জালাল উদ্দিন আহমেদ
ধর্মীয় গলিপথে ভারত রাষ্ট্র – চার
প্রকাশ: ১২:৫৯ পিএম, ১০ জানুয়ারী,রবিবার,২০২১ | আপডেট: ০৬:২৩ এএম, ১৯ ডিসেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
( যে জাতিস্বত্ত্বার অহংকারে ভারত এক সময় একটি বৃহৎ রাষ্ট্র ছিল তা শুধুমাত্র ধর্মীয় জাতিস্বত্ত্বা তৈরী করে ভেঙ্গে তিন টুকরো হয়ে গেল। ধর্মীয় গলিপথে চলার ভারতীয় উপমহাদেশের রাষ্ট্র পরিক্রমার চার পর্বের লিখিত নিবন্ধে আজকে শেষ পর্ব প্রকাশিত হোল।)
ধর্মের ভিত্তিতে গড়ে উঠা মুসলমান শাসিত পাকিস্থান রাষ্ট্র ভেঙ্গে দু'টুকরো হয়ে গেল। বৃহত্তর ভারতের দুই প্রান্তে মুসলিম সংখ্যা গরিষ্ঠের ভিত্তিতে এই পাকিস্থান রাষ্ট্র গঠন করা হয়েছিল। পশ্চিমের অংশ যেখানে মূলতঃ পাঠান পাঞ্জাবী আর উর্দুভাষীদের আধিক্য ছিল সেটার নামকরন করা হোল পশ্চিম পাকিস্থান আর পুবের বাঙালী অধ্যুষিত অংশের নাম দেয়া হয়েছিল পূর্ব পাকিস্থান। জাতিগত পাহাড় প্রমান তফাৎ থাকলেও ধর্মীয় জোশে দুই প্রান্তের দুই মুসলিম সংখ্যা গরিষ্ঠের ভূখন্ড নিয়ে গঠিত হোল ইসলামিক রিপাবলিক অব পাকিস্থান রাষ্ট্র। কিন্তু সেই ধর্মীয় জোশের মধুরেন সম্পর্ক বেশী দিন টিকলো না। পাকিস্থানের শাসক শ্রেনী হিসাবে আবির্ভূত পশ্চিমাংশের পাঞ্জাবী ও পাঠানদের অবহেলার শিকারে এক সময় পূর্বাংশের বাঙালী মুসলিম অধ্যুষিত পাকিস্থান বিদ্রোহ করলো। ফলে পৃথিবীর ইতিহাসে এক রক্তক্ষয়ী মুক্তি যুদ্ধের নির্মমতায় বাঙালী তার স্বপ্নের বাঙালীয়ানার জাতিগত বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠন করলো। সৃষ্টি হোল গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ নামক মুসলিম সংখ্যা গরিষ্ঠ সমন্বয়ে সর্ব ধর্মের এক ধর্ম নিরপেক্ষ স্বাধীন রাষ্ট্র। ভারত বর্ষ এখন নতুন বাস্তবতায় তিন টুকরোর তিনটি দেশ। অর্থাৎ ইন্ডাস বা সিন্ধু পাড়ের গর্বিত জাতীয়তার হিন্দু জাতি আজ ধর্মীয় বিভাজনে তিনটি দেশ হিসাবে বিদ্যমান। মূল কাঠামোয় হিন্দু গরিষ্ঠতায় এবং হিন্দু শাসনের ভারত বা ইন্ডিয়া রয়ে গেল। পশিমের অংশ তার পূর্বের নাম পাকিস্থান হিসাবেই বহাল রইলো। আর পূর্ব পাকিস্থান ধর্মীয় সংশ্লিষ্টতার জাতিগত পরিচয় মুছে মাটি ও মানুষের আপন অস্ত্বিত্বের নিজ স্বকীয়তায় বাঙালী জাতীয়তার বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করলো। এক্ষেত্রে দুটি মূল স্রোতের তিনটি রাষ্ট্র এখন ভারতীয় উপমহাদেশের বিদ্যমান সত্য। তবে বাংলাদেশ তার নিজস্ব স্বকীয়তায় থাকলেও বৃহত্তর বাঙালী স্বত্ত্বার আঁতুড় ঘরে একটুখানি হলেও রক্তক্ষরন হয়েছিল বলেই ধরে নেয়া যায়। যদিও ভারত অধ্যুষিত বাংলার বাঙালীত্বে এখনো স্বতঃস্ফুর্ত উচ্চারনে 'জয় বাংলা' শ্লোগান শুনি – যে শ্লোগানে বাঙালী তার আপন স্বত্ত্বায় আজ প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন রাষ্ট্র। কিন্তু হিন্দু শাসিত এই ভারতীয় বাঙালীদের বর্তমানের 'জয় হিন্দ' বা 'বন্দে মাতরমে'র আওয়াজ শুকনো পাতার মড়মড়ে আওয়াজ হয়ে সাতচল্লিশের সেই অসম বিভাজনের কপালের ফেরকেই স্মরন করিয়ে দেয়।
জাতিগত ঐতিহ্য তার শেকড়ের টানেই মজবুত থাকে। ধর্মকে নিয়ে জাতিস্বত্ত্বা তৈরী করা যায় না। যে ভুল সিদ্ধান্তে মুসলিম জাতিস্বত্ত্বা তৈরী করে পাকিস্থান সৃষ্টি করা হয়েছিল তা ভুল প্রমাণিত করে বাঙালী জাতি সেটা বুঝিয়ে দিয়েছে। তবে বহু জাতির সমন্বয়ে গঠিত রাষ্ট্র কাঠামো তার শক্ত ভিত তৈরী করে শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। এর ভুরি ভুরি উদাহারন আমাদের চোখের সামনেই বিদ্যমান। ভারতীয় উপমহাদেশে দুটি ধর্মের জোশ এবং জৌলুস যে উতঙ্গ আচরনে রাষ্ট্র কাঠামোয় বার বার আঘাত হানছে এতে করে এতদাঞ্চল তার পুর্বের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গোত্র ও জাতিস্বত্ত্বার অবয়বে ফিরে আসে কিনা তা সময়ই বলে দেবে। ধর্মকে সামনে নিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার ফ্যাসাদে পাকিস্থান যে খেসারত দিয়েছে তা সত্যিই দুর্ভাগ্যজনক। আজকের দিনে ধর্মীয় হিন্দু জাতিস্বত্ত্বা প্রতিষ্ঠা করার খায়েসে দিল্লিওয়ালারা যা করছেন তা হিতে বিপরীত হয় কিনা তা সময়ই উত্তর দেবে। মনে রাখা প্রয়োজন হিন্দু জাতিস্বত্ত্বা ভারতের পুরনো ঐতিহ্য। সেটা কখনই ধর্মীয় জাতিস্বত্ত্বার ঐতিহ্যে নয়। এই হিন্দু জাতীয়তাবাদকে টিকিয়ে রাখার দামামায় মহা আয়োজনে হিদু জাতিকে ধর্মাচারনে ফেলে একাট্টা হওয়ার কোন প্রয়োজন আছে কিনা তা পন্ডিতেরাই বলতে পারবেন। প্রাচীন ভারতের সিন্ধু বা হিন্দু নদের অববাহিকায় হিন্দু জাতীয়তার জনপদ নিয়ে গড়ে উঠার ভারতে আজ ধর্মীয় ডঙ্কায় বিভাজনের যে বেসুরো সুর ক্রমাগত বেজেই চলেছে তা কখনোই ভারতীয় হিন্দু সভ্যতার স্বপক্ষে কথা বলে না।
ভারতীয় উপমহাদেশের বিদ্যমান এই তিনটি রাষ্ট্রের গঠন প্রকৃতিতে দেখা যায় একমাত্র বাংলাদেশ তার জাতিগত সৌষ্ঠবে একাট্টা একটি আদর্শ রাষ্ট্র হিসাবে বিদ্যমান। ফলে বাঙালী তার নিজস্ব স্বকীয়তায় নিজেদের একাত্মবোধে বলীয়ান হয়ে সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে। এখানে জাতিগত বিভেদ নেই, ধর্মীয় বাড়াবাড়ি নেই- নেই কোন উঁচুনীচু ভেদাভেদ। রাজনৈতিক ঝড় ঝঞ্জা থাকলেও বাঙালীয়ানার আপন সৌষ্ঠবেই তা এগিয়ে চলেছে। কোন আঞ্চলিক জাতিগত উঠকো ঝামেলায় রাষ্ট্রকে মাথা ঘামাতে হয় না।
পাশাপাশি আজকের বিদ্যমান পাকিস্থান রাষ্ট্র এক জাতীয়তার না হলেও ধর্মীয় একাত্মতায় তারা এখনো একাট্টা। তবে ভিন্ন ভিন্ন উপজাতীয় উটকো ঝামেলা সেখানে রয়েছে। যদিও ধর্মীয় দোহায় দিয়ে রাষ্ট্র তা শক্ত হাতে সামাল দিচ্ছে। যেহেতু পাকিস্থান রাষ্ট্রটি ইসলামিক রাষ্ট্র হিসাবে বিদ্যমান তথাপিও তাদের জাতিগত (ধর্মগত নয়) বৈষম্যতায় তারা প্রায়শঃ ভিন্নধর্মী ঝামেলার মুখোমুখি হয়। ভূখন্ডের ব্যালুচ জাতীতাবোধের উগ্র আচরনে তাদেরকে প্রায়শঃই তটস্থ থাকতে হয়। ইসলাম ধর্মের সাম্যতা ও শান্তির কথকতায় পাকিস্থান রাষ্ট্রের জন্ম হলেও তাদের শাসক শ্রেনীর একটি অংশ রাজা মহারাজার আদলে যেভাবে পাকিস্থানের শাসন ব্যবস্থায় বিচরন করেন তাতে যেকোন অজুহাতে বা সময়ের আবর্তে সেখানে জাতিগত বর্তমানের বিভেদ বিষ্ফোরন আকারে ভিন্ন ভিন্ন ধারায় এগিয়ে যেতে পারে বলে বিজ্ঞজনেরা বলে থাকেন।
আগেই বলেছি ভিন্ন ভিন্ন সনাতনী ধর্মীয় আচরনের জাতিস্বত্ত্বায় সিন্ধু অববাহিকায় গড়ে উঠা জনপদের সামষ্টিক রূপ হচ্ছে ভারত রাষ্ট্র, যার জাতিগত ঐতিহ্যই হচ্ছে হিন্দু জাতিয়তাবাদ এটা কখনোই ধর্মীয় জাতীয়তাবোধ নয়। আজকের দিনে দিল্লির ব্রাহ্মন্যবাদী শাসকেরা মারাঠী, গুজরাঠী, পাঞ্জাবী, তামিল, উড়িয়া, অহমিয়া, কাশিরী, রাজপুত বা আরো হাজারো কট্টর জাতিগত সনাতনী ভারতীয়কে কোন রামের পুজারী করে তাদেরকে ধর্মীয় হিন্দুতে পরিনত করার মহোৎসবে মাঠে নেমেছেন তা শুধু তারাই বলতে পারবেন। সেক্ষেত্রে হিন্দু জাতীয়তাবাদ কি শ্রেয় নয় আজকের দিনে শাসকের চাহিত ধর্মীয় হিন্দুত্ববোধের তুলনায়! ভারতীয় উপমহাদেশের টিকে থাকা বর্তমানের ভারত কিভাবে অখন্ড ভারতে তার পুরনো ঐতিহ্যকে সমুন্নত করবে তা তাদের ঠিকুজিই বলে দেয়। সুতরাং উঠকো ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ কখনোই ভারতের মঙ্গল আনবে না তা হাতে গুনেই বলে দেয়া যায়। আজকের প্রতিষ্ঠিত ভারতে বেদ গীতার হিন্দু কতটুকু বিদ্যমান তা ভারত রাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানই বলতে পারবে। সেক্ষেত্রে মহা লক্ষীর ভান্ডারে বহু জাতি ও ধর্মের সমন্বয়ে একটি দেশ যে শৌর্য বীর্যের প্রতিষ্ঠা পেয়ে আজকে ভারত হিসাবে তার অভীষ্ট লক্ষ্যে এগিয়ে গেছে তাকে এই পিছুটান ধর্মীয় কচ কচানির ঘোলাজলে এগিয়ে নেবে না বিভাজনের আরো কোন দৃশ্যের অবতারনা করবে তা সময়ই বলে দেবে।
ধর্ম মানব জাতির আত্মশুদ্ধি ও সামষ্টিক জনপদের মঙ্গল সাধনের সুত্র হিসাবে কাজ করে। রাষ্ট্র পরিচালনায় ধর্মকে সূত্র হিসাবে সামনে আনলে তাতে সামাজিক জীবনের চাহিদায় রাষ্ট্রীয় আচার আচরনের সাযুজ্য খুঁজে পাওয়া মুস্কিল হয়ে যায়। সুতরাং ধর্ম তার আপন বিশুদ্ধতায় মানব জনপদের কল্যান সাধনের পথ দেখাবে। পাশাপাশি রাষ্ট্র তার গঠিত মেকানিজমের সাযুজ্যে ভূখন্ডের জনপদের বৈষয়িক জীবনাচারের নিয়মাচারে কাজ করে যাবে। রাষ্ট্রে মানুষ-ধর্ম ও রাষ্ট্রাচার পাশাপাশি চলমান উপাদান। ক্ষেত্র বিশেষে সম্পুরকও বটে। তবে তা কখনোই আবশ্যিক ধর্তব্যে পড়ে না। জাগতিক বিধিবদ্ধতায় রাষ্ট্রাচার একটি আবশ্যিক ব্যাপার হলেও তা কখনোই ধর্মীয় আবেগকে সামনে নিয়ে চলার আবশ্যিকতায় পড়ে না। যেখানেই রাষ্ট্রাচারে ধর্মীয় আবেগকে সামনে নিয়ে চলার ঘোষনা বা অনুশীলন করা হয়েছে সেখানেই পারস্পারিক সাংঘর্ষিক বিষয়গুলির উদ্ভব হয়েছে। সেক্ষেত্রে ধর্মীয় গলিপথে চলার মাসুল গুনতে হয়েছে রাষ্ট্রের কাঠামোগত অখন্ডতায়। ভারতবর্ষ তার জ্বলন্ত উদাহারন।
(সমাপ্ত)