জালাল উদ্দিন আহমেদ
পুরনো সেই দিনের কথা
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ১৩ জুলাই,মঙ্গলবার,২০২১ | আপডেট: ০৫:২৬ পিএম, ২১ ডিসেম্বর,শনিবার,২০২৪
জালাল উদ্দিন আহমেদ: কয়েকদিন ধরেই ভারতীয় বাংলা টিভি চ্যানেলগুলোতে বাঙলা ও বাঙালীকে নিয়ে বেশ চাপান উতোর চলছে। তাদের ইদানীংকার টিভি টকশোগুলো শুনলে বুঝা যায় যে, বাঙালীর অস্মিতার আঁতুড় ঘরে ভিন জাতীয় আচার ও সংস্কৃতির থাবা ঘাঁটি গেঁড়েছে। তারা প্রকাশ্যে তা উচ্চারন না করলেও তাদের অসহায়ত্বের আঁচ তখনই পাওয়া যায় যখন তাদের প্রথম সারির নেতা নেত্রীদের মুখ থেকে এসব নিয়ে কথা চালাচালি শুরু হয়। কারন রাজনৈতিক প্রতিহিংসার জেরে এক সময়ের ধর্মীয় দোলাচালে বিভাজিত বাংলার ক্ষুদ্রতম রাজ্যটিকে যখন আবারো ভাগ করার কথা বলে বাঙালির অস্মিতার আঁচলে টান পড়ে তখন স্বভাবতই বাঙালী তার স্বভাব জাত আচরনে এগিয়ে আসবে।
কয়েকদিন আগে পশ্চিম বাংলার একটি টিভি চ্যানেলের টকশো শুনছিলাম। শুনাটাই যৌক্তিক এই কারনে যে যারা এসব কথাবার্তা বলেন তারা মোটামুটি রাজনীতি ও বুদ্ধিজীবি পর্যায়ের জানা পরিচিত লোকজন। সেই চ্যানেলে যখন “ক্রস ফায়ার” নামক অনুষ্ঠানটি প্রচার হচ্ছিল তখন দেখলাম রাজনীতির সেই ডান-বাম কিংবা ধর্ম – ধর্ম নিরপেক্ষের বক্তারাই তাদের মত ও পথের বাক্যগুলি সগর্বে উচ্চারন করছিলেন। ক্ষেত্র বিশেষে যুদ্ধংদেহী মনোভাব নিয়েও তাদের আচরন পরিলক্ষিত হোল। আবার অন্য একটি টিভি চ্যানেলে “জানতে চায় বাংলা” নামক একটি সাক্ষাৎকার মূলক অনুষ্ঠানে একজন রাজনীতিবিদ তথা প্রশাসকের বক্তব্য বেশ নাড়া দেয়ার মতই লাগলো। এখানে এই ব্যক্তিটিকে রাজনীতিবিদ বলা হোল এই কারনে যে তিনি তার বাল্য শিক্ষার বুনিয়াদ গড়েছেন সেই মতাদর্শের রাজনীতির আখড়ায় যেখানে ধর্মকে সামনে রেখে তরুন যুবাদের মিলিটারী কায়দায় ধর্মান্ধ বানানো হয়। ভিন্ন মত ও পথের কোন মূল্য নেই তাদের সেই বুনিয়াদী প্রশিক্ষনে। তো সেই ভদ্রলোক তার বুনিয়াদী শিক্ষায় বেড়ে উঠে উচ্চ শিক্ষিত হয়েছেন। ফলে কর্মজীবন শেষে তিনি সেই দলটির রাজ্য স্তরে বড় আধিকারিকও হয়েছেন। আবার দলীয় আনুগত্যের পুরস্কার হিসাবে রাজ্যপালও হয়েছেন। সময়ের আবর্তে এখন তিনি সেই দলটির প্রাথমিক সদস্য। ৭৬ বছর বয়স্ক মানুষটি অবশ্যই বাঙালী। তবে বিভাজিত বঙ্গের প্রচলিত ভাষায় তিনি একজন বাঙাল।
কোলকাতা কেন্দ্রিক দুটি টিভি চ্যানেলের দু'দিনের টিভি টকশোর বিষয় বস্তু ছিল “বঙ্গ ভঙ্গ” ও জানতে চায় বাংলা”। এখানে বঙ্গ ভঙ্গ মানে সেই পুরনো দিনের ১৯০৫ এর বঙ্গভঙ্গ নয় কিংবা ১৯৪৭ এর ভারত ভাগের গ্যাঁড়াকলে সেই রক্তস্নাত বাংলা ভাগের বিষয়ও নয়। ইদানীং কালের পশ্চিম বঙ্গের বিধান সভার নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতা ও পরাজয়ের গ্লানি ভুলতে না পেরে কেন্দ্রীয় শাসনের মহা পরাক্রমশালী ধর্মান্ধ দলটির বঙ্গভঙ্গের নতুন পাঁয়তারা বা ফন্দি ফিকির নিয়ে পাকানো জটলা থেকেই এসব আলোচনা বা টকশোর আয়োজন। সাম্প্রতিক সময়ে পশ্চিম বাংলাকে নিয়ে এধরনের বহুমাত্রিক সমস্যার অবতারনা করে সদ্য প্রসূত পশ্চিম বঙ্গের নতুন রাজ্য সরকারকে ঘায়েল করার কতগুলি রাজনৈতিক কুটচাল ছাড়া এসব কিছুই নয়। নিন্দুকেরা কেন্দ্রীয় শক্তির এসব অযাচিত ও অনৈতিক ইস্যুগুলোকে ভারত রাষ্ট্রের রাজনীতিতে অশুভ শক্তির উত্থানের ইঙ্গিত বলেও বয়ান করছেন।
ইতিহাস বড় নির্মম। মিথ্যার আশ্রয়ে ইতিহাস কখনোই চলতে পছন্দ করে না। যদিওবা ক্ষমতার দাপট ও ব্যক্তি ক্যারিশমার দোলাচালে ইতিহাসের সাময়িক বিকৃতি ঘটে, কিন্তু সময়ের আবর্তে ইতিহাস সেই মিথ্যার মুখোশকে উৎপাটন করে সত্যের নির্যাস জাতির সম্মুখে উপস্থাপন করে। ভারত ভাগের অসম কাহিনী কৃতির কথা আমরা মোটামুটি সবাই জানি। যে কাহিনী, ঘটনা ও চাতুরতার আশ্রয়ে ভারত ভাগের নাটক মঞ্চস্থ করা হয়েছিল তা ছিল নিছকই প্রহসন। ভারত ভাগের আগে বাংলা ছিল বৃটিশ ভারতের স্বীকৃত একটি অখন্ড সার্বভৌম রাজ্য। বাংলা সে সময় নিজস্ব স্বকীয়তায় তার আপন জাতিস্বত্ত্বার গরিমা নিয়ে সর্ব ভারতীয় আঙ্গিকে স্বায়ত্ব শাসিত রাজ্য ছিল। তার নিজস্ব মন্ত্রিসভা ছিল। ছিল প্রধানমন্ত্রী ও বৃটিশ রাজ মনোনীত গভর্নর। পুর্বতন কোন এক আলোচনায় হয়তো বলার চেষ্টা করেছি British India Rulling Act 1935 এর আদেশ বলে বাংলাকে আলাদা মর্যাদা দিয়ে তার নিজস্ব সরকার ব্যবস্থাকে স্বীকৃতি দেয়া হয়। সেই act এর ক্ষমতাবলে অখন্ড বাংলার প্রথম প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন শেরে বাংলা একে ফজলুল হক। সাতচল্লিশের ভারত ভাগের আগ পর্যন্ত এই প্রশাসনিক কাঠামোতেই বাংলা শাসিত হয়েছিল। এসব ইতিহাসের কথা। এই ইতিহাসই হয়তো নতুন ইতিহাসের জন্ম দিয়েছিল।
নতুন ইতিহাস কিভাবে তার চলার পথে মোড় নিয়ে বাংলাকে খন্ডিত করার প্রয়াসে এগিয়ে এল তার প্রথম সুত্রই ছিল India Rulling Act এর Bengal Adminstration এর ১৯৩৫ সালের সেই বিধি বিধান। কারন সে সময়ের বৃহত্তর বাংলার জনসংখ্যার ভিত্তিতে মুসলমানেরা ছিল সংখ্যা গরিষ্ঠ। ফলে সে সময়ের গনতান্ত্রিক পন্থার হিসাব নিকাশে মুসলমানরা বাংলার শাসক হিসাবে সামনে চলে আসে। দেখা যায় ১৯৩৭ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত দুই মেয়াদে বাংলার প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দুজন মুসলিম নেতা তখন দায়িত্ব প্রাপ্ত হন। যদিও সংখ্যানুপাতিক হিসাবে মন্ত্রীসভার অন্যান্য গুরুত্বপুর্ন পোর্টফোলিওতে হিন্দুদের উপস্থিতি ছিল। তারপরেও ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে বাংলা তার নিজস্ব কক্ষ্যপথেই চলেছিল বলে ইতিহাসবিদরা বলে থাকেন। কিন্তু একদিকে বাংলার অখন্ডতা সমুন্নত রাখার শপথ অন্যদিকে মুসলিমদের জন্য বাংলার পুর্বাংশকে সংখ্যাগরিষ্ঠতার মানদন্ডে পাকিস্থানি পাল্লায় উঠানো ইত্যাদির দ্বিমাত্রিক আচরনে বাংলা অধ্যুষিত হিন্দু বাঙালীদের মধ্যে একটা অজানা আশংকা তৈরী হয়। তাদের সামনে থাকা গোঁড়াপন্থী কতিপয় ব্রাহ্মন্য নেতাদের মনে ভীতির সঞ্চার হয় যে বাংলা অখন্ড রাখার আন্দোলনে প্রকৃতপক্ষে মুসলমান বাঙালীরাই লাভবান হবে এবং বাঙালী হিন্দুরা বরাবরই পিছনের সারিতে থাকবে। তাদের মনে এটাও ঢুকে যায় যে মুসলিম গরিষ্ঠতার বদৌলতে এক সময় হয়তো পাকিস্থানী রাষ্ট্র কাঠামোয় বাংলা মিশে যাবে। যদিও বাংলার অখন্ড চেতনার সাযুজ্যে তা ছিল বেমানান এবং অযৌক্তিক। ফলে ব্রাহ্মন্যবাদী উগ্র হিন্দু নেতাদের বাঙালী বিভেদের হিন্দু মুসলিম আলাদা আবাসভূমি নির্নয়ের সেই খোঁড়া যুক্তিতে বৃহত্তর বাংলার সাধারন বাঙালী কিছুটা হলেও আহত হয়েছিল। তারপরেও বাংলা ভাগের আগে ধর্মীয় পক্ষ নেয়া কতিপয় গোঁড়া হিন্দু ও মুসলিম নেতাদের উস্কানীতে সাধারন মানুষ বিভ্রান্ত হয়েছিল। ফলে বাংলার উভয় পাশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার এক বিভিষিকায় হাজার হাজার মানুষের জীবনহানি হয়েছিল। ধর্মীয় বিষ ছড়িয়ে সাধারন বাঙালীকে দুই মেরুতে ঠেলে দুটি বিষাক্ত বলয় তৈরী করতেও কট্টর পন্থী হিন্দু ও মুসলিম নেতারা পিছপা হন নি।
যাহোক, ধর্মের ভিত্তিতে বাংলা দু'ভাগ করা হোল। মুসলিম সংখ্যা গরিষ্ঠের পুর্ব বাংলা পাকিস্থানের অংশ হলো। আর পশ্চিমের হিন্দু গরিষ্ঠ বাংলা পশ্চিম বঙ্গ নাম নিয়ে ভারতের অংশ হলো। মোটকথা, বাংলা ও বাঙালী দ্বিখন্ডিত হলো। এই বিভাজনের নিরপেক্ষ বিশ্লেষনে দেখা যায়, পুর্ব বাংলার সংখ্যা গরিষ্ঠ হিন্দুরা সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্থ হোল। ক্ষেত্র বিশেষে তারা বিতাড়িত হয়েছিল বললেও ভুল বলা হবে না। অন্যদিকে পশ্চিম বাংলার সংখ্যা লঘু মুসলমান বাঙালীরা বিতাড়িত বা রাষ্ট্রীয় কোপানিলে না পড়লেও আচার আচরন ও ধর্মীয় আত্মিক টানে তাদের একটা অংশ পুর্বমুখী হয়েছিল। তবে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় সীমান্ত সংলগ্ন এলাকার মুসলমানেরা ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে পাকিস্থানমুখী হয়েছিল। ঘটি-বাঙালের সুত্রপাত তখন থেকেই শুরু। অর্থাৎ পুর্ব বাংলার হিন্দুরা পশ্চিমে গিয়ে ' বাঙাল' আর পশ্চিমের মুসলমানেরা পুবে এসে 'ঘটি'।
প্রবন্ধের শুরুতেই উল্লিখিত সেই বাঙাল বাবুটি যখন তার টেলিভিশন সাক্ষাৎকারের বয়ানে বলেন যে মুসলিম কর্তৃক বিতাড়িত এবং বাস্তুচ্যুত তিনি এখন হিন্দু বাংলার অধিবাসী – তখন একবিংশের এই ডিজিট্যাল যুগেও হোঁচট খেতে হয় বৈকি! অর্থাৎ সেই ক্ষোভ ও ঘৃণা তার অন্তরে পুষে রেখেই তিনি এখনও খুঁজে বেড়াচ্ছেন তার বাস্তু ভিটার আদি আবাহন। সম্ভবতঃ সেই মন্ত্রেই হিন্দু জাতীয়তাবাদী কট্টর রাজনীতির বর্তমান দিল্লি সরকার তাদের হিন্দুত্ববাদী বুনিয়াদ বিনির্মানে দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাচ্ছেন বলেই মনে হয়। অপরদিকে অন্য একটি টকশোতে যখন রাজনীতির বক্তারা খোলা মনেই বলেন সেদিনের শ্যামা প্রসাদ বাবুরা এগিয়ে এসেছিলেন বলেই আজ আমরা হিন্দু বাঙালীরা নিজের মত করে বেঁচে আছি। নইলে আমাদের ঢাকার মুসলিম শাসনের অধীনে থাকতে হোত। কি অকপট সরল উক্তি! রাজনীতির সরল পাঠের কোন বিজ্ঞতার পরিচয় বহন করে কি এসব উক্তি? যেসব ব্যক্তি এখনকার দিনে এসব ধর্ম বিদ্বেষের ধোঁয়া উদগীরন করেন তাদের পুর্ব পুরুষেরা কি মওলানা আযাদ, হাজি শরীয়তুল্লাহ, সৈয়দ আহমেদ, সৈয়দ আমির আলী, জিন্নাহদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ভারত আন্দোলন করেন নি? আজকে তাদের এই ক্ষুদ্র বাঙালী অধ্যুষিত পশ্চিম বঙ্গে মথুয়া, রাজবংশী এমন কি হিন্দি বলয়ের বিশাল এক জনগোষ্ঠী তৈরী হয়েছে আলাদা আলাদা পরিচয়ে। বাঙালীর কোন্ অস্মিতায় তারা আজ বাঙালী হয়ে আছেন সেটাই তো বোধগম্যে আসছে না। শোনা যায় কোলকাতার চল্লিশ শতাংশ মানুষই হিন্দি ও উর্দু ভাষী। সুতরাং যতই বাংলা বাঙালী বলে উচ্যবাচ্য করেন ভিতরের খবর তো ফোকলা। একদিকে পাহাড়ি, গোর্খা, রাজবংশী, মথুয়া আর অন্যদিকে শুদ্ধাচারের ওই মাটির বাঙালী। তাতেও তো আবার ছ্যুত অছ্যুতের হিসাব নিকাশ। তার উপরে রয়েছে একটি বিশাল অংকের মুসলিম বাঙালী। তাহলে বাঙালী বলতে তো ওই গরিষ্ঠ মুসলমানদেরকেই বুঝায়। শ্যামা প্রসাদদের উত্তর পুরুষ ওই বাংলায় কতজন আছে বলতে পারেন?
সুতরাং পুরনো সেই গীত গেয়ে আর কতকাল হীনমন্যতায় ভুগবেন? যে হীনমন্যতা নিয়ে একসময় বাংলাকে দু'ভাগ করেছেন। করেছেন বলছি এই কারনে যে সে সময় আপনাদের ওই প্রবাদ প্রতীম বাঙালী বাবুরা যদি গ্রেটার বেংগল আন্দোলনের স্বপক্ষে থাকতেন তাহলে আজকে বাঙালীর ইতিহাস অন্যভাবে রচিত হোত। এসব মথুয়া রাজবংশী এসসি এসটির বিভাজন করে কোন্ হিন্দু অস্তিত্বের বাংলা বিনির্মানের কথা ভাবছেন আপনারা। আপনাদের সেই দাস ঘোষ মন্ডলরা কি এখনকার দিনে সেন ও রায় বাড়ির চৌহদ্দিতে ঢুকতে পারে? পুরনো ব্রাহ্মন্য রাজা রাণীদের সমাজ শাসনের বিভিন্ন টেলি সিরিয়াল দেখিয়ে আপনারা বাঙালীর কোন্ সংস্কৃতিকে উচ্চকিত করতে চান। সবকিছু বাদ দিয়ে আগে জাতপাতের হিসাব নিকাশ মুছে ফেলুন। হিন্দুর একাত্মতা তৈরী করুন। নিজেরাই তো নিজেদের ফাঁদে পড়ে এখন ছটপট করছেন। সবাইকে নিয়ে প্রকৃত বাঙালী হোন এবং সর্ব অঙ্গনে তা প্রায়োগিকভাবে সমুজ্জ্বল করুন। বাঙালী বাংলাতে থাকুক - এই শুভ কামনা রইলো।