জালাল উদ্দিন আহমেদ
খেলা নিয়ে যত কথা
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ২৭ আগস্ট,শুক্রবার,২০২১ | আপডেট: ০৬:৫১ এএম, ১৯ ডিসেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
কেন এমন হচ্ছে জানিনা। এরকম তো হওয়ার কথা নয়। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে সবকিছু এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এই আঙ্গিনায় আমাদের পশ্চাদপদতার কারন কি? কেন প্রতিটি ইভেন্টেই আমরা আজ আন্ডারডগ হয়ে বিচরন করছি। খেলাধুলার অবনমনের কথকতা নিয়েই আমাদের আজকের আলোচনা। সত্তর দশকে এমনকি আশির দশকেও এই মুল্যায়নে আমাদের ক্রীড়া জগতের বিচরন কল্পনাতীত ছিল। আমাদের সঙ্গে ফুটবল হকি হাডুডু খেলার জন্য শুধু দক্ষিন এশিয়া কেন, সমগ্র এশিয়া গোলার্ধের অন্যান্য দেশ সমূহ উন্মুখ হয়ে থাকতো। আমরা হয়তো বিশ্ব বা এশীয় মানদন্ডে অত নাম ডাকওয়ালা খেলুড়ে দেশ ছিলাম না। কিন্তু খেলা খেলোয়াড় ও সংগঠকেরা ছিলেন উন্নত মানের। এইতো ক'দিন আগেও ভারত পাকিস্থান কোরিয়া থাইল্যান্ড আমাদের যেকোন টুর্ণামেন্টে কিংবা দ্বিপাক্ষিক খেলা আয়োজনে উন্মুখ হয়ে থাকতো। আমরা দেখেছি এশীয় পর্যায়ে ফুটবল হকি ভলিবল হাডুডু ইত্যাদি খেলা আয়োজনে আমাদের সেই উজ্জ্বল দিনগুলি।। মনে পড়ে ফুটবলের আগাখান গোল্ডকাপ কিংবা প্রেসিডেন্ড কাপ ফুটবলের সেই জৌলুষতা। দেখেছি এশীয় মানের সেই নামডাক ওয়ালা সালাহ উদ্দিন, হাফিজ উদ্দিন, এনায়েত, সালাম, আসলাম কিংবা কায়সার হামিদ, নান্নু, মুন্নাদের মত ডাক সাইটে ফুটবলার। এদের সঙ্গে খেলার জন্য কিংবা নিজ দেশে এদেরকে নিয়ে খেলানোর জন্য এশীয় মাইনর থেকে শুরু করে দক্ষিন পুর্ব এশিয়ার অনেক দেশ তাকিয়ে থাকতো। আবার হকির পাকিস্থানী এসেন্সের উত্তরসূরী হিসাবে বাংলাদেশের হকি খেলাতেও ছিল আলাদা আভিজাত্য। ভারত পাকিস্থান কোরিয়ার সঙ্গে নিয়মিত হকি টুর্নামেন্টে বাংলাদেশ অংশগ্রহন করতো। হাডুডু তো ছিল এশীয় সেরা। যার জন্য সুর্যোদয়ের প্রথম প্রহরে বাংলাদেশকে একবারও ভাবতে হয় এই হাডুডুকে জাতীয় খেলার মর্যাদা দিতে। আর ভলিবলেও আমাদের উদীয়মানতা চোখে পড়ার মতই ছিল। নিজে ভলিবল খেলোয়াড় ছিলাম বলে বলছিনা, সে সময় অর্থাৎ আশির দশকের প্রথম দিকে আমাদের একঝাঁক উদীয়মান খেলোয়াড় ছিল। মনে পড়ে মোহাম্মদপুরে আমরা একটি ক্লাব তৈরী করেছিলাম অনির্বান যুব সংঘ নাম দিয়ে। আমাদের দলনেতা ছিলেন ইতিভাই। অর্থাৎ হাসানুজ্জামান ইতি। জাতীয় নেতা এ এইচ এম কামরুজ্জামানের ছোট ভাই। ট্রেনার ছিলেন কামাল ভাই। সেই ক্লাব এখন আছে কিনা জানি না। তবে খেলা যে নেই তা চোখ বন্ধ করে বলা যায়। আমরা মূলতঃ ভলিবল খেলেই আমাদের মুখ তৈরী করতে পেরেছিলাম। সেইসুত্রে ভলিবল প্রথম বিভাগ লীগেও জীবন বীমার হয়ে খেলেছিলাম বলে মনে পড়ে। ক্লাবের নামে ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় খেলা হোত। এমনকি কুর্মিটোলা ক্যান্টমেন্টেও আমরা সে সময় সেনাবাহিনী টিমের সাথে খেলেছি। আমাদের সঙ্গের সুব্রত পেশার হিসাবে নাম করেছিল। পরে ও জাতীয় দলেও সুযোগ করে নিয়েছিল। মনে পড়ে রাজশাহীর চুন্নুর কথা। ভলিবলে চুন্নু ভাল করেছিল। যাহোক, অতীত ঐতিহ্যের অনেক গল্পই হয়তো আজকের প্রজন্মের জানা নেই। থাকার কথাও নয়। কারন সামষ্টিক অর্থে তা ধরে রাখার মানসিকতায় এখনকার সংগঠকদের সেই মন মানসিকতা, সক্ষমতা কিংবা দক্ষতার অভাব রয়েছে বলেই অনুমান করা যায়। যে উৎসাহ ও উদ্দীপনায় নতুন সুর্যোদয়ে একটি জাতির ক্রীড়াঙ্গনে বিকশিত হওয়ার গল্প লেখা শুরু হয়েছিল, মধ্যাহ্নের সেইসব দিনগুলিতে ভিন্নধর্মী মাফিয়া চক্রের কবলে আজ তা স্তিমিত হওয়ার দ্বারপ্রান্তে। সেদিনের সংগঠকদের বিশুদ্ধ সাংগঠনিক দক্ষতা, খেলোয়াড়দের খেলোয়াড়ি উৎকর্ষতায় বেড়ে উঠার উদগ্রতা কিংবা খেলার উঠানের শুভ্রতা; আজকের দিনের বাংলার ক্রীড়াঙ্গনের উঠানে আছে কি? আজকের দিনে খেলায় অংশ গ্রহন করা ছাড়া আলো ছড়ানোর কোন প্রাপ্তি কি আমাদের ক্রীড়াঙ্গনে আছে?
বাঙালীর খেলা বলতে আমরা শুধু ফুটবল,হকি, ভলিবল, হাডুডু, সাঁতার কিংবা দৌড়-ঝাঁপ এগুলোকেই সামনে আনি। কিন্তু সব খেলার মাথার মনি হিসাবে আজকের দিনে যে খেলাটি আপামর বাঙালীকে মন্ত্রমুগ্ধের মত আঁকড়ে ধরেছে তা হলো ক্রিকেট। বৃটিশ বেনিয়াদের শখের খেলা এই ক্রিকেট এখন বাঙালীর সুখ দুঃখের সাথী হয়ে বিশ্ব মঞ্চ কাঁপাচ্ছে। কিন্তু আশি নব্বইয়ের দশকে এই ক্রিকেট খেলা ছিল অভিজাত শ্রেনীর খেলা। সীমিত পরিসরে একটি শ্রেনীর মধ্যেই গন্ডিভূত ছিল এই ক্রিকেট। আজকের দিনে আপন উজ্জ্বলতায় ভাস্মর রকিবুল হাসান, ইউসুফ বাবু বা দিপু চৌধুরী,রুমি,মুনিররা ছিলেন সেদিনের হাতে গোনা কয়েকটি ক্রিকেট মুখ। কিন্তু ফুলবল, হকি,কাবাডি ছিল বহুল প্রচলিত খেলা। সেক্ষেত্রে ফুটবলের ব্যাপকতা চোখে পড়ার মত। সে সময়ের ফুটবলীয় ক্রেজ তরুন যুবাদের মোহাচ্ছন্ন করে রেখেছিল। বাংলার সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা ছিল ফুটবল। তবে এখনো এই ফুটবল যে জনপ্রিয় তার ছিটেফোঁটা ঝলক মাঝেমধ্যে দেখা যায়। সেক্ষেত্রে সময় অর্থ ও মিডিয়ার কল্যানে এখনকার দিনে বাংলার সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা ক্রিকেট। একটা সময় ছিল যখন আমাদের স্টার ফুটবলাররা দেশীয় ভিত্তিক বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্রান্ড এম্ব্যাসেডর হতেন। সমাজে ক্রেজ হয়ে তরুন যুবাদের আইকন হয়ে বিচরন করতেন। এমনকি আমাদের ফুটবলাররা এশীয় পর্যায়ের মানদন্ডে স্থান পেতেন। স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল থেকে শুরু করে ফুটবলের সেই জাগরন আশির দশকের শেষ অব্দি আমাদের তৃপ্তির খোরাক যুগিয়েছে। আমরা সেই প্রতাপ, কায়কোবাদ, গফুর, সান্টু, হাফিজউদ্দিন, বাদল রায়, ওয়াসিম, নান্নুদের বা পরবর্তী প্রজন্মের সালাম, সাব্বির, আসলাম, কায়সার হামিদ, এনায়েতদের ভুলি কেমন করে। হাল আমলের ক্রেজ মুন্না, আরিফ খান জয়রাও তো কোন অংশে কম ছিল না।
গত শতাব্দীর শেষ দশকে ক্রীড়া জগতের গ্রাফ নিম্নমুখী হতে শুরু করে। রাজনীতির প্রতিপত্তি ও রঙ গায়ে চড়িয়ে যখন রাজনীতির আশীর্বাদপুষ্ট ক্রীড়া সংগঠকেরা খেলা জগতের আঙ্গিনায় নিজেদের আধিপত্য বিস্তারে মনোযোগী হন এবং উপর মহল থেকে পুর্ন সমর্থন নিয়ে সংগঠকের পরিবর্তে প্রশাসকের ভূমিকায় অবতীর্ন হন তখন খেলাধুলার মান নিম্নগামী হওয়া শুরু করে। রাজনীতির কলুষিত হাওয়া ক্রীড়াঙ্গনের বুনিয়াদী আবাহনকে ছত্রাখান করে আমাদের ক্রীড়া জগতের ঐতিহ্য ও সম্ভাবনাকে খাদের কিনারে নিয়ে আসে যার কলুষিত স্ফুরন এখনো এই একবিংশের বটতলায় দাঁড়িয়েও আমাদেরকে হজম করতে হয়। আমরা এখনো পাতানো খেলা, রেফারী বা আম্পায়ারদের চাপিয়ে দেয়া সিদ্ধান্তের মহড়ায় খেলার অপমৃত্যু দেখি। দেখি রাজনীতির দাপটে ক্লাব বা ফেডারেশন কর্তাদের আমির আভিজাত্যের চলন বলন। ইদানীং অবশ্য রাজনীতি ও টাকার অবাধ বিচরনে খেলাধুলাসহ সর্বক্ষেত্রেই এই নৈরাশ্যকর পরিবেশ পরিলক্ষিত হচ্ছে। খেলার মাঠ মাতিয়ে রাখা ফর্মের তুঙ্গে থাকা প্রথম সারির খেলোয়াড় যখন রাজনীতির পৃষ্ঠপোষকতায় এমপি মন্ত্রী হয়ে প্রকাশ্য হন তখন সেই ঘটনা ইত্যাদি নিয়ে মানুষজনের স্থানীয়ভাবে ক্ষনিকের তৃপ্তি এলেও, ম্রীয়মান ক্রীড়া জগতের কফিনে যে শেষ পেরেকটি ঠুকে দেয়া হয় তা কিন্তু বোদ্ধা জনেরা অনুমান করতে পারেন।
ক্রীড়াঙ্গনের মাফিয়া সংশ্লিষ্ঠতা ইদানীং টক অব দ্যা কান্ট্রি বললেও অত্যুক্তি হবে না। বছর তিরিশেক আগে যখন শুনতাম ক্লাবে তাস খেলা হয় তখন সেটাকে অবসরের উপাদান ভেবে স্বাভাবিক মনেই সবাই গ্রহন করতো। দশক পেরিয়ে যখন সেই তাস খেলায় লেনদেনের খবর ছড়ায় তখনও সেটা ততো গন্ধ ছড়ায় নি। তার এক দশকের মাথায় অর্থাৎ একবিংশের প্রথম দশকে যখন সেটা “ওয়ান টেন” বা সেই জাতীয় আরো দু-একটা খেলায় সাধারনের সম্পৃক্ততা টের পাওয়া যায় তখন সেটার বদ-গন্ধ তরুন যুবাদের মধ্যে ব্যাপকতা পায়। আর ইদানীংকার ক্লাবে ক্লাবে ক্যাসিনো কান্ডের যে ব্যাপকতা জন সম্মুখে প্রকাশ পেল তাতে করে খেলার ক্লাব না বলে সেগুলোকে ডালাসের ক্যাসিনো কমিউনিটি বললে অত্যুক্তি হবে কি? ঘেটে দেখলে উত্তর কিন্তু একটাই। রাজনীতির প্রবল প্রতাপশালী নেতা পাতি নেতাদের প্রচ্ছন্ন মদতেই এবং তাদের অংশগ্রহনে এসব অনৈতিক কর্মকান্ড আজ ক্রীড়া জগতের পবিত্র উঠানকে জুয়ার পীঠস্থান বানাতে সহায়ক হয়েছে।
টাকার ঝনঝনানি ও সংগঠকদের শক্ত কাঠামোর বজ্র আঁটুনি, সর্বোপরি আন্তর্জাতিক সংগঠনের তীক্ষ্ণ দৃষ্টির শাসনে থেকে আজ আমাদের ক্রিকেটীয় কাঠামো কিছুটা হলেও শিরদাঁড়া শক্ত করতে পেরেছে। ফলে আজকের দিনে আমরা বিশ্বসেরা সাকিব আল হাসান কিংবা মুশফিক তামিমদের পেয়ে গর্বিত হয়েছি। তবে ক্রিকেটের স্থানীয় কাঠামোর দৈনতা ও রাজনীতির দলবাজির প্রচ্ছন্ন ও প্রকাশিত আচরন বিষয়ক ইদানীংকার সংগঠকদের সর্বগ্রাসী অবস্থানের তিরোধানের উদ্যোগ না নিলে, এই অহমিকাও যে একদিন ফুটবল হকির দৈনতায় বিচরন করবে না তা হলফ করে বলা মুস্কিল।
আমরা বাঙালীরা খেলা পাগল জাতি। এই খেলা নিয়ে আমাদের আবেগ আছে, আছে উচ্ছ্বাসে ভরা স্মৃতি। যেসব খেলা নিয়ে আলোচনা করা হোল তা কিন্তু বাঙালীর আঁতুড় ঘরে সৃষ্ট খেলা নয়। গ্রাম বাংলায় ছড়িয়ে থাকা শত শত খেলা আমাদের ঐতিহ্যের অংশীদার। হাডুডু, কাবাডি থেকে শুরু করে গোল্লাছুট, দাড়িয়াবান্ধা, ডাংগুল্লি, ইচিং বিচিং, ওপেন টু বায়েস্কোপ, মার্বেল খেলা, নৌকা বাইচ, সাঁতার, লুডু, বউচি, মোরগ লড়াই, এক্কা দোক্কা, গোলাপ টগর, লাট্টু, কুতকুত, কড়ি খেলা – এগুলোই হচ্ছে আমাদের গ্রাম বাংলার প্রকৃত খেলা। তবে প্রকাশিত হওয়া ও প্রতিযোগিতার মানসে সৃষ্ট খেলা সমূহ যা সমাজ রাষ্ট্র ও জনপদে উৎসাহ উদ্দীপনা একতা ও এগিয়ে যাওয়ার মন্ত্র যোগায়, সেগুলোকে নিয়ে বিশুদ্ধ উচ্চারনের ক্ষেত্র তৈরীতে এগোতে হবে। সুশৃংখল জাতি গঠনে শিক্ষা সংস্কৃতি ও খেলাধুলার সুষম বিকাশ সর্বাগ্রে নিশ্চিত করা আমাদের সকলের দায়িত্ব ও কর্তব্যের মধ্যে পড়ে বৈকি!