জালাল উদ্দিন আহমেদ
করোনা ক্রান্তি
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ১৮ জুলাই,রবিবার,২০২১ | আপডেট: ০৬:৪৮ এএম, ১৯ ডিসেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
আসলেই ক্রান্তিকালে আছি আমরা। আর করোনা যেহেতু এই ক্রান্তিকালের দুর্যোধন, সুতরাং করোনা ক্রান্তিই এখন আমাদের প্রতিদিনের রোজনামচার প্রতিপাদ্য বিষয়। করোনা নামের এই দুর্যোধনদের দাপটে আজ বিশ্বব্যাপী ত্রাহি তথৈবচ অবস্থা। দু’হাজার বিশের প্রথম দিকের ধাক্কায় যখন চীন দেশের নাকাল অবস্থা তখন বিশ্বময় একটা সতর্কতার ডংকা বেজেছিল ঠিকই কিন্তু যে বিচক্ষনতায় ওই ডংকার শব্দ নিস্ক্রিয়তার পদক্ষেপে বিশ্ববাসীর একজোট হয়ে এগিয়ে আসার প্রয়োজন ছিল তা কিন্তু পুর্ব পশ্চিম আর ডান বামের হিসাব নিকাশে এলোমেলো হয়ে পড়ে। ফলে বিশ্বের বেশীর ভাগ সময়টায় পশ্চিমের কলার উঁচু করা জাতি সমূহ সেই করোনার দুর্বিনীত ছোবলে কুপোকাত হয়ে নুইয়ে পড়ে।
সময়ের পরিক্রমায় বছর ঘুরে এই মহামারী নতুনরূপে দক্ষিন আমেরিকা ও তৃতীয় বিশ্বে ব্যপকতা পায়। ইদানীংকার সময়ে Delta variant নামক এক অপ্রতিরোধ্য করোনা জীবানু বিশ্ব জুড়ে আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে। বিজ্ঞানী ও স্বাস্থ্য কর্মীদের কপালে নতুন দুশ্চিন্তার ভাঁজ সৃষ্টি করেছে এই delta variant. সেই করোনা জীবানুটি আবার ভারতীয় ট্যাগ লাগিয়ে এখন বিশ্বময় দাঁপিয়ে বেড়াচ্ছে। অর্থাৎ ভারতীয় ডেল্টা ভেরিয়ান্ট। কি সর্বনাশ বলুন তো! একের উপর তৃতীয় বিশ্বের অধিভুক্ত মানুষের আধিক্য তার উপরে আবার সেই তাদেরই tag বা brand name এ আজ করোনা বিশ্বময় বিস্তার লাভ করছে। গত দু'মাসে যে প্রচন্ডতায় ভারতবর্ষে এই করোনা তার তান্ডব চালোলো তাতে করে সাধারন মানুষের যে নাকাল অবস্থা হয়েছে সেদেশে, তা আমরা মিডিয়ার কল্যানে দেখেছি। ভারত উন্নত বিশ্বের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তাদের জ্ঞান গরিমা ও ঠাঁট বাট নিয়ে চলতে পছন্দ করে৷ কিন্তু ভারতীয় অন্দর মহলের অর্থাৎ তাদের আর্থ সামাজিক অবস্থার তথৈবচ চেহারা মিডিয়ার কল্যানে বিশ্ববাসী অবলোকন করলো। তাদের স্বাস্থ্য সেবার এসব নাকাল অবস্থা দেখে প্রতিবেশী হিসাবে আমরা কিছুটা হলেও আহত হয়েছি। পরমানু শক্তিধর দেশটির রাজধানী শহর দিল্লিতে করোনা আক্রান্ত জনতার অক্সিজেন না পাওয়ার আহাজারি আমারা চাক্ষুষ করেছি। দেখেছি এশিয়ার বৃহত্তম নদী গঙ্গার জলে সৎকার না হওয়া মৃত দেহের ভাসমান মিছিল। আমরা পার্শ্ববর্তী দেশের মানুষ সেই indian delta variant এর প্রকোপে এখন কাঁপছি। মাস দুয়েক আগেও যেখানে আমার দেশে করোনা সংক্রমনের হার ছিল ১০-১৫% এবং আমরা সেই হার অঞ্চল ভেদে ১০% এর নীচে নামাতে সক্ষম হয়েছিলাম। আজকের দিনে সীমান্ত সংলগ্নতা ও গতিবিধির লাগামহীনতার খেসারতে আমাদের দেশে করোনা আক্রান্তের হার উর্ধমুখী।
বাংলাদেশ ছোট্ট ভূখন্ডের একটি দেশ। জনসংখ্যার ব্যপকতায় আমরা কিছুটা হলেও ন্যুব্জ। কিন্তু বাঙালীর একাগ্রতা, ঐকান্তিকতা ও জয় করার ইচ্ছাশক্তি আজ বিশ্বময় সমাদৃত। তাছাড়া শক্ত বাঁধনের উপর দাঁড়িয়ে থাকা বর্তমান সরকারের সদিচ্ছা ও জনকল্যানের প্রতি দৃঢ় অবস্থানের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ আজ যেকোন দুর্যোগ প্রতিরোধে তাদের সক্ষমতার পরিচয় দিচ্ছে। তারপরেও অদৃশ্য শক্তি এই করোনার ছোবল এখন গত দেড় বছরের যেকোন সময় থেকে মারাত্মক বলে অনুমান করতে পারি। গত এক বছরে এই বাংলাদেশে করোনা আক্রান্ত মৃত্যু সংখ্যা ছিল আট নয় হাজারের মত। অথচ এবছরের এই তিন মাসের হিসাবে সেই মৃত্যুর যোগফল এখন পনের ষোল হাজার ছুঁয়েছে। সুতরাং indian delta variant সত্যিকার অর্থেই এক মারাত্মক ধংসাত্মক ভাইরাস, যার প্রভাবে ইতোমধ্যেই বিশ্বে মৃতের হার অতি দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। লক্ষ্য করা যায় গত এক বছরে যেখানে ভারতে দেড় থেকে দু' লাখের মত নাগরিকের মৃত্যু হয়েছিল সেই করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে অর্থাৎ গত তিন চার মাসের হিসাবে তা চার লাখ পার করিয়েছে। কত মারাত্মক সেই ছোবল তা নিশ্চয় অনুমান করা যায়।
এক্ষেত্রে তৃতীয় বিশ্বে বিশেষ করে ভারতীয় উপমহাদেশে স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টি যে খুব উজ্জ্বল নয় সেটাও আমাদের গোচরে এসেছে। তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্র পীড়িত দেশ হিসাবে এমনিতেই আমরা সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় বহুবিধ সমস্যায় জর্জরিত। তাছাড়া স্বাস্থ্য সেবার ভিন্নমুখী অপ্রতুলতার মধ্যেই আমাদের জীবন যাত্রার গতি চলমান। যেখানে প্রতি দশ হাজার জন মানুষের জন্য সাকুল্যে ৮.৭ টি বেডের এবং ডাক্তার নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের যোগান ৮.৫ জন সেখানে স্বাস্থ্য সেবার দৈন্যদশা এমনিতেই ফুটে উঠে। ১১৬৯ টি আইসিইউ বেড এবং ১০৩৪টি সিসিইউ ইউনিট আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার প্রকৃত চিত্র তুলে ধরে। এক্ষেত্রে বলা যায় স্বাস্থ্য সেবার সর্ব নিম্ন পর্যায়ে আমাদের অবস্থান। সুতরাং মরার উপর খাঁড়ার ঘা হিসাবে এই করোনা সংক্রমন আমাদের চিন্তার ভাঁজকে চওড়া করেছে। হয়তোবা এই করোনা ধাক্কায় আমাদের সরকার বাহাদুরের স্বাস্থ্য সেবার মানোন্নয়নে একটু নজর বেড়েছে। সেক্ষেত্রে উল্লিখিত পরিসংখ্যানে কিছুটা হলেও স্ফীতি ঘটেছে। ফলে দেশের স্বাস্থ্য সেবার মানের উৎকর্ষতায় কিছুটা হলেও চকমকে ভাব এসেছে। তারপরেও অক্সিজেন সমস্যাসহ আরো নানাবিধ স্বাস্থ্য সেবার অপ্রতুলতায় আমরা জর্জরিত। তার উপরে বড় সমস্যা হিসাবে দেখা দিয়েছে করোনার টিকা নিয়ে। এদিকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার সমস্যাটাও একটা বড় ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়িয়েছে। জনবহুল দেশের আমজনতার ন্যুনতম চাহিদার নিরিখে সত্যিকার অর্থেই স্বাস্থ্যবিধি মানিয়ে চলাটা বেশ দুস্কর। তারপরেও বিভিন্ন সতর্কতা মুলক ব্যবস্থা ও জন কল্যানের দিক বিবেচনায় প্রানান্ত চেষ্টা করে যাচ্ছে সরকার।
সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন মুলক কর্মধারায় দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। তবে এই এগিয়ে যাওয়ার দুটি সিঁড়ি গেঁথেই আমাদের আপাতঃ পথচলা। এক রপ্তানী দুই রেমিট্যান্স। রপ্তানী ক্ষেত্রে আমরা পার্শ্ববর্তী যেকোন দেশের কাছে ঈর্ষনীয়। সেক্ষেত্রে ওষুধ রাপ্তানীতেও আমরা পারংগমতা দেখাচ্ছি। উন্নত বিশ্বেও আমাদের ওষুধ রপ্তানীকারী পন্য হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছে। আমরা পারি। এবং টেকনোলজি উন্নয়নের এই খোলামেলা ডিজিট্যালের যুগে আমরা কেন করোনা টিকা উৎপাদনের চিন্তা হতে মুখ ফিরিয়ে বসে আছি তা বোধগম্যে আসেনা। ব্যাপারটা বোধ হয় সেটাই সত্য যা সত্যবানদের মুখ থেকে প্রায়শঃই শুনতে হয়। রাজনীতি থাকবে রাজনীতির জায়গায় তেমনি ব্যবসা বানিজ্য ব্যবসায়ীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে। কিন্তু ব্যবসায়ী স্বার্থ যখন রাজনীতির পালকিতে উঠে বসে তখন সেখানে রাজনীতি থাকে না। বাণিজ্যের ট্রামকার্ডে তখন রাজনীতি জনতার কাতারে না থেকে নাগর দোলায় দুলতে থাকে। করোনার টিকা কান্ডে বাণিজ্যে বসতির যে রাজনীতি বাঙালী অবলোকন করলো কিংবা সোজা বাংলায় বললে ভোগান্তিতে পড়লো তার সদুত্তর কে দেবে? হয়তোবা টিকা কান্ডের এই তেলেস্মাতির খপ্পরে না পড়লে আমাদের টিকা কার্যক্রমের অর্ধেকটাই এতদিনে সম্পন্ন হয়ে যেত। ফলে এখনকার দিনের আক্রান্ত ও মৃত্যু হারের এই উর্ধগতি আমাদের দেখতে হোত না।
আজকের দিনে করোনা আক্রান্তের এই তান্ডবে সত্যিই আমরা দিশেহারা। মিডিয়ার কল্যানে দেখছি আমাদের সরকার বাহাদুরের মুখ নিসৃত দৌঁড়ঝাপ। মাঠ কার্যক্রমের বিষয়টি যা দেখছি তা হলো রোগীদের হাসপাতালের বেডে কিংবা মেঝেতে পড়ে থাকা এবং লাশ হয়ে বের হওয়ার দৃশ্য। আর সাংবাদিকদের এ নিয়ে রিপোর্ট করার দৃশ্য। লক ডাউনে আবদ্ধ মানুষগুলোর জন্য বাড়ি বাড়ি খাদ্য বিতরনের কোন সরকারী কার্যমক্রম এখনো চোখে পড়েছে বলে মনে পড়েনা। কিংবা কাজ হারানো রাস্তায় খেটে খাওয়া হকার শ্রমিকদের জন্য সম্মিলিত খাদ্য বিতরন বা আর্থিক অনুদানের কোন দৃষ্টান্তও চোখে পড়েনি। ভেবেছিলাম স্থানীয়ভাবে কাউন্সিলর পর্যায়ে অন্ততঃ মাস্ক সেনিটাইজার বিতরন কিংবা খাদ্য সহয়তা নিয়ে কিছু তৎপরতা চোখে পড়বে। কিন্তু সেটাও গুড়ে বালি। কর্মহারা অনেক মানুষ আজ মানবেতর জীবনের সঙ্গী। সুতরাং সমন্বিত প্যাকেজের দৃষ্টান্ত কোথায়? শুধু কি প্যাকেজ ঘোষনা আর সারকুলারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে এসব। হয়তো সবকিছুই ঠিকঠাক হচ্ছে। কিন্তু যে দেশের নেতা পাতি নেতারা ধান কাটার দৃশ্যে নিজেদের কর্মযজ্ঞ প্রমানে আদাজল খেয়ে হামলে পড়ে এবং তা মিডিয়ায় ভাইরাল করে, তারা এক কেজি চাল বা দু'কেজি আলু বিতরনে এত অন্ধকারে থাকবেন - তা কিভাবে বিশ্বাস করি। শুধু উন্নয়নের বানী আর ক্ষয়ে যাওয়া একটি পতিত রাজনৈতিক দলের নেতাদের বিরুদ্ধে বিষদগার আর কুৎসা শুনতে শুনতে দিনান্ত পার হয় আমাদের। ক্রান্তিকালের এই দিনগুলিতে মানুষ সাহস চায়, সহযোগিতা চায়, স্বাস্থ্যসেবা চায়, সামাজিক নিরাপত্তা চায়। লক ডাউন, আধা লক ডাউন, শাট ডাউন কিংবা সময় অসময়ের প্রশাসনিক অজ্ঞতার বলি হতে চায় না। আমরা শুধু সেরাদের সের দরে বিক্রি করে নিজেরা সো'য়া সের হচ্ছি। এতে করে কি আমাদের চেতনার ভীত শক্ত হচ্ছে, না নিজেদের পায়ের মাটি আলগা হচ্ছে তা সময়ই বলে দেবে।