জালাল উদ্দিন আহমেদ
লেখালেখি
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ২৯ জুলাই,বৃহস্পতিবার,২০২১ | আপডেট: ০৮:৫৯ পিএম, ১৪ ডিসেম্বর,শনিবার,২০২৪
যখন আপন দেশ, জনগন, রাষ্ট্রাচার, রাজনীতি ইত্যাদি নিয়ে লিখতে বসি; তখন কলমটা থেমে থেমে বলতে চায় আর এগিয়ো না। সর্বনাশা একচক্ষু দৈত্যগুলো তোমার চারপাশে সার্চ লাইট লাগিয়ে রেখেছে। অক্টোপাশের বাহুগুলি ছড়িয়ে ছিটিয়ে তোমার আশেপাশে কিলবিল করছে।। আর সেই প্রাণীটির দৈত্যকার চক্ষুগুলি সিসি ক্যামেরার প্যাগাসাস হয়ে তোমার হাতে পায়ে বেড়ি লাগিয়ে রেখেছে। এইসব অজানা আশংকাগুলো যখন আমার মন ও মননশীলতার খোলা দরজায় এসে একচক্ষু দৈত্য হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে তখন নাক মুখ দিয়ে বেয়ে আসা মনের অব্যক্ত উচ্চারনগুলি ফুস করে হতাশার পারদ ছড়িয়ে কান দিয়ে বেরিয়ে যায়। এরকম হাজারো অযাচিত নিগ্রহের অক্টোপাশে লেখা আর বলার মৌলিকতা আজ নুব্জ দেহে ধুকে ধুকে দিনাতিপাত করছে।
কি নিয়ে লিখবো বলুন। আসুন তাহলে দেশ নিয়ে এগোনোর চেষ্টা করি। প্রায় দেড় লক্ষ বর্গ কিলোমিটার ভূখন্ডের পূর্ব বাংলা ক্ষনকালের পূর্ব পাকিস্থান হয়ে এখন লাল সবুজের স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। একগুচ্ছ মহান নেতার পাদ প্রদীপের সংস্পর্শে থেকে নিজেকে আলোকিত করা সেই মানুষটি যখন সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালী হয়ে এই ভূখন্ডের ত্রাতার ভূমিকায় আবির্ভূত হলেন তখন বাঙালী জেগে উঠলো। সেই মহান বাঙালী সন্তানের নেতৃত্ব ও তার দিক নির্দেশনায় বাঙালী তার আপন ঠিকানা তৈরীতে ভুল করলো না। আজ স্বাধীন সার্বভৌম বাংলার বাঙালীরা পৃথিবীর বুকে বাংলাদেশী হয়ে গর্বিত এক জাতিস্বত্ত্বা। ১৯৭১ এর রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে ৩০ লক্ষ বাঙালীর জীবন বলিদান এবং ২ লক্ষ মা বোনের সম্ভ্রম হানির বিনিময়ে আমরা আমাদের লাল সবুজের ঝান্ডাকে সমুন্নত করেছি। কিন্তু পরাধীনতার শিকলে যাদের হাজার বছরের ঘর-সংসার তারা কোন্ আক্কেলে আপন স্বকীয়তার স্বাচ্ছন্দে বিচরন করবে বলতে পারেন! আপন স্বত্ত্বার ছড়ি হাতে যখন সদ্য স্বাধীন বাংলা তার পথ চলার নতুন শপথে মহান নেতার নেতৃত্বে চোয়ালবদ্ধ হতে চাইলো তখনি এক কালবোশেখী তান্ডবে বাঙালী তার প্রিয় নেতাকে পরিবার পরিজনসহ হারিয়ে বসলো। অর্থাৎ নেতার পাশে ওৎ পেতে থাকা কিছু অপরাজনীতিকের যোগসাজসে সামরিক বাহিনীর কিছু বিপদগামী সদস্যের মাধ্যমে নেতাকে পরিবার পরিজনসহ নৃসংশভাবে হত্যা করা হলো। দেশ এক অন্ধকার তমশায় নিমজ্জিত হলো। সামরিক শাসনের অক্টোপাশে দেশকে অর্থাৎ বাঙালীকে দেড় দশক ঘানি টানতে হলো। পরবর্তীতে দেশে গনতন্ত্র এলো ঠিকই কিন্তু সেটাও আবার মহান নেতা ও স্বাধীনতার ঘোষনা পাঠের বীর সৈনিক সমন্বয়ের দুই পরিবারের দুটি মেরু তৈরী করে। অর্থাৎ গনতন্ত্রের সরলীকরনে বাঙালী যতই মুন্সিয়ানা দেখাক না কেন, ক্ষমতার তাল গাছটা কিন্তু দুই পরিবারের উত্তর পুরুষদের কাছে বন্ধক রেখেই বাংলাদেশের এযাবত কালের পথচলা। সুতরাং দেশ আছে। রাষ্ট্রাচার আছে। রাজনীতি আছে। গনতন্ত্রও আছে। আর আছে আমাদের মত হাড়-হাভাতে দেশের জনগন।
রাজনীতি, গনতন্ত্র ও জনগনের দিকে তাকালে কি দেখি আমরা। দেশে রাজনীতি আছে কি? সমস্বরে কোরাস গেয়ে রাজনীতির হাটুরের দল চিৎকার করে বলে উঠবেন – কেন নেই। কিন্তু এই 'কেন নেই' এর উচ্চারনটা বড় ক্ষীন এই সমতল ভূমির জমিনে। পরজীবি আচরনে রাজনীতি করার মানসিকতায় যারা তৈলাক্ত ও ভূঁড়িওয়ালা হওয়ার খায়েশে এই আঙ্গিনায় নাম লিখিয়েছেন তাদের এই আওয়াজটাও তো অনেক কষ্ট করে আজকাল উচ্চারন করতে হয়। ওই যে বলেছি পরিবার তন্ত্রের কানামাছির খেল্। ওখানেই লুকিয়ে আছে আমাদের রাজনীতি ও গনতন্ত্রের শক্ত পিলার। অল্পে সন্তুষ্ট বাঙালী বুঝে বেশী কিন্তু করে কম। রাজনীতিক নামের পরজীবি কেউটেরা বিশ্বাস ও আশীর্বাদপুষ্ট মানসিকতার বলয়ে বন্দি থেকে চেতনার বিকিকিনি করেন। কেউ হাতা কাটা কাল কোট পরে 'অমুক সৈনিক' হন আবার কেউ সাফারি গায়ে রঙিন চশমায় 'তমুক সৈনিক' হন। পরিবার তন্ত্রের লক্ষন রেখার বাইরে বেরুনোর মানসিকতায় রাজনীতি ও গনতন্ত্রের ব্যাখ্যায় যেতে চান না তারা। বলা যেতে পারে, মোসাহেবী মানসিকতায় চলতে ফিরতে তারা নিজেদের আপন স্বত্ত্বার কার্যকারিতা থেকে বিস্মৃত হয়েছেন। নিজের স্বকীয়তার স্ফুরনে রাজনীতির পঠন পাঠন ভুলে গেছেন তারা। বেশী কিছু ঘাড়ে চাপলে বা স্বার্থের দ্বন্দে এলোমেলো হলে তখন তাদের একমাত্র ভরসা হয়ে উঠে উত্তর পাড়ার ব্যারাকে থাকা মানুষগুলোর উপর। শৃংখলে আবদ্ধ ব্যারাকের মানুষজন তখন তাদের কাছে অতি আপনজন বলে মনে হয়। গত পঞ্চাশ বছরের স্বাধীন স্বত্ত্বার বাঙালী জীবনের রাজনীতি, গনতন্ত্র তো এভাবেই পঠিত হয়েছে বলে অনুমান করা যায়। এদেশে গনতন্ত্র মানে দুই পরিবারের সম্মানিত উত্তর পুরুষদের রাজকীয় জীবন যাপনে আবদ্ধ রেখে বাংলার প্রতিটি কোনে জমিদারী প্রথার ফলক উন্মোচন করা। আবার রাজনীতি মানে দুই কীর্তিমান বাঙালীর পারিবারিক বলয়ে আবদ্ধ থেকে তাদের নামে কীর্তন গেয়ে বেড়ানো। গনতন্ত্র ও রাজনীতির কোন্ সংজ্ঞায় পড়ে এটি? আবার এটাও লক্ষ্য করা যাচ্ছে বাংলার আঙ্গিনায় সেই মহা পুরুষের আশেপাশে বিচরন করা নেতা পাতি নেতাদের উত্তর পুরুষরাও ইদানীংকালে রাজনীতি ও ক্ষমতার পাদপীঠে সদম্ভে বিচরন করছেন। এক্ষেত্রে তাদের যোগ্যতার মাপকাঠি ধর্তব্যে আসছে না। ফলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে উত্তরাধিকারের শাসন প্রথার একটি শক্ত ভিত যে গড়ে উঠতে যাচ্ছে তাতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। আমরা কি সেই গান্ধী ডাইন্যাস্টির কংগ্রেসীয় গনতন্ত্র বা সামরিক শাসক আইয়ুবীয় মৌলিক গনতন্ত্রের কথা ভুলে গেছি। রাজনীতি ও গনতন্ত্র যদি একপক্ষীয় পাল্লায় চড়ে তার ক্ষমতার দাম্ভিকতায় একচক্ষু দৈত্য হয়ে বিচরন করতে চায় তখন ফেমিলি ডান্যাস্টির হাল ধরার যোগ্য মানুষ বা মুখ না থাকলে যে কি নাকাল দেশ ও জনপদে নেমে আসে তার জলজ্যান্ত উদাহারন তো আমাদের পার্শ্ববতী দেশের বর্তমান রাজনীতি ও শাসন ব্যবস্থায় দেখতেই পাচ্ছি। আবার অন্য চোখে ফ্যামিলি ডাইন্যাস্টি বা সামন্ত প্রথার পাকিস্থান রাষ্ট্রটির দিকে যখন তাকাই তখন কি এক অদ্ভুত রাষ্ট্রাচারের তেলেসমাতি আমাদের চোখে ধরা পড়ে। ফলে সৃষ্টির পৌঁনে একশ' বছরে দেশটির কি নাকাল অবস্থা তা আমরা দিব্যচক্ষেই দেখতে পাচ্ছি। জনগন অর্থাৎ আমরা তো হচ্ছি খাঁচায় আবদ্ধ গিনিপিগ। আজকের দিনে বাঙালীর গনতন্ত্র বলতে বুঝায় ফি পাঁচ বছর অন্তর একটি দিনের জন্য ভোটাধিকার প্রয়োগের উৎসবের চঞ্চলতা। কিন্তু সেই উৎসবীয় চঞ্চলতা কিংবা আম বাঙালীর গনতন্ত্রের মৌলিক অধিকার তো আজ দ্বিপক্ষীয় দাদাগিরিতে ভরে গেছে রাজনীতির সমগ্র উঠানে। ফলে পাঁচ বছর অন্তর ফিরে আসা বাঙালীর সেই উৎসবের আমেজও আজ ফিকে হয়ে গেছে। এমনও শোনা যায়, শতবর্ষ পুরনো সেই জমিদারি ও মোড়ল মাত্ববর কায়দায় গ্রামে গঞ্জে বিচার আচারের নিয়মাচার চালু হয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া গনতন্ত্র ও রাজনীতি কিংবা রাষ্ট্রাচার যখন ব্যক্তি বা পারিবারিক বলয়ের একছত্র সার্বভৌমে বিচরন করে তখন কোন্ আক্কেলে সেই গনতন্ত্র বা রাজনীতি আটপৌঢ় জনগনমনের উঠানে তার নিজস্ব স্বত্ত্বায় বিকশিত হয় বলতে পারেন?
রাষ্ট্রাচারের বিষয়টি ভিন্নভাবে ব্যখ্যায় আসে। সেক্ষেত্রে রাজনীতি গনতন্ত্র যখন একপেশে ক্ষমতার বলয়ে ঘুরপাক খেতে থাকে তখন রাষ্ট্রাচারের উপকরনগুলোও কেমন যেন বেসুরো কায়দায় রাজা বাদশাহী আচরনে পরাক্রান্ত হয়ে উঠে। রাষ্ট্রাচারের উপকরন বলতে দেশের প্রশাসনিক বিন্যাস, আইন শৃংখলার প্রায়োগিক নিশ্চয়তা এবং জন কল্যান মুখী আচরনের শাসন ব্যবস্থা। তবে রাষ্ট্রাচারে বিচরনের ক্ষেত্রগুলি শক্ত পোক্ত গাঁথুনিতেই আছে বলে মনে হয়। তা না হলে গনতন্ত্র ও রাজনীতি যখন ফোকলা দাঁতের ফ্যাকাশে হাসি নিয়ে আমাদের সামনে জীর্ণতায় ধরা পড়ে তখন দেশের উন্নয়নের উর্ধগতি অবশ্যই আমাদের রাষ্ট্রাচারের সবলতার সাক্ষী দেয়। এক্ষেত্রে চিন্তাটা সেখানেই। যখন আশীর্বাদপুষ্ট থেকে প্রশাসনিক বিন্যাস জবাবদিহিতার উর্দ্ধে অবস্থান করে তখন অঘটন গুলো জ্ঞাতসারেই ঘটে যায়। এবং সেটাই বোধ হয় আমাদের বর্তমান রাষ্ট্রাচারের সবচেয়ে আলোচিত প্রসঙ্গ। রাজনীতি ও গনতন্ত্রের এহেন দুর্যোগপুর্ণ সময়ে ক্ষমতার অতি সান্নিধ্যের প্রশাসন বা মেক্যানিজম কখন না বলে বসে ক্ষমতার রাজদন্ডে তাদেরও হিস্যা দিতে হবে। আশংকাটা আসছে এজন্যই যে মহান নেতা তাঁর রাজনীতির আঙ্গিনায় কখনোই প্রশাসনিক পেরিফেরির লোকজনদের ভিড়তে দেন নি। বরঞ্চ তাঁর রাজনৈতিক জীবনের তিরিশ পঁয়ত্রিশ বছরে তিনি প্রশাসনের যাঁতাকলে বাবংবার নিগৃহীত হয়েছেন। এজন্যই হয়তো নতুন সুর্যোদয়ের দিনগুলিতে তিনি দ্ব্যার্থহীন ভাষায় বলে গেছেন “তোমরা জনগনের কর্মচারী। নিজেদেরকে রাজ কর্মচারী ভেবো না”। অথচ আজকের দিনের উত্তরাধিকারের দুটি বলয় তাদের উপদেষ্টা মন্ডলীতে প্রশাসনিক আমলাদেরকেই প্রাধান্য দিচ্ছেন বেশী করে। এটা কোন্ অংকের হিসাব তা আমাদের জানা নেই। লিখতে গিয়েও কলমটা থমকে যাচ্ছে। তারপরেও যে না লিঝে পারছি না। একজন সিনিয়ন সিটিজেনের যোগ্যতা ও বিবেচনা নিয়ে এটা বোধগম্যে আসেনা, একজন কর্মরত আইন শৃংখলা বাহিনীর পোষাকী মানুষ “জনস্বার্থে” বলে কোভিড সর্তকতার ম্যাসেজ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ভাবে ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় নিয়মিত প্রচার করেন। “জনস্বার্থ” দেখার জন্য তো নেতা নেত্রী বা সরকার প্রধান রয়েছেন। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীর ফোকাসটা কোন্ নিরিখে এতটা অপরিহার্য হয়ে পড়লো? এটা কিসের আলামত!
অজানা আশংকায় কলম ধরি। কিন্তু কলম যখন ধরি তখন পিতৃ শিক্ষার সেই তেজস্বীতায় মনটা চনমন করে উঠে। যে শিক্ষায় একাত্তরের চেতনাকে ধারন করে কৈশর পেরিয়ে যৌবনের শুরুতে দেশ গড়ার ব্রত নিয়ে পঁয়ত্রিশটি বছর জনগনের কর্মচারী হয়ে কাজ করে অবসরের আদম হয়েছি, সেই শিক্ষা ও আদর্শের পাদপ্রদীপে জীবনের বাকীটা সময় কাটানোর সদিচ্ছা আছে বলেই হয়তো কলম ধরলে তা থামতে চায় না। আমাদের চলার পথে এখন ফ্যামিলি ডাইন্যাস্টিই প্রধান এবং প্রথম ভরসা। এই মেরুদন্ডহীন রাজনীতির অঙ্গনে একমাত্র তারাই আমাদের আশার প্রদীপ। কিন্তু বুঝতে হবে, চেতনার বিকিকিনি করে জুড়ে বসা বা জেঁকে বসা আগাছা ও তাদের শিকড় বাকড়কে (সেক্ষেত্রে তা রাজনীতিবিদও হতে পারেন কিংবা প্রশাসনের অতি আনুকুল্যের মাথারাও হতে পারেন) উৎপাটন করতে না পারলে কখনোই মহান নেতার সোনার বাংলা বিনির্মানে এগোতে পারবো না আমরা - এটা সন্দেহাতীত ভাবে প্রমাণিত। আমরা বাঙালী বাংলাদেশী। আসুন না, আমরা একাত্তরের চেতনাকে ধারন করে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সমগ্র বাঙালী উঠানে আবারো সেই একাত্তর সৃষ্ট জাতীয় শ্লোগানের স্ফুরনে সমস্বরে গেয়ে উঠি – পদ্মা মেঘনা যমুনা তোমার আমার ঠিকানা।