জালাল উদ্দিন আহমেদ
কুরবানী – চামড়া - টেনারী
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ২০ জুলাই,মঙ্গলবার,২০২১ | আপডেট: ০৪:৫৪ পিএম, ২০ ডিসেম্বর,শুক্রবার,২০২৪
ভেবেছিলাম কোরবানী, চামড়া, চামড়া সেক্টর ইত্যাদি নিয়ে আর লেখালেখি করবো না। কিন্তু কি করবো বলুন।
'জন্মেছি ওই সাত মহলায় মৃত্যু হাতে নিয়ে জন্ম ক্ষতের কড়াই গন্ডায় জীবন যাবে বেয়ে।
একদিকে করোনার তান্ডব আর অন্যদিকে জীবন ও জীবিকার সংস্থানে জনপদে চলছে জীবন যুদ্ধের চাকা সচল রাখার অক্লান্ত প্রয়াস। অদৃশ্য এই মরনঘাতি জীবানু আমাদের চলার চাকাকে শ্লথ করে দিয়েছে। মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়ছে। দেশের অর্থনীতির চাকা চলতে চলতে থেমে যাচ্ছে। তারপরেও অদম্য ইচ্ছাশক্তির জেরে বাঙালী ও বাংলাদেশ এখনো সচল ও সবলভাবেই তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে। তারপরেও বলতে দ্বিধা নেই, গত বছর দেড়েকের এই করোনা বসতিতে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার অবস্থা চরমভাবে বিপর্যস্ত হয়েছে। কোমলমতি লক্ষ লক্ষ ছেলে মেয়ে আজ বিদ্যাপীট বিমুখ হয়ে ঘর বন্দি হয়ে পড়েছে। কর্মজীবি মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়ছে। দেশের কর্মক্ষেত্রের কার্য পরিবেশ এখন ভিডিও ভার্চুয়্যালের মাধ্যমে সারতে হচ্ছে। এই করোনার ছোবল এতই ছোঁয়াচে কাতর যে সরকার সবকিছুতেই আজকাল ঘরে বসে ভার্চুয়্যালী নৈমিত্তিক কাজগুলি সেরে নিচ্ছে। এহেন হাজার প্রতিবন্ধকতাকে ডিঙ্গিয়ে আমাদের চলার সিঁড়িগুলোকে সচল রাখার প্রয়াসে আমরা প্রতি নিয়ত গলদঘর্ম হচ্ছি।
করোনা ক্রান্তির এইসব দিনগুলিতে আমাদের জীবন যাত্রার সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি পালন করতে হচ্ছে স্বাস্থ্যবিধি নিয়মাচারের গন্ডির মধ্যে থেকে। তাছাড়া দেশের অর্থনীতি সচল রাখার চালিকাশক্তি হিসাবে বিবেচিত উৎপাদন ব্যবস্থার বিভিন্ন ক্ষেত্রগুলোকে সচল রেখে অতি সন্তর্পণে আমাদেরকে এগোতে হচ্ছে। মুসলমানদের দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্মীয় উৎসব ঈদ উল আযহা দরজায় কড়া নাড়ছে। ধর্মীয় গুরুত্বের সাথে এই উৎসবটি দেশের অর্থনীতি ও শিল্প বিকাশের পরম্পরায় সমৃদ্ধ। সাধারনভাবে এই উৎসবটি কুরবানী নামেও বহুল পরিচিত। ধর্মীয় ভাব গাম্ভীর্যে আল্লাহর সন্তুষ্টি বিধানে পশু জবেহ বা কোরবানী করে মুসলিম সম্প্রদায় এই উৎসবটি পালন করে থাকেন। ধর্মীয় বিধানে হালাল পশু যেমন গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া, উট, দুম্বা ইত্যাদি পশু কোরবানী দেয়া হয়। এই পশুর চামড়া একটি অর্থকরী সম্পদ হিসাবে বিবেচিত। বাংলাদেশে সাংবাৎসরিক ভাবে ২৫৫ লক্ষ বা ২ কোটি ৫৫ লক্ষ পিস উল্লিখিত পশু সমূহের চামড়া পাওয়া যায়। এই চামড়া দিয়ে বিশাল একটি শিল্প সেক্টর দেশের অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখার যোগানে প্রভূত অবদান রেখে চলেছে। লক্ষ্য করা যায় দেশের প্রাপ্ত চামড়ার প্রায় অর্ধেকই এই কুরবানীর চামড়া হতে পাওয়া যায়। বাংলাদেশ হাইড মার্চেন্টস এসোসিয়েশন ও বিটিএ (বাংলাদেশ ট্যানার্স এসোসিয়েশন) হতে প্রাপ্ত তথ্যমতে প্রতি বছর কুরবানির সময় প্রায় ৩৫ লাখ পিস গরু/মহিষ/বাছুরের এবং ৯০ লাখ পিস ছাগল/ভেড়ার সাকুল্যে ১ কোটি ২৫ লাখ পিস চামড়া সংগৃহীত হয়। এই কাঁচা চামড়া টেনারী শিল্পের কাঁচামাল হিসাবে শতভাগ নিশ্চিতকরন করে দেশের চামড়া শিল্প গড়ে উঠেছে। এই শিল্প দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানীকারী শিল্প হিসাবে এখন তার অস্তিত্ব সমুন্নত রেখেছে।
আমরা দেখাছি স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে দেশীয় কাঁচামাল সমৃদ্ধ শিল্প বলতে পাট, চা এবং চামড়াকে গন্য করা হোত। এখনো হয়তো হয়। কিন্তু এই শিল্পের পৃষ্ঠপোষকতায় কোথায় যেন অদৃশ্য অবহেলা আস্তেধীরে এই তিনটি প্রধান শিল্পকে দেশীয় প্রেক্ষিতে অনেক ভাবে পশ্চাদপদ করে ফেলেছে। তাছাড়া ব্যবসায়িক গতিধারার বংশ পরম্পরা এবং পুরনো ধ্যান ধারনাকে পুষে এগিয়ে চলার খেসারতে এই শিল্প সেকটর সমূহ আধুনিক চ্যালেঞ্জে অনেকটা পিছিয়ে পড়েছে। তবে চামড়া সেক্টর তার স্থানীয় কাঁচামালের প্রাপ্তি ও উৎকর্ষতার সুবিধার্থে বিশ্ব বাজারে নিজের সুনাম অক্ষুন্ন রাখতে পেরেছে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ের পরিবেশ বাধ্যবাধকতার বেড়াজালে চামড়া শিল্প বিশেষ করে ট্যানারী শিল্প তার কাংখিত লক্ষ্যে পা ফেলতে পারছে না। অবশ্য সেই লক্ষ্যে শতবর্ষীয় হাজারীবাগের টেনারী এলাকেকে বন্ধ করে সাভারে পরিবেশ বান্ধব চামড়া শিল্পনগরী গড়ে তোলা হয়েছে। কিন্তু সরকারী পৃষ্টপোষকতায় প্রকল্প ব্যবস্থাপনার দুর্বলতাই বলুন কিংবা এই সেক্টরের গতি প্রকৃতির অজ্ঞতাই বলুন, কোন ক্ষেত্রেই সরকার সংশ্লিষ্ট পক্ষ তা সামলে উঠতে পারছে না। পরিবেশ বান্ধব চামড়া শিল্পনগরীর ধারনাটি যদিও আমাদের দেশে প্রথম এবং নতুন ধরনের প্রকল্প তথাপি ডিজিট্যালাজেশনের এই একবিংশ শতাব্দীতে তা আয়ত্বে আনা বা বুঝে আসা এমন কিছু আহামরি টেকনোলজিক্যাল জটলতায় সমৃদ্ধ নয় যা পুর্নাঙ্গ রূপে চালু হতে ১৬ বছর পেরিয়ে গেলেও তা এখনো অধরা হয়ে থাকবে। একে তো গত দেড় বছরের করোনা ধাক্কা তার উপরে গত এক দশকের পরিবেশ বাধ্যবাধকতার খড়্গ এই ট্যানারী শিল্পটাকে ব্যতিব্যস্ত করে রেখেছে। শুধুমাত্র আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের চামড়ার গুনগত মান এবং সুলভ মূল্যের কারনেই আমাদের এই শিল্প সেক্টরটি এখনও মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। তবে এই প্রকল্পের সরকারী বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠানটির অমার্জনীয় ব্যর্থতার জেরে আজ টেনারী শিল্প সত্যিকার অর্থেই এক দুঃসহ সময় অতিবাহিত করছে।
এখন আসা যাক কোরবানীর চামড়া সংগ্রহ ও তার হাল হকিকত নিয়ে কিছু কথা। আমাদের চামড়া শিল্পের বয়স খুব বেশী নয়। ১৯৪৯ সালে আরপি সাহার হাত ধরে পঞ্চাশ সালের দিকে তা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিয়ে হাজারীবাগ এলাকায় গড়ে উঠে। সে সময়ের সরকার ৬২ একর জায়গায় নিয়ে ৫০টি প্লট সমন্বয়ে হাজারীবাগে টেনারী শিল্পাঞ্চল গড়ে দেয় যা কালক্রমে বংশ পরম্পরার ভ্রংশ অপভ্রংশ হয়ে ২০০ তে দাঁড়ায়। তাহলে এর আগে পুর্ব বাংলার এত চামড়া কি কাজে লাগতো বা কোথায় যেত। অমরা হয়তো জেনেও জানিনা বা জানতে চাই না যে এতদাঞ্চলে চামড়া ব্যবসা অনেক প্রাচীন। তবে তা সব সময় আড়তদারী বা ফড়িয়া আদলেই সীমাবদ্ধ ছিল। বৃহত্তর ভারত বর্ষে তখন চামড়া প্রসেসিং বা ট্যানারী বলতে কোলকাতা, কানপুর, মাদ্রাজকেই বুঝাতো। আর আমাদের এই কৃষিপ্রধান এলাকায় তখন চামড়া আড়তদারীর মাধ্যমে ভারতের কোলকাতা কানপুরে সরবরাহ করা হোত। এমন কি পাকিস্থান রাষ্ট্র সৃষ্টি হুওয়ার পরেও এই ট্রাডিশন চালু ছিল। সুতরাং ঢাকার পোস্তায় চামড়ার আড়তদাররাই ছিলেন তখনকার গ্রেটার বেঙ্গলের চামড়া সরবরাহের কেন্দ্রীয় আড়ত। আসাম বেঙ্গলের সমস্ত চামড়া এই পোস্তার মাধ্যমে সরবরাহ করা হোত। সময় বদলেছে। এখনকার দিনে আড়তদারীর কদর ততটা না থাকলেও সারা বছর ধরে দেশব্যাপী চামড়া সংগ্রহের মুল কাজটি কিন্তু ওই আড়তদারদের মাধ্যমেই সুসম্পন্ন হয়। তবে ট্যানারী মালিক ও আড়তদারদের মধ্যে ইদানীং মুল্য পরিশোধ ইত্যাদি নিয়ে টানা পোড়েনে চামড়া সংগ্রহের এই শাশ্বত ঐতিহ্যে কিছুটা ফাটল ধরার খবর কানাকানি হচ্ছে। ব্যবসায়িক ও সিস্টেমের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার স্বার্থে উভয় পক্ষই সঝোতায় আসবেন বলে এখাতের ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ মনে করেন।
করোনা প্যান্ডেমিকের প্রথম কোরবানীর হিসাবে দেখা যায় গত বছর দেশে ১৫-২০% কম কুরবানী হয়েছিল। সুত্র এবং করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের গতি প্রকৃতিতে এবারের ঈদে ৩৫-৪০% কুরবানী কম হওয়ার সম্ভাবনাই বেশী। সেক্ষেত্রে ট্যানারী শিল্পের কাঁচামাল স্বপ্লতার বিষয়টি সামনে আসা স্বাভাবিক। তবে তার বিকল্প আমাদের আছে। কাঁচা চামড়া আমদানীর অনুমোদন কয়েক বছর ধরেই এশিল্পের ব্যবসায়ীরা পেয়ে থাকেন। তাছাড়া হাজারীবাগে এই ট্যানারীগুলি ২৫০-৩০০ মিলিয়ন বর্গফুট উৎপাদন ক্ষমতায় স্থাপিত ছিল কিন্তু সাভারের নতুন চামড়া শিল্প নগরীতে তাদের উৎপাদন ক্ষমতা দ্বিগুন অর্থাৎ ৪৫০-৫০০ মিলিয়ন বর্গফুট ক্ষমতায় স্থাপিত হয়েছে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রাপ্ত ২৫০ মিলিয়ন বর্গফুটের চামড়া ছাড়াও যে আরো চামড়া কাঁচামাল হিসাবে আমাদের প্রয়োজন তা সংশ্লিষ্ট পক্ষ অবশ্যই অনুধাবন করেন।
প্রতি বছরের ন্যায় এবারও সরকার পক্ষ থেকে কুরবানীর চামড়ার দাম নির্ধারন করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। সত্যি কথা বলতে কি, এই দাম নির্ধারনের তেলেস্মাতির খেলায় চামড়ার দাম কমতে কমতে কোথায় গিয়ে ঠেকবে তা অন্তর্যামীই জানেন। কোন্ সর্বনাশা চক্রে এই দাম নির্ধারনী চক্রব্যুহ ঘুরপাক খাচ্ছে তা বোধগম্যে আসছে না। আমরা দেখেছি ১৯৮৫-৯০ এর দিকে কাঁচা চামড়া এক'শ টাকা ফুট হিসাবেও বিক্রি হোত। তখন চামড়ার ক্রাস্ট ও ফিনিসড পর্যায়ের রপ্তানী বিক্রয় মুল্য ছিল এক থেকে দেড় ডলারের মধ্যে। এখনকার সময়ে কি চামড়ার রপ্তানীমুল্য ওই পর্যায়ে নেই?সম্ভবতঃ বেশীই আছে। হয়তো বলা হবে সে সময় উৎপাদন খরচ কম ছিল। অর্থাৎ এখন কেমিক্যাল খরচ কয়েকগুন বেড়েছে। কথাটি সত্য। কিন্তু কোন সত্যটিকে আপনি প্রাধান্য দিবেন। আপনি যখন এক'শ টাকায় চামড়া কিনতেন তখন আপনি আপনার উৎপাদনের সিংহভাগ ইউরোপে রপ্তানী করতেন। স্বাভাবিক নিয়মে আপনি সে সময় ইউরোপের কেমিক্যাল ব্যবহার করতেন যা যেকোন রিসোর্সের কেমিক্যাল থেকে দ্বিগুন তিনগুন বেশী দাম। এখন তো আপনি হংকং চিনে আপনার ক্রাস্ট বা ফিনিসড চামড়া বিক্রি করছেন। তাহলে কেন আপনাদের এই বাতিক বা অজ্ঞতা যে আপনাকে ইউরোপের কেমিক্যাল কিনে তা দিয়ে চামড়া উৎপাদন করে এশীয় বাজারে বিক্রি করতে হবে। আসলে এরকম অনেক কিছুই শভংকরের ফাঁকির মত আছে আমাদের এই টেনারী শিল্পের অন্দর মহলে যার SWOT analysis অত্যন্ত জরুরী।
যেহেতু চামড়া শিল্প ও প্রযুক্তি বিদ্যায় আমার বুনিয়াদ গড়ে উঠেছে এবং কর্মক্ষেত্রে বিচরনও করেছি এই পেরিফেরিতে বিধায় এ শিল্পের গতি প্রকৃতি সমন্ধে অল্পস্বল্প খোঁজ খবর রাখতে হয় বৈকি! সেক্ষেত্রে অল্প কথায় যেটা বলতে ইচ্ছে করে তা হোল চামড়া সংগ্রহ, চামড়া প্রসেসিং, চামড়ার প্রডাক্ট ডাইভারসিফিকেশন সহ এ ব্যবসার সকিছুই শিল্প মালিকদের সম্পন্ন করতে হয়। তাছাড়া বৈদেশিক অর্থ উপার্জনে এটি দ্বিতীয় বৃহত্তম শিল্প সেক্টর। এমতাবস্থায় শিল্প সেক্টরের মালিকদের প্রতি অনুরোধ জানাবো তারা যেন কথায় কথায় সরকারের মুখাপেক্ষী না থেকে নিজেদেরটা নিজেদের মত করে এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেন। কারন ব্যবসা তাদের লাভ তাদের সেক্ষেত্রে তাদের ভালমন্দ ভাবনাটাও তাদের। সরকার শুধু অনুঘটক। তাকে পরিচালকের আসনে বসালে কি হয় তাতো আমরা দেখেছি সরকার পরিচালিত শত শত শিল্প কারখানা জাতীয়করনের পরিনতি। আজকে সামান্য এক পরিবেশ বান্ধব শিল্পাঞ্চল স্থাপনে যে দীর্ঘসুত্রিতা তার মাসুল গুনছেন বা গুনতে হবে মালিক পক্ষকে। সুতরাং চামড়া শিল্পকে এগিয়ে নিতে হলে শক্ত ট্রেড বডি একান্তভাবে অপরিহার্য।