এই স্যার ডাকের প্রচলন আছে তবে প্রায়োগিক ক্ষেত্রে ভিন্নতার দাবি রেখে। একজন সাধারন মানুষকে স্যার বলে ডাকার রেওয়াজ অনেক ক্ষেত্রেই লক্ষ্য করা যায় এবং তার যৌক্তিকতাও আছে। তবে এই স্যার ডাকের বা সম্বোধনের প্রায়োগিক চাপ আমাদের এই ভারতীয় উপমহাদেশে খুব বেশী লক্ষ্য করা যায়। আর হবেই বা না কেন! বৃটিশ কলোনিয়াল লিগ্যসির (colonial legacy) উত্তরাধিকারী হিসাবে এই বোঝাটুকু তো আমাদেরকে বইতেই হবে।
Sir শব্দটি এসেছে sire থেকে। এটি একটি প্রচীন শব্দ। প্রাচীনকালে রাজা মহারাজাদের প্রভু বা স্যায়ার(sire)বলে সম্বোধন করা হোত। এই স্যার কথাটির উৎপত্তি সম্ভবতঃ বৃটিশ রাজতন্ত্রের হেঁসেল থেকে। রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা লাভের পর শাসক শ্রেনী যখন দেখলো তাদের সাম্রাজ্য সুচারুরূপে পরিচালনার জন্য প্রভু ভক্ত কর্মঠ এবং উদ্যমী কর্মচারী দরকার তখন রানীর অধ্যাদেশ দিয়ে তারা এই স্যার উপাধিটি চালু করলো। ইংল্যান্ডে নিম্নতম অভিজাত বংশের লোকজন ব্যারন(Baron)এবং তাদের ঠিক নিম্নতম বংশগত সম্প্রদায়ের নাম ব্যারোনেট(baronet)। ব্যারোনেটদের প্রভু ভক্তি ও কাজের নিষ্ঠা বিচারের সন্তুষ্টিতে রাণীর পক্ষ থেকে ওই সম্প্রদায়ের কর্মচারীদেরকে knight (নাইট) উপাধি দেয়া হোত। তখন তাদেরকে Sir বলে সম্বোধন করার রেওয়াজ চালু হয়েছিল যা কমনওয়েলথ ভুক্ত দেশ সমূহে এখনো চালু রয়েছে। ইদানীং লক্ষ্য করা যায় বৃটিশ কলোনিয়াল দেশ অর্থাৎ কমনওয়েলথ ভুক্ত দেশ সমূহে স্যার নামের এই সম্মানিত উপাধিটি বিভিন্ন সামাজিক রাষ্ট্রীয় ইত্যাদি ক্ষেত্রে অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ দেয়া হয়। সমাজ তথা রাষ্ট্রে মর্যাদা পুর্ন কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ ব্যক্তি বিশেষকে নাইট (knight) উপাধি দেয়ার মাধ্যমে তাদের স্যার ডাকের মর্যাদাটি নিশ্চিত করা হয়। সাম্প্রতিক সময়ে ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা জনাব ফজলে হাসান আবেদ তার প্রকৃষ্ট উদাহারন। ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠালগ্ন হতে অদ্যাবধি সমাজ সংস্কার মূলক বিভিন্ন জনকল্যানে এই এনজিওটি বাংলাদেশসহ এশিয়া ও আফ্রিকার বহু দেশে তাদের সেবাধর্মী কাজে আজ প্রশংসিত। তবে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সেরকম না পাওয়া গেলেও বৃটিশ সরকার খান বাহাদূর বা রায় বাহাদুর কিংবা তারও নিম্ন পর্যায়ে খান সাহেব বা রায় সাহেব নামের উপাধিগুলো ভারতবর্ষে প্রচলন করেছিল বিভিন্ন সামাজিক ও অর্থনৈতিক স্বীকৃতির সম্মান সূচক উপাধি হিসাবে।
স্যার শব্দটির বহুল প্রচলন দেখা যায় শিক্ষাক্ষেত্রে। শিক্ষক একটি সম্মানিত পদ। এই পদবীর অধিকারীগন সামাজিকভাবেও অধিকতর সম্মানিত। সুতরাং স্যার ডাকের যথার্থতায় শিক্ষক সর্বক্ষেত্রেই গ্রহনযোগ্য। একজন ছাত্র যেমন শিক্ষককে স্যার বলে সম্বোধন করে তেমনি ছাত্রের অভিভাবকও শিক্ষককে স্যার বলে সম্মানিত করেন। সমাজের অধিপতি কিংবা আইন প্রণেতা থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের কর্ণধারও শিক্ষককে স্যার বলেই সম্বোধন করেন। অর্থাৎ স্যার ডাকের সার্বজনীনতায় শিক্ষক একটি যথার্থ পদ বা পদবী। প্রকৃতপক্ষে “স্যার” সম্বোধনটি হচ্ছে সম্মান ও সমীহ করার একটি প্রাথমিক উচ্চারন। এটার ব্যাপ্তি শিক্ষাক্ষেত্রে আবশ্যিকভাবে বহুল প্রচারিত।
কলোনিয়াল লিগ্যাসির দেশগুলিতে এই স্যার শব্দটি প্রচলনের ব্যাপকতা লক্ষ্য করার মত। অফিস আদালত ও কার্যক্ষেত্রের মাঠে ঘাটে এই স্যার শব্দটি ব্যাপকভাবে উচ্চারিত হয়ে থাকে। সরকারী অফিসে এর কঠোর প্রয়োগ সত্যিকার অর্থেই একজন নবীন কর্মচারীর বিকশিত হওয়ার ক্ষেত্রে অন্তরায় বটে। বলা হয়ে থাকে যদি এই স্যার বা ইয়েস স্যারের ডিসিপ্লিন অফিস আদালতে না থাকে তাহলে কাজের সুষ্ঠতা ও চেইন অব কমান্ড থাকে না। অর্থাৎ ভাব গাম্ভীর্য পরিবেশের স্যুটেড বুটেড এবং ইয়েস স্যার শব্দটাই সরকারী অফিস অধিদপ্তরের শৃঙখলা অটুট রাখার একটি সুত্র হিসাবে ধরে নিয়েই এই উপমহাদেশের পথচলা। মানতেই হয়। কিন্তু একজন সেবা গ্রহনকারী প্রার্থী বা একদল জেলে কিংবা কৃষক তাদের নিজস্ব বাঁচার তাগিদের একটি সরকারী নির্দেশ বা প্রজ্ঞাপন নেয়ার জন্য যখন মাঠ পর্যায়ের কোন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মচারীর অফিস চত্তরে পিওন আর্দালী থেকে শুরু করে ছোটবাবু বড়বাবুদের “স্যার স্যার” বলে মুখে ফেনা তুলেও শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত চার দেয়ালের প্রকোষ্ঠে তাদের ব্যক্তিগত বা জন দাবির উচ্চারনটা পৌঁছাতে পারেনা -তখন স্বাভাবিক ভাবেই সেই “স্যার” শব্দটি তখন “সাহারে” পরিনত হয়ে “আন্ঠাই কান্ঠাই” মুখ থুবড়ে পড়ে। ( সাহার অর্থ আবর্জনা থেকে তৈরী সার। আন্ঠা কান্ঠা অর্থ অলিগলি। এটা রাঢ় এলাকার প্রচলিত শব্দ)। এক্ষেত্রে স্যার যখন অফিস কাঠামোর নিজস্ব কায়দা কানুনের শৃঙখলা তৈরীর হাতিয়ার, তখন কোন দুঃখে ওই ডাকে জন মানুষ সরকারী কর্মচারীদের স্যার ডাকের আহাজারিতে নিজেদের অস্তিত্বের গায়ে কুঠারাঘাত করবে বলতে পারেন?
ইদানীং “স্যার” ডাকের আদব লেহাজ নিয়েও বেশ কথাবার্তা হচ্ছে। বিশেষ করে সরকারী কর্মক্ষেত্রের মাঠ পর্যায়ের জেলা উপজেলা বা অন্যান্য বিভাগের ক্ষমতা প্রাপ্ত কর্মচারীরা “স্যার” ডাকের এই মধুর বচনটি শোনার জন্য উদগ্রীব থাকেন বলে শোনা যায়। সত্যিকার অর্থে স্যার ডাকটি সম্মান ও সমীহের প্রতিফলন। একজন সরকারী কর্মচারীকে কোন্ বাধ্য বাধকতায় সাধারন জনমানুষ স্যার বলে সম্বোধন করবেন এটা মাথায় আসতে চায় না। আর কর্মচারী বলা হোল এই কারনে যে প্রজাতন্ত্রের সংবিধানের ২১ অনুচ্ছেদে গন কর্মচারী আধ্যদেশের আলোকে ২০১৮ এর সরকারী চাকুরী বিধির প্রথম অধ্যায়ের ১৬ অনুচ্ছেদে “সরকারী কর্মচারী” বলা হয়েছে। সেখানে “কর্মকর্তা” বলে কোন শব্দ আছে বলে আমার চোখে পড়ে নি। সুতরাং সংবিধানের ২১ অনুচ্ছেদ এর আলোকে সরকারী কর্মচারীদের সবাই “কর্মচারী”। সেখানে কর্মকর্তা শব্দটি নেই। তবে স্যার হচ্ছে সম্মানের ডাক। এটা সাধারন মানুষ স্বতঃস্ফুর্তভাবেই তা করেন। এতে দোষের কিছু নেই। এখানে জোর জবর দস্তির কোন সুযোগ নেই। কিন্তু কেউ যদি ভাবেন আমি কর্মকর্তা, জনগনের প্রভু - তাকে সম্মান করে স্যার বলে ডাকতে হবে। সর্বনাশটা সেখানেই। কর্মচারীর মানসিক সমস্যা। শোনা যায়, ইদানীংকালে অফিসের কেরানী বাবুরাও স্যার ডাকের অপেক্ষায় উদগ্রীব থাকেন। অনেকে উষ্মাও প্রকাশ করেন। কিন্তু তাদের বুনিয়াদী প্রশিক্ষন কি দেয়া হয়না? চাকুরী বিধির আওতায় প্রতিটি কর্মচারীকে foundation training দেয়া হয়। সুতরাং তিনি জানেন, তিনি একজন গন কর্মচারী(public servant) বা জনগনের সেবক।
একজন বয়োজ্যেষ্ঠ শিক্ষক কিংবা সাংবাদিক অথবা মাঠ পর্যায়ের জন প্রতিনিধি যদি সরকারী কর্মস্থলে গিয়ে সেখানকার কর্মচারীদের মি. অমুক বা জনাব তমুক বলে সম্বোধন করেন সেটা কি দোষের? সেক্ষেত্রে কেউ যদি কি হনুরে ভেবে জনগনের প্রভুর ভুমিকায় অবতীর্ন হতে চান এবং এসব নিয়ে হৈচৈ বাঁধিয়ে দেন, সেটা কি আদৌও সমীচিন? সেক্ষেত্রে ওই কর্মচারীটি ওই পদের যোগ্য কিনা তা ভেবে দেখা দরকার বৈকি! এটা একটা হীনমন্যতা। কলোনিয়াল লিগ্যাসির উত্তরাধিকারীয় চিন্তাধারা। বরং জনগনের উচিত সরকারী কর্মচারীদের নাম ধরে ডাকা। কারন জনগনই যখন সকল ক্ষমতার উৎস তখন জনগন কেন তাদের কর্মচারীদের sir বলে ডাকবেন! বরং কর্মচারীরাই জনগনকে sir বলে ডাকবেন - এটাই রেওয়াজ বা রীতি হওয়া উচিত নয় কি? কলোনিয়াল লিগ্যাসির উত্তরাধিকারীয় লেবাস যত তাড়াতাড়ি গা থেকে ঝেড়ে ফেলা যায় ততই মঙ্গল।