জালাল উদ্দিন আহমেদ
শিক্ষার অমানবিকতা
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ১৫ মে,শনিবার,২০২১ | আপডেট: ১০:৫২ পিএম, ২০ ডিসেম্বর,শুক্রবার,২০২৪
অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সাইয়িদ স্যারকে আমরা সবাই চিনি। তার বাগ্মিতা আমাদেরকে মুগ্ধ করে। বিশেষ কোন জটিল বিষয়কে সরলতায় ফেলে হাস্য রসাত্মক কায়দায় তিনি যেভাবে উপস্থাপন করেন তা সত্যিই অনন্য। এবং সেই কারনেই আমি এই শ্রদ্ধেয় অধ্যাপকের বক্তব্য বা ভাষনগুলো খুব মনোযোগ দিয়ে শুনি। তাঁর ছাত্র হওয়ার সৌভাগ্য আমার না হলেও তাঁর সমসাময়িক অধ্যাপক মোয়াজ্জেম হোসেনের সর্বকণিষ্ঠ ভাই হিসাবে সেই আবহেই আমি বেড়ে উঠেছি। অশতিপর বৃদ্ধ অধ্যাপক যখন তার পঞ্চাশোর্ধ ছাত্রদের উদ্দেশ্যে দেশ গড়ার কাজে উদবুদ্ধ করেন বা দেশের বিভিন্ন অসংগতির কথা ধরিয়ে দেন তখন সত্যিই সুড়ঙ্গের ফাঁক দিয়ে সেই আলোকবর্তিকা আমাদেরকে আলোকিত করে। আমরা এই মহান ব্যক্তিদের আলোকবর্তিকার ছটায় আলোকিত হই। তাদের দোয়া ও আশীর্বাদ নিয়ে আবার নতুন উদ্যমে পথ চলার রসদ খুঁজে পাই।
এই মানুষগুলো এখন আমদের সমাজ তথা রাষ্ট্রে খুব প্রয়োজন। নৈতিকতার অবক্ষয়ে সমাজ আজ উড়নচন্ডী ও দিশেহারা। রাষ্ট্রীয় অনাচারে ভূখন্ডের মানচিত্র নিয়ে আজ আমরা উদ্বিগ্ন। সবই আছে আমাদের। নেতা আছে কিন্তু নেতৃত্ত্ব নেই। রাজনীতিক আছে কিন্তু রাজনীতি নেই। প্রশাসক আছে প্রশাসন নেই। শিক্ষক আছে শিক্ষা নেই। এইসব থাকা না থাকার মধ্যেই আমরা বেঁচে আছি। কিন্তু হতাশার মধ্যেও আমাদের একজন শিরোমনি আছেন যিনি তার পিতৃ পরম্পরার আলোকছটায় আমাদেরকে মায়ের আঁচলে আগলে রেখেছেন। আমরা সৌভাগ্যবান যে করোনাকালীন এই অতিমারীর দংশনে এখনো আমরা শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়িয়ে আছি। এর সবটুকু কৃতিত্ব দিতে হবে সেই মহিয়ষী নেতৃত্বকে যার সাহসী ও দৃঢ়চেতা অবস্থানে আঠার কোটির জনবহুল এই ছোট্ট ভূখন্ডে এখনো আমরা মনুষ্য আচরনে দীপ্রমান।
বলছিলাম অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সাইয়িদ স্যারের কথার যাদু প্রসঙ্গে। তিনি তাঁর ছাত্রদের পুনর্মিলনীর বিভিন্ন অনুষ্ঠানে একটি কথা বেশ আবেগের সাথে উচ্চারন করেন। তিনি যা বলেন তার সারমর্ম হচ্ছে “এদেশে শিক্ষার হার বাড়ছে। ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার প্রশাসক তৈরী হচ্ছে। কিন্তু মানুষ তৈরীর গ্রাফটা বড়ই নিম্নমুখী। এই ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার তৈরী করতে বাংলার কৃষকের ঘাম ঝরানো টাকার শ্রাদ্ধ হয়। কিন্তু সেই ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার বা প্রশাসক প্রফেসররা দেশের সেবক না হয়ে বিদেশে পাড়ি দেয়। বাড়ি গাড়ি যশ সম্পদ সবই করে তারা সেখানে। আবার যারা দেশে থাকে তারাও চাহিদার অতলে থেকে এখানের দাপ্তরিক বা কর্মস্থলের নয়-ছয় করে অঢেল অর্থের মালিক হওয়ার প্রতিযোগিতায় নাম লেখায়। মন্ত্রী এমপি চেয়ারম্যান প্রশাসক হয়ে অনেকে বিদেশে তাদের সেকেন্ড হোম বানায়। তাদের বাবা মাকে বৃদ্ধাশ্রমে শেষ জীবন কাটাতে হয়। আবার বিদেশে অবস্থানরত কীর্তিমান বঙ্গ সন্তানেরা তাদের মা বাবা মারা গেলে তাদের সম্পত্তি বিক্রী করার জন্য এদেশে আসে এবং বাবা মায়ের প্রাপ্ত সম্পত্তির বিক্রয়লব্ধ টাকাটাও নিয়ে যায় বিদেশে। এক্ষেত্রে দেশের জন্য ন্যুনতম দায়বদ্ধতা তাদের আছে বলে মনে হয় না।
পাশাপাশি আর একটা শ্রেনীর মানুষ আমাদের আছে। যারা অল্প শিক্ষিত বা ক্ষেত্রবিশেষে অশিক্ষিতও বটে। তাদের পিছনে সরকারী বা দেশের বিনিয়োগ একেবারেই শুন্য। সেই তারাই আজ এক কোটির মত শ্রমজীবি মানুষ যারা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খেটে দেশে লক্ষ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছে। সেই অশিক্ষিত গরীব শ্রমিকদের কষ্টার্জিত টাকা দিয়ে আমাদের দেশের অর্থনীতির চাকা সচল হচ্ছে। গ্রামোন্নয়ন হচ্ছে। তাদের বাবা মায়েরা কস্মিনকালেও বৃদ্ধাশ্রমে থাকার দুশ্চিন্তায় ভুগে না। সুতরাং বাংলাদেশের খাঁটি মানুষ তো তারাই। তাদের পরিশ্রমের অর্থে বাংলা এই করোনা কালেও সচল ও সাবলীল রয়েছ।“ মোটামুটি এই ছিল শ্রদ্ধেয় আব্দুল্লাহ আবু সাইয়িদ স্যারের বক্তব্যের সারকথা। তিনি অবশ্য আরো একটি গুরুত্বপুর্ন কথা বেশ জোরের সাথেই বললেন তা হোল “ যেসব শিক্ষিত বঙ্গ সন্তানেরা বিদেশে নাম-যশ নিয়ে আছেন তাদের সেখানকার আয়ের কমপক্ষে শতকরা তিন ভাগ এদেশে এনে বিনিয়োগ করার বাধ্যতা মুলক ব্যবস্থা নিতে হবে। যদি তা না হয় তবে তাদের বাংলাদেশী পাসপোর্ট বাতিল করতে হবে।“
এতক্ষন ধরে এই যে এতসব কথা বা উপমা দেয়া হোল তা কিন্তু একটা উদ্দেশ্য নিয়েই উপস্থাপন করা হয়েছে। আমরা জানি এবং এই জানার মধ্যেই গত একবছরের অধিক কাল ধরে আমাদেরকে এই পরিস্থিতির মধ্যে যুদ্ধ করেই এগিয়ে যেতে হচ্ছে। করোনা ভাইরাসের ছোবলে গোটা বিশ্ব আজ তটস্থ এবং ক্ষেত্র বিশেষে ঘায়েলও বটে।আমরাও এর বাইরে নয়। ইতিমধ্যে গোটা বিশ্বে এই অতিমারীর ছোবলে তেত্রিশ লাখ মানুষের ভবলীলা সাঙ্গ হয়েছে। গোটা পৃথিবী আজকের এই করোনা সংক্রমনে জুবুথুবু হয়ে পড়েছে। যত দিন যাচ্ছে করোনা ছোবলের এই তীব্রতা ততই ভয়াবহ রূপ ধারন করছে। আমাদের দেশের সংক্রমনের হার উর্ধমুখী। সরকার তার সক্ষমতার মধ্যে থেকে দেশ ও জনগনের জন্য যথেষ্ট করে যাচ্ছে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার সর্বোত্তম পরামর্শ সরকারী পর্যায় থেকে বলা হচ্ছে। এমনকি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মিডিয়ায় এসে সাধারন ঘোষকের মত বাংলার আপামর জন সাধারনকে অনুরোধের সুরে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার জন্য অনুরোধ করছেন। সামনে ঈদ। রাস্তা বন্ধ। রেলপথ জলপথ সব বন্ধ। সীমিত আকারে আকাশ পথ চললেও তা না চলার মত। কিন্তু তারপরেও চাকরীজীবি ও কর্মজীবি মানুষজন যেভাবে ঢাকা ছেড়ে গ্রাম মফস্বলের দিকে ধাবিত হচ্ছেন শুধুমাত্র একটি দিনের ঈদ উৎসব পালনের জন্য তাতে করে করোনার সংক্রমন যে দ্রুত ছড়িয়ে পড়বে তাতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। এই প্রেক্ষিতেই এবার প্রশাসন থেকে ঈদের ছুটিও কমানো হয়েছে। তারপরেও মানুষের বাড়ি ফেরার ঢল কমছে না। এবং সেই কারনেই স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীকে জনগনের কাছে অনুরোধের সুরে আপিল করতে হচ্ছে। “ আপনারা যে যেখানে আছেন সেখানেই ঈদ করুন”। কিন্তু কে কার কথা শুনে। গাড়ি নেই তো কি হয়েছে। আটো, মাইক্রো, কার এমনকি এম্ব্যুলেন্স ভাড়া করে হলেও গ্রামের বাড়ি যেতে হবে। আরিচা শিমুলিয়া মাওয়ায় জনসমুদ্র তৈরী করে করোনা বিস্তারের আতংক ছড়াতে হবে। এবং তাইই হচ্ছে।
এখন আসা যাক আসল প্রসঙ্গে। শুরু করেছিলাম শিক্ষিত অশিক্ষিত শব্দ দুটি দিয়ে। যারা ঢাকা ছাড়ছেন তারা মোটামুটি শিক্ষিত কর্মজীবি সম্প্রদায়। কারন শ্রমিক কর্মচারী যারা তারা তো ঈদের আগের দিন পর্যন্ত নিজ কর্মস্থলে দেশের চাকা সচল রাখার মানসে মিল ফ্যাকটরীতে কর্মরত থাকবেন। আর গার্মেন্টসের ব্যাপারে তো নিশ্চয়তা পাওয়াই গেছে যে তারা কর্মস্থল ত্যাগ করবেন না। এটা কমিউনিটি থেকে বলা হয়েছে। তাহলে এই জন সমুদ্র করে সিন ক্রিয়েটের উদ্যোক্তা কারা? সত্যি কথা বলতে কি আবারো সেই শিক্ষিত সমুরদায়ের নামটাই সামনে আসে। যারা কেরানী বড় বাবু ছোটবাবু, যারা মাস শেষে মোটা টাকা বেতন পান, বোনাস পান তাদের তো আর হিসাব করতে হয় না। পাঁচ'শ টাকার মাইক্রো পাঁচ হাজার হলেও তাদের আপত্তি নেই। তিরিশ টাকার অটো তিন'শ টাকা ছুঁলেও তারা বদ্ধপরিকর যে মা বাবা ভাইবোন আত্মীয়ের কাছে যেতে হবে। এটা শিক্ষিত নিম্ন মধ্যবিত্তের সেন্টিমেন্টের ব্যাপার। শিক্ষা মানুষকে ভিশনারী করে, শিক্ষা মানুষকে সংযমী করে। কিন্তু এ কোন শিক্ষায় শিক্ষিত আমরা! দেশের সর্বোচ্চ আধিকারিক বিনয়ের সুরে আম জনতাকে অনুরোধ করছেন। “যে যেখানে আছেন সেখানেই ঈদ করুন।“ এটা তো সরকারী নির্দেশনার পর্যায়ে পড়ে। তারপরেও অনিয়ম হচ্ছে। আর এই অনিয়ম করছে কারা। সাধারন খেয়ে খাওয়া মানুষের সম্পৃক্ততা এখানে নগন্য। বিশেষ করে এই ঈদ যাত্রার বেলায় তা চোখ বন্ধ করেই বলা যায়।
আমাদের বোধদয় হবে কবে! আমারা পাশের বাড়ির কুম্ভ মেলার জন সমাগমের সমালোচনা করি। আমরা তাদের নির্বাচনী জনসভা ও নির্বাচনী র্যালির কথায় সমালোচনার ঝড় বইয়ে দিই। কিন্তু নিজেদের এই ঘরমুখী ঈদ যাত্রায় সংযমী হতে পারিনা কেন? আমরা কেন পর চর্চায় গগন বিদীর্ন করি। আপনি আচরি ধর্মের প্রতি এত উদাসীন কেন আমরা। মহামারী করোনার ছোবলে পার্শ্ববত্তী দেশের দীর্ঘশ্বাস কি আমাদের গায়ে পড়ছে না। আমরা কি দেখতে পাচ্ছি না কিভাবে গঙ্গায় শত লাশ ভাসছে। এইতো ফারাক্কার ওপারে। আমাদের স্বল্পতা আছে। রিসোর্সেস কম। তারপরেও আমাদের একজন যোগ্য শাসক আছেন, আছেন মমতাময়ী জননেত্রী। মায়ের আকুলতা দিয়ে তিনি বাংলার বাঙালীকে বাঁচাতে জানেন। সেই কর্ম যজ্ঞেই তিনি গত একটি বছর রাতদিন এক করে তার প্রশাসন যন্ত্রকে তটস্থ রেখেছেন। এবং এটা আমাদের জন্যই। বাঙালী সচেতন হোন। আপন উঠানকে করোনা মুক্ত করার জন্য সরকারী নির্দেশনার পাশাপাশি একটু আত্মসচেতন হওয়া একান্ত জরুরী। আমরা করোনাকে জয় করবো ইনশা আল্লাহ! বিশ্ব করোনা মুক্ত হোক। দেশ করোনার ছোবল থেকে অব্যাহতি পাক। কায়মনোবাক্যে এটাই কামনা করি।
***সবাইকে ঈদ মোবারক***