জালাল উদ্দিন আহমেদ
অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী
প্রকাশ: ০২:১৪ পিএম, ১০ ফেব্রুয়ারী, বুধবার,২০২১ | আপডেট: ০৬:৪৪ এএম, ১৯ ডিসেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
রাজনীতি থেকে পঠন পাঠন বোধ হয় আজকাল উঠে গেছে। আজকাল রাজনীতি করার জন্য বিদ্যা চর্চা বা জ্ঞানার্জনের কোন প্রয়োজন পড়ে বলে মনে হয়না। অবশ্য এসব বাক্য উচ্চারন করা আমার মত এই অর্বাচীনের ধৃষ্টতা ছাড়া আর কিইবা হতে পারে! লেখাপড়া শেষে চাকরী বাকরী করে এখন অবসরের আদম হয়ে প্রৌঢ়ত্বে বসবাস আমার। সময় কাটে লেখালেখি বা পেশাজীবির পেশাগত দু- চারটে বক্তৃতা বিবৃতি দিয়ে। আর এই বয়সের আড্ডা বলতে সম বয়সীদের সাথে উঠা-বসা, গল্প গুজব করা ইত্যাদি। বন্ধু বান্ধব বেশী না থাকলেও চলার এই অবসরীয় আদলে ইদানীং বহুমুখী মানুষের সাথে পরিচয় ঘটে। বন্ধুত্বও হয়ে যায়। ফলে সেই বন্ধুত্বের আঙ্গিনায় থাকে বহুমুখী আলাপ চারিতার ঝুড়ি ভরা উপাদান। কি নেই সেখানে! সমাজনীতি, রাষ্ট্রনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষানীতি, স্বাস্থ্যনীতি, শিল্পনীতিসহ সবকিছু সেখানে এই অবসরীয় আদমদের নাকের ডগায়। তবে যেটা সব কিছুকে ছাপিয়ে আলোর দ্যুতি ছড়ায় তা হোল রাজনীতি। বাঙালী থাকবে, সেখানে রাজনীতি থাকবে না তা কি করে হয়! কালে ভদ্রে আজকের যুগের রাজনীতির মহারথীরাও বন্ধু হয়ে থাকেন সেসব আড্ডায়। প্যান্ডেমিকের এই সময়ে রাজনীতিও তো মোটামুটি জড়সড় হয়ে বসে আছে। যদিও অতি উৎসাহী স্থানীয় নির্বাচবের নামে যা চলছে তা তো এক পক্ষীয় ব্যাপার স্যাপার। এখন তো দেশে শুক্ল পক্ষীয় সময়ের রমরমা অবস্থা। ওদিকে কৃষ্ণপক্ষীয়রা তো শুয়ে বসেই কাটাচ্ছে মোটামুটি এক যুগ হোল। তবে মামলা হামলার খড়্গ নিয়েই তাদের এখন ব্যতিব্যস্ত থাকতে হয়। তবুও জীবন তো আর থেমে থাকে না। সমাজবদ্ধ জীব হিসাবে তারাও সমাজ জীবনে সচল রয়েছেন।
আড্ডা সাধারনতঃ ঘরোয়া বা ভার্চুয়াল মাধ্যমেই হয়ে থাকে। তবে সময় ক্ষেপনের যে আড্ডা আমাদের বাঙালী ঠিকুজিতে রয়েছে তা কিন্তু এখনকার সময়ে হবার নয়। পরনিন্দা, পরচর্চা বা “নাই কাজ তো খই ভাজ” এর উন্মুক্ত পরিবেশ এখন কি আর আছে! করোনা ছোবলে এখন সব কেমন যেন স্তিমিত হয়ে গেছে। তবুও বাঙালী বলে কথা! কোথাও থেমে নেই বাঙালী জীবন। সবই তো সাবলীল মনে হচ্ছে জীবন চলার কুন্ডলীতে। তবে সীমিত ক্ষমতা ও নিজস্ব স্বকীয়তা ও দক্ষতার জেরে বাঙালী প্যান্ডেমিকের এই ঘন দুর্যোগপুর্ন দিনগুলির সবকিছুতে কেমন যেন গুছিয়ে নিয়েছে বলেই মনে হয়।
জীবনে চলার কোনো আঙ্গিকেই বাঙালী থেমে নেই। শুধু ক্ষতি যা হচ্ছে শিক্ষা ব্যবস্থার। কোমলমতি লক্ষ কোটি বাচ্চারা গৃহবন্দি হয়ে আজ ডিজিট্যালাইজেশনের বরপুত্র। গ্রামের দাদু বা বাবাদের ছেলে মেয়ের ভার্চুয়্যাল ক্লাস করার যাতে ব্যাঘাত না ঘটে তার জন্য বাঁশের কঞ্চি কেটে মোবাইল স্ট্যান্ড বানানোর বিজ্ঞাপন দেখেই বুঝা যায় কোন পর্যায়ে আছে আমাদের সন্তান সন্ততিরা। তার উপরে সরকারী অতি উৎসাহের কল্যানে যখন তারা বিনা পরীক্ষায় শতভাগ পাশের নিশ্চয়তায় চলে আসে তখন সেটা তাদের বিদ্যাশিক্ষার বুনিয়াদ ধংসের প্রথম রিহার্সাল কিনা তা বিদগ্ধ জনেরাই ভাল বলতে পারবেন।
যাহোক, কথা শুরু করেছিলাম রাজনীতির পঠন পাঠন ও রাজনীতি বিদদের শিক্ষানুরাগী হওয়ার কথা দিয়ে। আমাদের দেশে আজকাল লেখাপড়া শিখে বা অনুশীলনের কৃচ্ছ্বসাধনের মাধ্যমে রাজনীতি করে উঠে আসার সেই ঐতিহ্যগত পটভূমি নেই। একজন ভাল মানুষ তার কর্ম সাধনা ও রাজনীতির আদর্শে জনগনের ভালবাসা নিয়ে জনসেবক হয়েছেন তো ব্যাশ! তখন সেই ভাল মানুষটি তার রাজনীতির দম্ভ ও দন্ডে একছত্র অধিপতি হয়ে বিচরন করেন। সেক্ষেত্রে রাজনৈতিক দন্ড মুন্ডের কর্তা হয়ে তখন তার নীতি ও নৈতিকতার সমস্ত কিছুকে বিসর্জন দিয়ে বিশাল প্রভাব ও প্রতিপত্তির অধিপতি হন তিনি। এক সময় রাজনৈতিক আচার আচরনের ফসল হয়ে তখন তার ক্ষমতা পারিবারিক বলয়ে আঁটকে পড়ে। সেক্ষেত্রে তখন তার উত্তরাধিকারী হিসাবে রেখে যাওয়া অঢেল প্রভাব ও প্রতিপত্তির ওয়ারিশি উত্তরাধিকারীরা রাজনীতির মহা উত্তরাধিকারী হয়ে আমাদের রাজনীতি ও রাষ্ট্রনীতির আঙ্গিনায় দৌর্দন্ড প্রতাপে আবির্ভূত হন। আর এই রাজনীতির পরিপাশে গড়ে উঠে এক অশুভ শক্তির মাসলম্যান বাহিনী, যাদের দাপট ও আচরনের আঙ্গিকেই পরিচালিত হয় রাজনীতির বর্তমান সময়ের বহমান কালচার বা সংস্কৃতি। রাজনীতির এই বহমান সংস্কৃতিতে আজকাল এরাই দেশের কর্তা হয়ে জেঁকে বসেছেন। রাজনীতির সবক বা জ্ঞানার্জনের মাধ্যমে অনুশীলন করে উঠে আসার অপরিহার্যতায় এরা পড়েন না। রাজাধিরাজের ঐতিহ্যগত পরম্পরা নিয়ে এদের জীবনসূর্য উদিত হয়। আজকের রাজনীতির উঠানে এরা রক্ষক হয়ে ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীন হন। এদের প্রয়োজন পড়ে না রাজনীতির প্রথম পাঠে বিচরন করা। এদের প্রয়োজন পড়ে না বাঙালীর ইতিহাস ও ঐতিহ্যের খবর নেয়ার। এরা জানে না বা জানতে চায় না যে ভারতীয় উপমহাদেশে বাঙালী এক সময় কত শক্তিশালী ভূমিকায় বিচরন করতো। ইতিহাস সৃষ্টিকারী প্রবাদ প্রতীম বাঙালী রাজনীতি বিদদের বিশেষ করে পুর্ব বাংলার মুসলমান রাজনীতির মহারথীদের কথা এদের জানার প্রয়োজন পড়েনা। কোন্ কৃচ্ছ্বসাধনার ফসল হিসাবে শ্রেষ্ঠ বাঙালীদের উত্তর পুরুষ হয়েছেন- এরা তা জানে না বা জানতে চায় না। এরা শুধু ক্ষমতা ও বিত্ত বৈভবের সংস্কৃতি নিয়েই বড় হতে চায় - নেতা হতে চায় - সম্মান চায় - সালাম চায়। রাজাধিরাজ স্টাইলে তাদের রাজনীতির চাকা সচল রাখতে চায়।
আমি হলফ করে বলতে পারি – এরা জানে না বৃটিশ ভারতে বাংলা এক সময় স্বাধীন স্বত্ত্বা নিয়ে পরিচালিত একটি ভূখন্ড ছিল। বৃটিশ ইন্ডিয়ায় বাংলা আলাদা স্বাধীন স্বত্ত্বা নিয়ে শসিত ছিল। বাংলার জন্য আলাদা গভর্নর পদ প্রচলিত ছিল। এমনকি, অবিভক্ত বাংলায় প্রধানমন্ত্রীর পদও চালু হয়েছিল। ভারত শাসন আইন ১৯৩৫ এর আওতায় এই পদ সৃষ্টি করা হয়। ১লা এপ্রিল ১৯৩৭ হতে ১৪ই আগষ্ট ১৯৪৭ পর্যন্ত এই সনদে বাংলা পরিচালিত হয়েছিল। সেই সুত্রে অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রীর পদ ছিল। ছিল তার নিজস্ব মন্ত্রীসভা। কোলকাতা ছিল তার রাজধানী। বৃটিশ ভারতে বাংলার প্রথম প্রধানমন্ত্রী ছিলেন আমাদের এই মাটির গর্বিত সন্তান শেরে বাংলা একে ফজলুল হক। ভারতীয় আঙ্গিকে একে ফজলুল হক “শের ই বাংলা” উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন। এবং এটাও হয়তো আমাদের জানা দরকার যে এই “শের ই বাংলা” উপাধিটি তিনি পেয়েছিলেন সর্ব ভারতীয় আঙ্গিকে ১৯৩৭ সালের লখ্নৌতে অনুষ্ঠিত মুসলীগ লীগের জাতীয় সম্মেলনে। শের ই বাংলা অবিভক্ত বাংলার প্রথম প্রধানমন্ত্রী। দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রী ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। এরপর খাজা নাজিম উদ্দিন, প্রফুল্ল ঘোষ, বিধান রায়ও বাংলার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তবে তারা বিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হলেও প্রধানমন্ত্রী হিসাবে বিবেচিত হন কারন সাতচল্লিশের বিভক্ত বাংলায় তখনও বৃটিশ ইন্ডিয়া রুলিং এক্টের সেই ধারাতেই স্বাধীন ভারতের পশ্চিম বংগ এবং পাকিস্থানের পুর্ব বাংলা শাসিত হয়েছিল। কারন ভারত শাসন আইন ১৯৩৫ স্বাধীন ভারতে রদ হয় ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারী এবং স্বাধীন পাকিস্থানে তা বাতিল হয় ২৩ মার্চ ১৯৫৬ সালে। তাদেরকে জানতে হবে আজকের দিনে আমাদের প্রিয় বঙ্গবন্ধু কোন্ রাজনৈতিক আদর্শে বড় হয়ে তার রাজনীতির পরিপুর্ণতা ঘটিয়েছিলেন। পাকিস্থান আন্দোলনের অমিত তেজী যুবনেতা হিসাবে বাঙালীর প্রিয় মুজিব ভাই থেকে বঙ্গবন্ধু এবং বাঙালীর স্বপ্নের জাতির পিতা হয়েছেন। তাদেরকে জানতে হবে কেন মুসলমানদেরকে ভাবতে হয়েছে তাদের নিজস্ব মা ও মাটির কথা। এটাও তাদের জানতে হবে কেন বাঙালী স্বত্ত্বা দু'ভাগ হয়ে খান খান হয়ে গেল। এই ভাগের উদ্যোক্তা কারা। কোন্ রাজনৈতিক কুটচালে বাঙালীর অবিভক্ত স্বত্ত্বাকে দ্বিখন্ডিত করা হোল। এসব অসমাপ্ত প্রশ্নের মাঝেই লুকিয়ে আছে বাঙালীর ধর্মীয় বিভাজনের আজকের অবস্থান। সেদিনের সেই অবিবেচনা প্রসূত বিভাজনেই আমরা আজকের স্বাধীন বাংলার বাঙালী আর ওরা অর্থাৎ ভারতীয় পতাকার নীচে থাকা ধর্ম জুজুর বাঙালীরা আজ খন্ডিত বাঙালী হয়ে তাদের জাতিগত হতাশার দন্ডে দোদুল্যমান।
প্রশ্ন ওটা নয়। প্রশ্ন ছিল রাজনীতির অনুশীলন ও উত্তরাধিকার। সেই সুত্রে আজকে আমরা স্বাধীন বাংলার বাঙালীরা কোন্ মানদন্ডে দাঁড়িয়ে আছি তা চারিদিকে তাকালেই অনুমান করা যায়। অমুকের পুত্র, পত্নী বা প্রপৌত্র আজ আমাদের রাজনীতির দন্ড মুন্ডের কর্তা। বাংলার আনাচে কানাচে এই সংস্কৃতি আজ ক্যান্সারের বিভিষিকার রূপ নিয়েছে। রাজনীতির ন্যুনতম অনুশীলনের পরিবর্তে এসব সংস্কৃতিই আজ টেকসই হয়ে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। যে অনুশীলন ও কৃচ্ছ্বসাধনের মাধ্যমে আমাদের মহাপুরুষেরা সামনের সারিতে থেকে আমাদেরকে জীবন বোধের গল্প শুনিয়েছেন, স্বকীয়তার স্বপ্নে সফলতা এনে দিয়েছেন – সেই ইতিহাস ও ঐতিহ্য আমরা ধরে রাখতে পারছি কি? মহান নেতা বা জাতীয় নেতাদের মানদন্ডে তাদের উত্তর পুরুষেরা আমাদের নমস্য ও আশার প্রদীপ হতে পারে। কিন্তু দেশব্যাপী ছড়িয়ে থাকা রাজনীতির ট্যাগ লাগানো নেতা পাতি নেতারা ও তাদের উত্তর পুরুষেরা যেভাবে ক্ষমতার জাল বিছিয়ে বাংলার আনাচে কানাচে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, তাতে করে রাজনীতির ন্যুনতম সহজপাঠে বাঙালী আজ হতাশা গ্রস্থ ও আশাহত। আশা করছি রাজনীতির সরল পাঠে বাংলা তার পুর্ব চেতনায় ফিরে আসবে। বাঙালী উত্তরাধিকারের মেদবহুল রাজনীতি চায় না। বাঙালী বিচরন করতে চায় রাজনৈতিক দিক্ষা ও অনুশীলনের ন্যুনতম শুদ্ধপাঠের এক অহিংস উঠানে।
রাজনীতি তার শুদ্ধ আচরনের বলিষ্ঠ উচ্চারনে ফিরে আসুক – এই কামনায় বাঙালী আজ উর্দ্ধপানে তাকিয়ে আছে।