জালাল উদ্দিন আহমেদ
ভারত – হিন্দুত্ববাদের ধর্মীয় ছোবল
প্রকাশ: ০৭:৫৬ পিএম, ১৭ এপ্রিল,শনিবার,২০২১ | আপডেট: ০৩:০৯ পিএম, ২২ ডিসেম্বর,রবিবার,২০২৪
ভাবনাগুলো শুধুই কানাকানি করছে। মনের মধ্যে আঁকুপাঁকু করছে আর বেরিয়ে আসার জন্য ছটপট করছে। মনতো! তাই মানতে চায় না। তবে এসব ভাবনা নিজের জন্য কতটুকু করতে পারছি তা না হয় শিকেই তুলে রাখি। কারন যাদের জন্য ভাবছি তারাও আমার স্বত্ত্বা। শেকড় তো একই জায়গায় প্রোথিত। স্বাধীন ভূখন্ডের সীমানা পেরিয়ে যে বাঙালীয়ানার স্বত্ত্বা নিয়ে ওরা বাঙালী হয়েও ভিনদেশী, তারা তো পরম্পরায় বাঙালীই। ধর্মীয় গোঁড়ামীর অবিশ্বাসে বাঙালী যখন দ্বিখন্ডিত হোল তখন বাংলা মায়ের নাড়ি ছেঁড়ায় এ ভূখন্ডে যে রক্তক্ষরন হয়েছিল তা কি সহজে মুছে যাবে! আমি সেই বাঙালীদের কথা বলছি যারা নিজেদেরকে হিন্দু বাঙালী পরিচয়ে হিন্দুস্থানী হয়েছিল। তাদের সেই হিন্দুস্থানী হওয়ার মন্ত্র দাতারা এখন বাংলাকে বাংলায় রাখতে চাচ্ছে না। ধর্মীয় খাঁচায় ঢুকিয়ে বাংলাকে হিন্দুস্থানী আদলের “হিন্দু বাংলা” বানাতে চাচ্ছে।
সর্ব ধর্মের সহবস্থানে থাকার মন্ত্র গাঁথায় ভারত নামের রাষ্ট্র যখন সাতচল্লিশে তার নিজের অস্তিত্ত্বে স্থিতি পেল তখন ভারতকে ধর্ম নিরপেক্ষ প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবে ঘোষনা করা হোল। তারই ধারাবাহিকতায় ভারতকে মহান ভারত হিসাবে উপস্থাপনে তৎসময়ের শাসকেরা তাদের মেধা ও শ্রম লাগিয়েছিলেন। বর্তমান প্রেক্ষাপটে ভারত পৃথিবীর সর্ব বৃহৎ গনতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবে খ্যাতি লাভ করেছে। কিন্তু ধর্মীয় লাগাম লাগিয়ে ভারত ভেঙ্গে যখন পাকিস্থান নামক মুসলিম ধর্মীয় রাষ্ট্রের পত্তন ঘটলো তখন সর্ব ধর্মের অবয়বে রয়ে যাওয়া হিন্দু প্রাধান্যের ভারত হিন্দু ধর্মের সাজুয্যে “হিন্দুস্থান” নামক ট্রাম কার্ডটি পকেটে রেখেই তাদের যাত্রা শুরু করে। ভাবখানা এমন ছিল যে, মুসলমানেরা যেমন ইসলামী জোশের “পাক” নামার প্রাধান্যে পাকিস্থান গঠনে এগিয়েছে পাশাপাশি হিন্দু ধর্মের ঘাপটি মারা নেতৃবৃন্দ তাদের মনের খায়েশে “হিন্দু” নামের সাথে হিন্দুস্থান রাষ্ট্রটির স্বপ্নে বিভোর থেকেছে। এক্ষেত্রে “হিন্দুস্থান” ভারতের সরকারী স্বীকৃত নাম নয়। এটা প্রচলিত এবং ধর্মকে সামনে রেখে চলার প্রবনতা মাত্র। তাছাড়া এগার শতকের দিকে ভারতে যখন এশিয়া মানরের মুসলমানেদের আগমন ঘটলো সে সময় তারা সিন্ধু উপতক্যার মানুষদেরকে হিন্দু বলে সম্বোধন করতেন। অর্থাৎ সিন্ধু তাদের উচ্চারনে হিন্দু হয়ে গেল। এভাবেই হিন্দু থেকে সমতল ভূমির নাম হিন্দুস্তান হয়ে গেল। ভারত একটি সংযুক্ত রাষ্ট্র কাঠামোয় প্রতিষ্ঠিত ডমিনিয়ন রিপাবলিক। প্রায় ৩০ টি ভিন্ন জাতি ধর্মের রাজ্য কাঠামোর সংযুক্ত রাষ্ট্র হলো ভারত বর্ষ। তবে ধর্মীয় বিবেচনার হিন্দু ধর্ম গরিষ্ঠতায় এই রাষ্ট্রের পথচলা।
১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা লাভের পর সংযুক্ত ভারত রাষ্ট্র হিন্দু প্রাধান্যেই শাসিত হয়েছে। সময়ের পথ পরিক্রমায় তাদের হিন্দু ইজমের প্রাধান্যেই তারা ভারত শাসন করেছে যদিও তা সরকারী ঘোষনায় সর্ব ধর্মের সেক্যুলার রাষ্ট্র হিসাবে ঘোষিত হয়েছে। প্রচলিত প্রথায় তাই তারা ভারতকে হিন্দুস্থান নামেই বেশী বেশী করে প্রচার ও প্রসার ঘটিয়েছে। সেই ভারত এখন ধর্ম পরম্পরার ধর্মীয় মৌলবাদী অর্থাৎ হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির ঘোরটোপে চলমান গনতান্ত্রিক রাষ্ট্র। ভারতের কেন্দ্রীয় শাসন এখন ধর্মীয় রাজনীতির ধারক একটি হিন্দুত্ববাদী মৌলবাদী রাজনৈতিক দলের হাতে। যাদের লক্ষ্য হচ্ছে ভারতকে হিন্দুস্থান রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠা দেয়া। তারই ধারাবাহিকতায় ইদানীংকার সময়ে ভারতে হিন্দু ইজমের রমরমা অবস্থা। কেন্দ্রীয় শাসন ক্ষমতার দন্ডে বিদ্যমান ধর্মান্ধ দলটির ইচ্ছায় সারা ভারত জুড়ে হিন্দু ইজমের প্রচার ও প্রসারে তারা আদাজল খেয়ে মাঠে নেমেছে। সর্ব ভারতীয় আঙ্গিকে প্রাচীন ভারতের আর্য ব্রাহ্মন্যের রাম রাজত্ব প্রতিষ্ঠায় তারা ইদানীং গলদঘর্ম পরিশ্রম করে যাচ্ছে। যেখানেই বাধার সম্মুখীন হচ্ছে সেখানেই তারা সর্ব শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। সম্প্রতিকালের রাজ্য বিধান সভার নির্বাচন গুলির চালচিত্র তারই সাক্ষ্য দেয়।
ভারতীয় আঙ্গিকে বাঙালী অধ্যুষিত পশ্চিম বঙ্গ রাজ্যটি সব সময় রাজনীতি সচেতন। ফলে ভারতীয় স্বাধীনতার পৌনে এক'শ বছর হতে চললেও পশ্চিম বাংলার রাজনীতি সব সময় ভারতীয় তুল্য মুল্যে একটু অগ্রনীই বলা চলে। হিন্দু মুসলমান কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নিজেদের রুটি রূজির সংস্থানে তারা সব সময় নিজেদের স্বকীয়তায় উজ্জ্বল থেকেছে। ধর্মীয় গোঁড়ামীর ফাঁদে বাঙালী কখনই পা ফেলেনি। যদিও বাংলার ছেচল্লিশ সাতচল্লিশের সময়কালে বাঙালী মস্তিষ্ক প্রসূত সেই রাষ্ট্রীয় সেবক সংঘ বা জনসংঘ আজ ভারতের ধর্মীয় মৌলবাদের মূল সূত্র হয়ে কেন্দ্র শাসনের দন্ডে প্রবল প্রতাপশালী এক ভারত সরকার। সর্ব ধর্মের সমন্বয়ে গঠিত তৎসময়ের অপ্রতিদ্বন্দী কংগ্রেসের পেট চিরেই বেরিয়ে আসা সেদিনের সেই আরএসএস এবং পরবর্তীকালের রাজনীতির অনুশীলনের জনসংঘ আজ ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) হিসাবে ভারত শাসনের অধিকর্তা হয়ে ভারত জুড়ে রাম রাজত্ব প্রতিষ্ঠার প্রয়াসে রাত দিন এক করে ফেলছে।
বাঙালী সব সময় স্বাধীন স্বত্ত্বায় বহুমত ও পথের দিশায় রাজনীতির উঠানে বিরাজ করেছে। ফলে ইদানীংকার অর্থাৎ একুশের বিধান সভার নির্বাচনে দেখা যায় বাঙালীর নিজস্ব সংগঠন বলে কিছু নেই। তারা রাজনীতির আদর্শ ও পথকে এক করে ফেলে বহু ধারায় বিভক্ত থাকতেই বেশী স্বাচ্ছন্দ বোধ করেছে। আজকের পশ্চিম বঙ্গ পর্যালোচনায় দেখা যায় যত মত তত পথ অনুসরনে বাঙালী বহুধা বিভক্ত। এই সুযোগটাই বোধ হয় কেন্দ্রীয় মৌলবাদী রাজনীতির ধারকরা কাজে লাগাতে চেয়েছে। ফলে তাদের ধর্ম ভিত্তিক রাজনীতি ও ভোটের হালচালে দেখা যাচ্ছে যে এক উল্লেখ্যোগ্য সংখ্যক ধর্মাশ্রিত মানুষ ধর্মের বাজিতেই পক্ষ নিয়েছে। মৌলবাদী রাজনীতির পক্ষটি হিন্দু গরিষ্ঠের সংখ্যাধিক্যে রাজনীতির ট্রাম কার্ডটি ব্যবহার করতে পিছপা হচ্ছে না। সেই লক্ষ্যে সংস্কৃতি জগতের আইকন কিংবা রাজনীতির গজিয়ে উঠা নতুন প্রভাবশালী রাজনীতিকদের কিনে নিয়ে তাদের উঠানকে পাকা করতে চাচ্ছে তারা। পাশাপাশি ধর্মীয় ভোজবাজির সেই ধর্মীয় ট্রাম কার্ডটিও তারা হাতে রেখেই এগোচ্ছে। বিশেষ করে অনগ্রসর শ্রেনীর নিম্ন সম্প্রদায়ের হিন্দুদেরকে “দিয়ে থুয়ে” নিজের ঘরে টানার এক মহোৎসবে বিজেপি নামের ওই মেগা রাজনীতির পক্ষটি বাংলার চিরায়ত “সচেতন” নামক শাখা প্রশাখাকে দুমড়ে মুচড়ে খান খান করার প্রয়াসে দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। ওদিকে রাজনীতির বহুধাবিভক্ত প্লাটফরমের বিভাজনে বাঙালীর রাজনৈতিক অস্মিতা কিছুটা হলেও খন্ডিত আকারে প্রকাশ পাচ্ছে। ফলে সুযোগের সদব্যবহারে উগ্র সাম্প্রদায়িক দলটি তাদের ঘর গোছানোর কাজে সফলকাম হচ্ছে বলেই মনে করার যথেষ্ট কারন দেখা যায়।
২০১৯ সালে গোটা ভারত জুড়ে দিল্লি শাসনের লোকসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সে সময় বিজেপি নামক ওই সাম্প্রদায়িক দলটি ভারত পাকিস্থান সীমান্ত সংঘর্ষের অজুহাতে হিন্দু মুসলিম জিগির তুলে ভারত জুড়ে এক হিন্দু জাগরনের জোয়ার সৃষ্টি করে। হিন্দুস্থান রক্ষার একমাত্র প্লাটফরম হিসাবে বিজেপিকে উপস্থাপনে কামিয়াব হয় তারা। ফলে সেই রেশ পশ্চিম বঙ্গের মত অতি রাজনৈতিক সচেতন রাজ্যটিতেও এসে পড়ে। বিশেষ করে অতি ব্রাহ্মন্য গোষ্ঠি ও নীচু বর্নের হিন্দুদের একাত্মতায় তারা পশ্চিম বঙ্গের লোকসভা আসনের প্রায় অর্ধেক সীট দখল করে নেয়। যে বিজেপির কোন নাম নিশানাই ছিলনা ওই পশ্চিম বঙ্গের মাটিতে সেই বিজেপি তার ধর্মীয় জোশ ও জৌলুশে পশ্চিম বঙ্গ লোক সভার প্রায় অর্ধেক সিট জিতে নেয়। তাইতো এবারের পশ্চিম বঙ্গ বিধান সভার নির্বাচনে তাদের শ্লোগান হয়েছে - 'ঊনিশে হাফ একুশে সাফ”। অর্থাৎ বর্তমানের বাংলায় তৃনমূল কংগ্রেসের শাসনকে চ্যালেঞ্জ করে তারা এই শ্লোগান সামনে এনেছে। আরো ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক শ্লোগান তারা উচ্চারন করছে যা সাম্প্রদায়িক উস্কানীর পর্যায়ে পড়ে। তবে যেহেতু তারা ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক রাজনীতির পীঠস্থান সুতরাং সেসব ক্ষেত্রে তাদের সেসব শ্লোগান শুধুমাত্র তাদেরই। এক্ষেত্রে তা সাধারন রাজনীতির শ্লোগানে পড়েনা বিধায় সেসব ধর্তব্যে না নেয়াই যুক্তিযুক্ত।
পশ্চিম বঙ্গের এবারের বিধান সভা নির্বাচনের একটি বৈশিষ্ঠ্য হোল এক ছেষট্টি বছর বয়ষের নারীর একক নেতৃত্বের তৃনমূল কংগ্রেস বনাম বাংলার অন্যান্য রাজনীতির দল এবং কেন্দ্রীয় ক্ষমতার প্রবল পরাক্রমশালী রাজনৈতিক দল বিজেপির লড়াই। এটা স্মরন কালের ঐতিহাসিক নির্বাচনী লড়াই বললেও ভুল হবেনা। কেননা এই নির্বাচন একটি একক নেতৃত্বের তৃনমূল কংগ্রেসের মমতা ব্যানার্জী বনাম দিল্লির কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতাসীন পার্টির সম্মুখ সমর। এটা শুধু আমার উপলব্ধি নয়। গোটা ভারতীয় উপমহাদেশসহ সারা বিশ্ব দেখছে রাজ্য সরকারের এক নারী নেত্রীকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য কেন্দ্রীয় প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ও অন্যান্য বড় বড় কেন্দ্রীয় পদাধিকারীসহ পার্শ্ববর্তী বিজেপি শাসিত রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরা দিল্লি-কোলকাতা ডেইলি প্যাসেঞ্জারী করছেন এবং প্রত্যহ নির্বাচনী জনসভা ও র্যালিতে অংশ নিচ্ছেন। এতে করে তাদের দেশের নির্বাচনী বিধিমালার কোন ব্যতয় ঘটছে কিনা তা তারাই বলতে পারবেন। এক্ষেত্রে ধর্মীয় অনুশাসনের কেন্দ্রীয় ক্ষমতাধর দলটি কতটা বেপরোয়া হলে পশ্চিম বঙ্গের নির্বাচনী ময়দানে প্রত্যহ হিংসা বিদ্বেষ ও অসংলগ্ন কথাবার্তার নির্বাচনী প্রচারনায় অংশ নেয় তা এবারকার নির্বাচনী প্রচার ও প্রচারনায় তা টের পাওয়া যায়। তাছাড়া পশ্চিম বাংলার মত একটি ছোট্ট রাজ্যের স্থানীয় বিধান সভার নির্বাচনে মাস জুড়ে আট দফায় ভোট নেয়ার যে সাজানো ফন্দি ফিকিরে দিল্লি সরকার এগিয়েছে তাতে স্পষ্টতঃ প্রতীয়মান হয় যে এ রাজ্যের স্থানীয় শাসন ব্যবস্থা ওই মৌলবাদী দলটি কব্জা করতে বদ্ধ পরিকর। এবং সে পথেই তারা এগোচ্ছে বলে মনে হয়। কেননা, তিরিশটি রাজ্য সমষ্টির ভারত নামক বৃহৎ রাষ্ট্রটির সরকার প্রধান যখন পুচকে এই রাজ্যটির শুধুমাত্র বিধান সভা ভোটের জন্য ইতিমধ্যে পঁচিশ তিরিশটি রাজনৈতিক জনসভা সম্পন্ন করেন এবং আরো ডজন খানেক জনসভা করার জন্য তিনি ইচ্ছা প্রকাশ করেন তখন সাদা চোখেই বুঝা যায় এই রাজ্যে ক্ষমতা দখলে মৌলবাদী দলটি কতটা বেপরোয়া। তাদের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী ও সর্ব ভারতীয় বিজেপির সাবেক সভাপতি অমিত শাহ যেভাবে দিল্লি কোলকাতা দৈনন্দিন আসা যাওয়া ও জনসভা এবং রোড'শো করছেন তা সত্যিই অভূতপুর্ব এক ঘটনা। তাছাড়া তিনি হিন্দু মুসলিম বিভাজনের সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প যেভাবে পশ্চিম বঙ্গে ছড়াচ্ছেন তাতে ধরে নেয়া যায় যে “যেন তেন প্রকারেন” তারা বাংলার ক্ষমতা নিতে বদ্ধপরিকর। এছাড়া রাজ্য বিজেপির বাঙালী কর্নধাররা যেভাবে সাম্প্রদায়িক হিংসার বিষ ছড়িয়ে বাংলাকে বিষিয়ে তুলছেন তাতে হিন্দু সংখ্যা গরিষ্ঠের পশ্চিম বঙ্গ সম্ভবতঃ আর বাঙালী অস্মিতায় বিদ্যমান থাকবে বিলে মনে হচ্ছেনা। ওদিকে সাতচল্লিশের জিঘাংসার শিকার বাঙাল বাবুদের একটি অংশ যারা ভারতীয় ও বাংলা আঙ্গিকের মিডিয়া জগতে যশ ও খ্যাতি পেয়েছেন তাদেরই একজন ফাটা কেষ্ট যেভাবে গায়ে গেরুয়া ও মাথায় পদ্ম ফুলের ফেটি বেঁধে মাঠে নেমে বাংলায় তার এবং তাদের পায়ের মাটি শক্ত করার প্রয়াসে মাঠে নেমেছেন তা সত্যিকার অর্থেই আশংকার কারন বলে বিদগ্ধজনেরা বলাবলি করছেন।
কয়েকদিন আগে একজন আরএসএস প্রবক্তার মুখে শুনলাম ভারত হচ্ছে হিন্দুদের দেশ। এখানে হিন্দুরাই অধিবাসী। আজকের পাকিস্থানের নাগরিকরাও যেমন হিন্দু তেমনি গোটা ভারতবর্ষের জনগন হিন্দু নামেই পরিচিত। অর্থাৎ তিনি বলতে চাইলেন হিন্দু একটি জাতি। সেটা কোন ধর্মীয় প্রোফাইলে ফেলা যাবেনা। কথাটির যথার্থতা আছে বৈকি! কারন ভারতীয় সভ্যতার বিকাশ ঘটেছে সিন্ধু নদের অববাহিকার বসতি স্থাপনকারী জাতির সমষ্টিতে। প্রাচীন ভারতে সিন্ধুনদকে হিন্দু নদ নামেও ডাকা হোত। তারই ধারাবাহিকতায় সিন্ধু থেকে হিন্দু উচ্চারনটি এসেছে। কিন্তু বিভ্রাট্ট বেঁধেছে তখনই যখন মুর্তি পুজারীরর কয়েকটি গোষ্ঠী মিলে তাদের ধর্মকে হিন্দু ধর্ম প্রচার করে তারা হিন্দু জাতি হিসাবে সামনে আসতে চেয়েছে। বিষয়টি তখনই ধর্মীয় আবেগে মুড়িয়ে গেছে। সত্য কথা বলতে কি, হিন্দু ধর্ম বলতে কোন ধর্ম আগেও ছিল না এখনও নেই। মুর্তি পুজারীর সনাতন ধর্মে বিশ্বাসীরা এদেশে হিন্দু ধর্মের লোক বলে দাবি করে যা এর পক্ষে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় না। তাছাড়া সেটা প্রমান করে প্রতিষ্ঠা দেয়ার সক্ষমতাও তাদের আছে কিনা তাতে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। যোগী আদিত্যনাথ,, বিজেপি শাসিত উত্তর প্রদেশ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। তিনি বিজেপির ডাকসাইটে নেতাও বটে। সে যোগীজির এক মত বিনিময় সভায় বোরকা পরিহিত এক মহিলা যখন জিগ্যেস করলেন “ আপনারা হিন্দু হিন্দু করে এত লাফাচ্ছেন কেন? হিন্দু বলে কোন ধর্ম ভারতে বিদ্যমান নেই। ভারতবাসী আমরা সবাই হিন্দু। ধর্ম নিয়ে হিন্দু হিন্দু করার মানে কি”? কথাটি শুনে যোগোজির মুখটা ফ্যাকাশে হলেও একটু তৃপ্তির হাসি হেসে তিনি বললেন “ ঠিক আছে এটাই তো আমরা চাই। আপনি নিজেকে হিন্দু বলে স্বীকার করেছেন এটাই যথেষ্ট”। আর এক প্যান্ট শার্ট পরা মহিলা জিগ্যেস করলেন “তাহলে এটা প্রচার করতে আপনাদের অসুবিধা কোথায় যে ভারতীয় নাগরিক মানেই হিন্দু। কিন্তু ধর্মীয় হিন্দু নয়। কেন আপনারা হিন্দু কথটিকে ধর্মীয় প্রফাইলে ফেলে দেশে হিংসা বিদ্বেষ ছিড়িয়ে সংখ্যা লঘুদের চাপে ফেলতে চাচ্ছেন”। সে সময় লক্ষ্য করলাম যোগীজি নিরুত্তর থাকলেন। ঠিক যেন আমির খানের “পিকে” সিনেমার সেই সাধুর মত। যখন সাধুকে জিগ্যেস করা হলো “ আপনি প্রমান করুন আপনার ওই লাল নীল বাতি ওয়ালা বস্তটিতে ভগবান আছেন” ইত্যাদি ইত্যাদি।
যাহোক ধর্মীয় উচ্চবাচ্যে কখনোই জমিনে শান্তি বয়ে আনে না। ধর্ম যার যার উৎসব সবার এই চিরায়ত আবহেই বাঙালী তার সমাজ জীবনের আদল সাজিয়েছে। সুতরাং এবারের বাংলার বিধান সভার নির্বাচনে সেই ধর্ম আচারের ভ্রাতৃত্ব অটুট থাকবে, না ধর্মীয় কচকচানির জয় শ্রীরাম বা হরে হরের বিকট আওয়াজে ভারত বিভাজনের ডংকা বাজানো নতুন করে শুরু হবে তা সময়ই বলে দেবে। আশা করি ভারত তার পুরনো ঐতিহ্যে ফিরে এসে উপমহাদেশে শান্তির বাতাবরন ছড়িয়ে দেবে। এটা ভারতের সাধারন মানুষের কথা। এটা শান্তির কথা- সমৃদ্ধির কথা।