জালাল উদ্দিন আহমেদ
অনুভূতির ইনস্টিংক্টস
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ২৯ মে,শনিবার,২০২১ | আপডেট: ০৫:২৮ পিএম, ১৫ ডিসেম্বর,রবিবার,২০২৪
প্রতিটি মানুষের একটি অলৌকিক অনুভূতির জায়গায় থাকে যা তাকে সৃষ্টিশীলতার উঠানে প্রশান্তির যোগান দেয়। এই অনুভূতি তার আত্মার সাথে ওতপ্রোতভাবে মিশে রয়েছে। এই অনুভূতি দিয়ে মানুষ তার চলার গতি প্রকৃতিকে সাজিয়ে নেয়। সে যখন পরিপুষ্ট মানুষ হিসাবে সমাজে আবর্তিত হয় তখন তার আত্মার অলৌকিক অনুভূতিকে নিজের জীবন বোধের সঙ্গে মানিয়ে নেয় এবং চলার পথে তার স্ফুরন ঘটায়। মানুষ শিক্ষিত হয়। সমাজের সমাজপতি হয়। রাজনীতির বড় নেতা হয়। প্রফেসর হয়, ডাক্তার হয়, উকিল, মৌলভী, পুরোহিত, প্রশাসক হয়, বিচারপতি হয়। অর্থাৎ জীবন ও জীবিকার সর্বক্ষেত্রে যখন মানুষ ছড়িয়ে পড়ে তখন তার নিজস্ব অবচেতন অনুভূতির সঙ্গে মিলিয়ে চলার পথকে সে সাজিয়ে নেয়। সেক্ষেত্রে দেখা যায় তার ইচ্ছে শক্তির বাইরের প্রফাইলে তাকে ফেলা হলে সেই মানুষ দিয়ে কখনোই ভাল কাজটি সংঘটিত হতে পারেনা। অবশ্য এর সঙ্গে একটা উপসঙ্গ খুব জরুরী তা হোল “যোগ”। এই যোগ শব্দটি মনুষ্য জাতির প্রপ্তির খাতাকে সমৃদ্ধ করে বলেই আমরা দেখে আসছি। রাজযোগ, কর্মযোগ, ধর্মযোগ, অর্থযোগ – এধরনের বহুযোগ আমাদের জীবনের খাতাকে সমৃদ্ধ করে। এই প্রপ্তিযোগ অনেক সময় আমাদের অলৌকিক অনুভূতির ইনস্টিংক্টকে শাণিত করে, পোক্ত করে।
অনুভূতির সঙ্গে আরো কিছু অনুসঙ্গ মানুষকে তার কাংখিত গন্তব্যে পৌঁছাতে সাহায্য করে। রাজনীতির কথাই ধরুন। একজন আদর্শ রাজনীতিবিদ হতে হলে কর্মযোগ, মানবতাবাদ, সুশিক্ষার জ্ঞানযোগ এবং মানুষ হয়ে মানুষকে ভালবাসার এবং বুঝার প্রবল ইচ্ছাশক্তির অনুভূতি গুলোকে তার মনের মধ্যে লালন করতে হয়। সেক্ষেত্রে কিশোর বয়স হতেই সেসব মানুষের মধ্যে একটা ভিন্নতর অনুভূতির শেকড় গাঁথা হতে থাকে। মধ্যযুগ বা প্রাচীনকালে যেমন রাজার ছেলে রাজা হবেন কিংবা মন্ত্রী মোসাহেবের উত্তর পুরুষরা ওপথেই এগোবেন এমন একটা ধারনা নিয়েই সমাজ ও রাষ্ট্রাচার আবর্তিত হোত। এখন এমনটা হয়না। তবে একটা পরম্পরার চলন আমাদের তৃতীয় বিশ্বে এখনো দৃশ্যমান এবং বিদ্যমান আকারেই প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। Family Dynesty বা বংশ পরম্পরার রাজনীতি এখনো তৃতীয় বিশ্বে পোক্ত শিকড়েই বিদ্যমান। এক্ষেত্রে রাজনীতির দুর্বৃত্যায়ন এবং অগনতান্ত্রিক চর্চার প্রাধান্যেই এসব টিকসই হয় বলে আমরা আমাদের এই অল্প আয়ুষ্কালের অভিজ্ঞতায় দেখতে পাই। তাছাড়া ইদানীংকার রাজনীতিতে তোষামোদি ও দুর্বৃত্যায়নের পরম্পরা বেড়ে যাওয়ায় তৃণমূল থেকে কর্মী হয়ে পুষ্টতা নিয়ে রাজনীতিবিদ তৈরী না হওয়ার এটাও একটা কারন বলে সমাজ বিজ্ঞানীরা বলে থাকেন। তারপরেও তৃনমূল থেকে রাজনীতির আদর্শে বেড়ে উঠেই আমাদের সামনে মফস্বলের মুজিব ভাই বঙ্গবন্ধু হয়ে জাতির পিতা হয়েছেন। একে ফজলুল হক শেরে ই বাংলা হয়েছেন। আদর্শের অনুভূতির ইনস্টিংক্টসকে পোক্ত করে মৌলানা আব্দুল হামিদ খান মজলুম কৃষকের ভাসানী হয়েছেন। আর যারা পারেননি তারাও কিন্তু তাদের অনুভূতির আদর্শকে আঁকড়ে রেখে নিজ নিজ অবস্থানে যশস্বী হয়েছেন। তৃণমূল থেকে ছাত্র রাজনীতি করে উঠে আসা একজন মেধাবী ছাত্র যেমন ভাল শিক্ষক হতে পারেন না তেমনি একজন শিক্ষিত বেকার রাজনীতির পৃষ্ঠপোষতা পেলেও ভাল রাজনীতিবিদ হয়ে উঠতে পারেন না। এখানে সেই অলৌকিক অনুভূতির ইনস্টিংক্টা ছেঁড়া কিংবা ভোতা থাকে বলেই এমনটা হয়। কি হয় সেটা আমরা চোখের সামনেই দেখতে পাই। রাজনীতির ফায়দা নিতে আজকাল যেসব মানুষজন সাধারন জনগনের মাথা হন তাদের মধ্যে রাজনীতির স্বাভাবিক মূল্যবোধ থাকে বলে মনে হয় না।
আসি প্রশাসনের কথায়। আমরা ছোট বেলায় দেখেছি ছোটখাট একটি সরকারী পরিদপ্তরের প্রশাসনিক অফিসার এমনকি তার অধঃস্তন ইউডি এলডিদের জ্ঞানের পরিধি এবং প্রশাসনিক দক্ষতা। সেসময় বিএ এমএ খুব বিরল ব্যাপার ছিল। ফলে মেট্রিক আইএ পাশ কর্মচারীরাই তখনকার সময়ে ওইসব পদগুলি অলংকৃত করতেন। আর বিএ বা অনার্স পাশ করে সিএসএস, সিএসপি বা ইপিসিএস হয়ে অফিসের বড় কর্তা হতেন। সে সময় ওইসব ক্যাডার পদাধিকারী অফিসার হতে হলে শুধু ডিগ্রি ও মেধাবী হলেই চলতো না। রাষ্ট্র বিজ্ঞান, ভূরাজনীতির হালচাল, সামাজিক পরিকাঠামোর উত্থান পতনের সমস্ত ঠিকুজি জেনেই এবং তার প্রশাসক হওয়ার যোগ্যতার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েই কর্মস্থলে নিয়োগ নিশ্চিত হোত। এমনকি তাদের বংশ পরম্পরার ঠিকুজিও বিচার বিবেচনায় সামনে আসতো। সুতরাং ওই যে ইচ্ছাশক্তির অনুভূতি! সেটার যাঁচায় বাছাই এক্ষেত্রে ষোলতে ষোলই মিলানো হোত। এখনকার দিনে ওসব যাঁচাই বাছাইয়ের বালাই নেই বলেই হয়তো আজকাল আমরা প্রশাসন তথা আইন শৃংখলার উঠানকে “যাঁতাকল” তথা অন্যান্য ভয়ংকর বিশেষনে আখ্যা দিতেও কুন্ঠিত হই না। অর্থাৎ এক্ষেত্রে প্রশাসনিক যোগ্যতার ওই অলৌকিক ইনস্টিক্টস একজন প্রশাসক বা আধিকারিকের আছে কিনা তার যথাযথ বিচার বিশ্লেষন না করেই আমরা তার কাঁধে সেই বিশাল কর্মযজ্ঞের বোঝাটি চাপিয়ে দিই।
বিষয়গুলি সর্বক্ষেত্রেই প্রযোজ্য বলেই হয়তো আমরা সমাজ রাষ্ট্র ও জনজীবনে বহু চড়াই উৎরাই লক্ষ্য করি। রাজার ছেলে রাজা হয় না তার বহু উদাহারন আমরা পাই। তেমনি করে অর্থনীতি আইননীতি ব্যবসানীতি সমাজনীতি সর্বক্ষেত্রেই ব্যতিক্রমী ঘটনাগুলি ঘটতে দেখা যায়। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে কঠোর ঘোরটোপের বেড়াজালে পড়ে পুর্বপুরুষের হাঁটা পথেই তাদের উত্তর পুরুষদের চলতে হয় বলে রাজনীতি তথা রাষ্ট্রনীতির আঙ্গিনায় তখন একটা এলোমেলো বাতাস বইতে থাকে। আমরা দেখেছি একজন নামকরা আইনজীবি যখন অতি উচ্চাশা নিয়ে তার উত্তর পুরুষকে লন্ডনে ব্যারিষ্টারী পড়িয়ে তার ঐতিহ্য রক্ষার দায়িত্ব দিয়ে নিশ্চিন্ত হতে চান তখন সেই তরুন ব্যারিষ্টার তার পুর্ব পুরুষের সুনাম রক্ষা করতে পারেন না। ফলে এক জেনারেশনেই সেই পথচলা থমকে যায়। আমার এক বৃটিশ বন্ধু আছেন। বয়সে আমার থেকে এককুড়ি বেশীই হবে। তবু কর্মক্ষেত্রে একসঙ্গে বহুদিন সংযুক্তির ফলে তিনি এখন আমার একজন ভাল বন্ধু। তাছাড়া পেশাগত জীবনে আমরা একই প্রফাইলের বলেই হয়তো আমাদের যোগাযোগটা এখনও অটুট রয়েছে। লন্ডনেই থাকেন। তার দুটি ছেলে। বড় ছেলে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। আর ছোট ছেলে গীর্জার পুরোহিত। এখানে কি বলবেন! অর্থাৎ ইচ্ছাশক্তির অনুভূতিকে প্রাধান্য দিয়েই তিনি তার দুই সন্তানকে তাদের মত করে বড় হতে দিয়েছেন। ফলে তারা দুজনেই নিজের মত করে তাদের স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তেমনি আমার এক ছাত্রবন্ধু যিনি ক্লাসে দু'বছরের জ্যৈষ্ঠ, তিনি ছাত্র রাজনীতি করে বেড়ে উঠে কলেজের অধ্যাপক হয়েছিলেন। কিন্তু রক্তে যার রাজনীতি, তিনি অবশেষে রাজনীতিতেই সুনাম করেছেন। এবার নিয়ে পাঁচবার পশ্চিমবঙ্গ বিধান সভার নির্বাচনে নিজ এলাকায় এমএলএ হয়েছেন। মন্ত্রীও হয়েছেন। আমার আর একজন বন্ধুর কথা না বললেই নয়। নাম তার আলতাফ হোসেন। সে একজন মুক্তিযোদ্ধাও বটে। এইচ এস পাশ করে আমরা লেদার টেকনোলজিতে ভর্তি হলাম। এক বছর অর্থাৎ প্রথম বর্ষ শেষ না হতেই দেখি সে উধাও। তারপর খোঁজ নিয়ে জানলাম সে শেরে ই বাংলা নগরের সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের বিখ্যাত অর্থোপেডিক ডাঃ গ্রার্স্টের কর্মযজ্ঞে সামিল হয়েছে। এবং মাস ছয়েকের কর্ম সাফল্যে সে ডাঃ গ্রাস্টের সুপারিশে মেডিক্যাল সাইন্সে রাশিয়ান স্কলারশিপ নিয়ে মস্কো চলে গেছে। সেখান থেকে পুর্ন চিকিৎসক হয়ে ইউরোপের আরো দু'একটি দেশ থেকে কর্ম অভিজ্ঞতা নিয়ে সে নব্বইয়ের প্রথম দিকে দেশে ফিরেছে। সেই আলতাফ এখন দেশ সেরা ব্যাথা বিশেষজ্ঞ (pain specialist) ডাক্তার হিসাবে জনমানুষের সেবায় নিয়োজিত।
মোটকথা, ইচ্ছাশক্তি বা অনুভূতির ইনস্টিংক্টস যদি একটি মানুষের চাহিদায় সমান্তরাল থাকে সেক্ষেত্রে তার স্ফুরন সুন্দরভাবে বিকশিত হয়। তবে সর্বক্ষেত্রেই প্রয়োজন কঠোর সাধনা ও পরিশ্রম। একজন যোগী যেমন তার সাধনার যোগফলেই সাধু হন তেমনি একজন ধর্মগুরু তার ধর্ম সাধনায় হয়ে উঠেন ধর্মের সর্বোচ্চ সম্মানিত ব্যক্তি। বাগানের মালি যেমন গাছের পরিচর্যা করতে করতে নিজের ভালবাসার স্থান তৈরী করে নেন। তেমনি মাছধরা জেলে তার জাল ফেলার আগেই বুঝতে পারেন সেই জালে মাছ উঠবে কিনা। কৃষক করিম মিয়া যখন ফসলের জমিতে তার নিজ হাতে পরিচর্যা করে ফসলের উৎপাদন ও উৎপাদ নিয়ে কাজ করেন তখন সেখানে তার কর্মযোগ ও অনুভূতির যোগফলে তিনি কামিয়াব হন। এভাবেই অনুভূতির ইনস্টিংক্টসগুলো শক্তপোক্ত হয়ে পরিপুষ্টতায় বিকশিত হয়। সেজন্যই বলতে ইচ্ছে করে - অনুভূতি ও কর্ম সাধনার যোগফলে কর্পোরেট হাউজের কর্ণধার হওয়া যায় কিন্তু বিত্ত ও প্রতিপত্তির জৈলুষে সারেগামা শিখে গায়ক হওয়া যায় না।