জালাল উদ্দিন আহমেদ
মিডিয়া ফাঁপর
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ১৮ জুন,শুক্রবার,২০২১ | আপডেট: ০৯:৩১ এএম, ১৯ ডিসেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
আজকাল খুব বেশি টেলিভিশন দেখা হয়ে উঠে না। মিডিয়ার বিভিন্ন শাখা প্রশাখার দৌরাত্ম্যে মূলস্রোতের ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার সংবাদমাধ্যম ইদানীং মানুষকে বেশি টানে না। তিন বছরের শিশু থেকে শুরু করে তিরানব্বই বছরের বৃদ্ধের হাতে আজকাল স্মার্টফোন বেশ জায়গায় করে নিয়েছে বলেই আঁচ করা যায়। শহর বন্দর গ্রাম গঞ্জের সর্বত্রই এই মোবাইল ফোবিয়া আমাদের দৈনন্দিন জীবনাচারের নিত্যসঙ্গী হয়ে উঠেছে। সোশ্যাল মিডিয়া ঝড়ে ইদানীংকালের সামাজিক বিবর্তন বেশ চোখে পড়ার মত। তাছাড়া প্রচলিত মিডিয়া অর্থাৎ রেডিও টিভি বা খবরের কাগজের সবখানেই যখন কর্তার কীর্তনের সুনির্দিষ্ট বন্দোবস্ত, তখন কোন্ আক্কেলে মানুষজন এই বোকা বাক্স বা পাতা ভরা কীর্তন নিয়ে নাড়াচাড়া করবে! সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যানে মানুষ যখন ব্যক্তি জীবন, সমাজ জীবন, রাষ্ট্র ও আন্তঃরাষ্ট্রীয় চালচলনের চুলচেরা বিশ্লেষনের এপিঠ – ওপিঠের দুই পিঠই দেখতে পাই তখন কোন্ দুঃখে তারা সরকার বা গোষ্ঠি নিয়ন্ত্রনাধীন টিভি সেটের সামনে বসে সময় নষ্ট করবে বা প্রিন্ট মিডিয়ায় প্রকাশিত কর্তা বন্দনার একপেশে কাহিনী পড়বে। একথা সত্য যে ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার খবর ও বিষয়বস্তু সত্যতার যাঁচাই বাছাইয়ের মানদন্ডে কালোত্তীর্ণ। কিন্তু গদবাঁধা সরকারী বা ক্ষমতাবানদের একই কাসুন্দি শুনে বা দেখে মানুষ আজ একঘেয়ামীতে পড়েছে। সমাজের অনেক গল্প ও কাহিনী সাধারন মানুষের কাছে পৌঁছায় না ওইসকল ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার মাধ্যমে। সেক্ষেত্রে এই নতুন সংযোজন সোশ্যাল মিডিয়া সমাজের অসংলগ্নতার বিভিন্ন অজানা সংবাদ তথ্য-উপাত্তের মাধ্যমে সমাজকে জানিয়ে দেয় এবং সমাজ ও জনপদ এসবের মাধ্যমে অনেক ক্ষেত্রেই লাভবান হয়। একটা সময় ছিল যখন কোন একটা রাষ্ট্রের উন্নয়নের মানদন্ডে সেই রাষ্ট্রের জ্বালানী ব্যবহারের পরিমান ও তার অভ্যন্তরীন যোগাযোগ ব্যবস্থার সবল কাঠামোর দিকটা দেখা হোত। সম্ভবতঃ প্রযুক্তি ও সোশ্যাল মিডিয়ার বিষয়টিও আজকাল এর সঙ্গে সংযুক্তি পেয়েছে।
অবাধ তথ্য প্রবাহের যুগে মানুষ আজকাল ফেইস বুক ও ইউ টিউব নির্ভর হয়ে পড়েছে। ফেইস বুকের মাধ্যমে আমরা আমাদের ভাব বিনিময় ও সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সর্বক্ষেত্রেই নিজেদেরকে প্রকাশ করি। কেউ প্রকট ভাবে, কেউ ধরি মাছ না ছুই পানির মত। আবার অনেকেই আছেন যারা সারা জীবন নীরব দর্শকের মত শুধু “লাইক” দিয়েই তার ফেইস বুক জীবন পার করে দেন। তবে প্রকাশের ভঙ্গি ও বলার ভিন্নতাও লক্ষ্য করা যায়। ফেইস বুক ও ইউ টিউবের গ্রহন যোগ্যতা নিয়েও অনেকে অনেক কথা বলেন। প্রায়শঃ শোনা যায় সোশ্যাল মিডিয়ার এইসব বক্তব্য বা নিউজ পোর্ট্যাল গুলি শতকরা নব্বই ভাগই মিথ্যা ও ভুয়া। শুধুমাত্র নিজেদের প্রচার ও প্রসারের নিমিত্তে ওইসব মিথ্যা ও বানোয়াট খবরের পসার সাজিয়ে তারা প্রপাগান্ডা করে। নিজের মত ও পথের প্রচার ও প্রসারের এ এক অদ্ভুত মিডিয়া জগৎ। এমন সব অদ্ভুত ও অবাস্তব খবরাখবর মুখরোচকভাবে তথ্য ও উপাত্তসহ জুড়ে দেয়া হয় তা ম্যাজিকের মতই মোহাচ্ছন্ন করে সাধারন মানুষকে। তবে রাজনীতির চমকপ্রদ খবরে যে বিভ্রাট রয়েছে তা সহজেই অনুমান করা যায়। তারপরেও আবাল বৃদ্ধ বনিতা যখন সবাই এই ফেইস বুক বা ইউ টিউব দেখা ও পড়ার খায়েশে হামলে পড়ে তখন নতুন করে আর কি বলার থাকে।
আমি একজন ষাটোর্ধ অবসরপ্রাপ্ত মানুষ। সকালে ঘুম থেকে উঠে নাস্তার টেবিলে একহাতে মোবাইল ফোন আর অন্য হাত দিয়ে নাস্তার কাজটি সারি। এর আগে অবশ্য বিছানা থেকে উঠেই চোখ দুটি কচলিয়ে বার'শ পাওয়ারের চশমাটি চোখে দিয়ে সেটটি খুলে দেখে নিই নতুন কোন ম্যাসেজ বা খবর আছে কিনা। সারাদিনের নাওয়া খাওয়ার ফাঁকে ইউ টিউব ও ফেস বুক ব্যস্ততা তো আছেই। আর রাত বিরেতে ঘুমিয়ে যাওয়ার প্রাক্কালে শুয়ে শুয়ে শেষ বারের মত একটু চোখ বুলিয়ে নেয়া। তাও সেটা রাত একটার আগে শেষ হয় কিনা সন্দেহ আছে। কি অদ্ভুত ব্যস্ততা আমাদের। এটা শুধু আমার জন্য প্রযোজ্য তা কিন্তু নয়। অশীতিপর বৃদ্ধদেরও দেখি রাত বারোটার পর তাদের নেটওয়ার্ক খোলা রেখেছেন। তখন বুঝতে অসুবিধা হয়না এই সোশ্যাল মিডিয়ার বাহকগুলো কতবড় মহা চুম্বক যা শিশু কিশোর থেকে শুরু করে কর্মে অক্ষম বৃদ্ধটির হাতেও আঁটকে আছে। আমার তিন বছরের শিশু নাতনীটিকে দেখি মোবাইল চালিয়ে ইউ টিউবে কার্টুন দেখতে। মাঝেমধ্যে টিকটকও দেখে। এগুলো নিয়েই তার দিনমান। আজকাল রাত জেগে খেলা দেখা নিয়েও চলছে পারিবারিক অশান্তি। ড্রয়িং রূমে বসে অত রাতে খেলা দেখা কি সম্ভব? তাই বিছানায় শুয়ে শুয়েই চলছে নেটে টিভি দেখার কালচার।
জানিনা কোন ডিজিট্যালে আমাদের অবস্থান। মোবাইলের এই জিবি/এমবির আধিক্য আমাকে আমার সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় কি দিচ্ছে তাও কম বুঝি। তবে এটুকু বুঝি যে এন্ড্রয়েডের সঙ্গে এই সখ্যতা আমাদের মননশীলতা ক্ষয় করে দিচ্ছে। মানুষের সৃজনশীলতা, নৈতিকতা ও সামাজিক মুল্যবোধ এই সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাবে আজ শুন্যের কোঠায় নেমে গেছে। মধ্যেখানে বহুজাতিক কোম্পানীর পেট মোটা হচ্ছে। যদি দশ কোটি গ্রাহক প্রত্যহ দশ টাকা করে খরচ করে এই জিবি/এমবির পিছনে তাহলে বাঙালীর প্রতিদিনের খরচ এক'শ কোটি টাকা। ইদানীং স্কুল কলেজ বন্ধ থাকার কল্যানে মোবাইল অপারেটরদের অবস্থা তো আরও রমরমা। বিকাশ, নগদ,রকেট করে মানুষের অর্থ ব্যবস্থাপনার সুবিধা করা হয়েছে। তাহলে শ'খানেক ব্যাংক স্থাপন করে এত এত ব্যুরাক্রাসি তৈরী করার মানে কি?
এত প্রযুক্তি এত ডিজিট্যালাইজেশন, তারপরেও প্রতি বছর ঘটে যাওয়া প্রশ্নপত্র ফাঁসের হদিস পাওয়া যাচ্ছে না কেন? কেন ব্যাংকের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা থেকে চুরি হওয়া টাকার কোন কুল কিনারা হচ্ছেনা। ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে অথচ আমরা কানা বোবা হয়ে বসে থাকছি। অথচ এই প্রযুক্তি নির্ভর মিডিয়া আমাদের সবকিছু খোলাসা করে দেখিয়ে দিচ্ছে। আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর মিডিয়ার বদৌলতে জনগন সেসব সংবাদ তাৎক্ষনিত জানতেও পারছেন।কিন্তু কেন হচ্ছে কিভাবে হচ্ছে তার কুলকিনারা কি আমাদের জানা নেই? আধুনিক প্রযুক্তি যদি এরকম হাজারো নেগেটিভ কর্মধারার সুতিকাগার হয় তাহলে এর প্রয়োজন কতটুকু টেকসই তা ভাবতে হবে বৈকি! আমরা এতই উন্নত ও স্বাবলম্বী যে আমার পথ ঘাট দরজা জানালা সবকিছু খুলে দিয়ে শুয়ে শুয়ে দেখছি লুঙ্গিতে টান পড়ে কি না। টান পড়েই গেছে বোধ হয়। নৈতিকতা নেই, মানবতা নেই, স্বচ্ছ্বতা নেই, নেই কোন পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ বা সহমর্মিতা। জবাবদিহিহীন ক্ষমতাবান কর্তারা রাষ্ট্রের সর্বক্ষেত্রে তারার মত টিমটিম করছে আর ডিজিট্যালাইজেশনের সুবিধাভোগে রাষ্ট্র জুড়ে উইপোকার ঢিপি বানাচ্ছে। দায়িত্বহীনতা রাষ্ট্রের সর্ব পর্যায়ে বিকশিত হচ্ছে।
প্রযুক্তির আধুনিক বিকাশ উন্নয়নের চাদর বিছিয়ে জনপদ ও রাষ্ট্রকে শিরদাঁড়া শক্ত করে দাঁড়াতে শিখিয়েছে। আমরা প্রযুক্তির এই সুবিধা ভোগে এগিয়ে যাচ্ছি এবং যাব ইনশা আল্লাহ। রাজনৈতিক শুদ্ধাচারের মাধ্যমে সামাজিক সদাচার সৃষ্টি হয়। এই সামাজিক সদাচারই হচ্ছে পারিবারিক কাঠামো বিনির্মানের শ্রেষ্ঠ হাতিয়ার। এভাবেই সমাজ রাষ্ট্র ও পরিবারের পারস্পারিক শ্রদ্ধাবোধ, সহমর্মিতা ও নৈতিকতা সমাজবদ্ধ মানুষকে উন্নত শিরে দাঁড়াতে সাহাজ্য করে। সেক্ষেত্রে তখন প্রযুক্তির নেগেটিভিটি গৌণ হয়ে তা পজেটিভিটির পাল্লা ভারি করে। আধুনিক প্রযুক্তির আবহ আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজ জীবনে সুফল বয়ে আনুক। এই প্রত্যাশায় বাঙালীর প্রতিটি সকাল শুরু হোক।