জালাল উদ্দিন আহমেদ
একটু অন্যরকম
প্রকাশ: ০৯:৩৮ পিএম, ১৯ ডিসেম্বর,শনিবার,২০২০ | আপডেট: ০৬:২৩ এএম, ১৯ ডিসেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
প্যান্ডেমিকের এই যন্ত্রনাময় দিনগুলিতে বছরের শেষদিকে এসে একটু ফুরফুরে মেজাজেই আছি বলে মনে হয়। বড় মেয়েটি রাজশাহীতে থাকে। সেই সুত্রে বছরে একবার হলেও অবসরের এই সময়টিতে মেয়ের ডাকে সাড়া দিয়ে কিছুদিন বেড়িয়ে আসতে হয় সেখানে। আমার অবসর জীবনের নির্ঘন্টে বছরের কয়েকটা দিন বড় মেয়েকে পিতৃস্নেহে স্নিগ্ধ করতে হয়। একটা উপলক্ষ্য তো লাগে। তাই মেয়ের জন্মদিনের উপলক্ষ্য নিয়ে আমি এখন সস্ত্রীক রাজশাহীর সপুরায় বড় মেয়ের সবুজ-ছায়ায় সমৃদ্ধ চৌধুরী ম্যানশনে মুরুব্বীর কর্তব্য পালনে ব্যস্ত সময় অতিবাহিত করছি। বিয়ান মোস্তারী বেগম খাদেমুল ইসলাম গার্লস কলেজের অধ্যক্ষা ছিলেন। গত হয়েছেন একদশক আগেই। বিহাই মহিদুর রহমান চৌধুরী এলাকায় চৌধুরী সাহেব নামে পরিচিত। তিনিও গত হয়েছেন বছর তিনেক হোল। তাদের একমাত্র পুত্র সন্তান স্বনামধন্য স্থপতি চৌধুরী হাইসাম মোহাম্মদ নেভিল আমার বড় জামাতা। বৃহত্তর বাংলার মালদহের কালিয়াচক সংলগ্ন জালালপুরের বিখ্যাত জমিদার জনাব উমেদুর রহমান চৌধুরী আমার জামাতার দাদু। তাদের সেই জমিদারী নেই। তবে জমিদারীর সেই তালুক এখনো রয়েছে। বৃহত্তর রাজশাহীতে তাদের সেই তালুক সামলানোর জন্যই হয়তো আমার বড় বিহাই মহিদুর রহমান চৌধুরীকে রাজশাহীতে থিতু হতে হয়েছিল। তখন তো বৃটিশ ভারতে এরকমটাই ছিল। তাইতো দেখি কোলকাতার ঠাকুর বাড়ির জমিদারী সেই কুষ্টিয়ার শিলাইহদহ বা নওগাঁর পোড়শা অবধি বিস্তৃত। সুতরাং আঞ্চলিক সীমারেখায় সীমাবদ্ধ ছিল না সে সময়ের জমিদারীর তালুক বা ভূস্বামী হওয়ার পরিধি।
যাহোক, যা বলার জন্য আমার এই প্রয়াস তার মূল প্রতিপাদ্য ছিল একটু মুক্ত নিঃশ্বাসে বাংলার প্রকৃতিকে উপভোগ করা। ঢাকার নগর জীবনের ইট পাথরের মোড়কে থাকতে থাকতে কেমন যেন হাঁপিয়ে উঠেছিলাম। রাজশাহী শহর তো এখন নগর হিসাবে উন্নীত। তবুও এই আধুনিক ইট পাথরের মোড়কে থাকা রাজশাহীতে এখনো সেই পুরনো অকৃত্রিম বাংলার আলোছায়া আনাগোনা করে। জন সংখ্যার চাপ কিংবা ডিজিট্যালাইজেশনের আলোকছটায় বাহ্যিক অবকাঠামোগত উন্নয়ন বেশ চোখে পড়ছে। তবুও বাংলার শাশ্বত আবাহন এখনও এই বিভাগীয় শহরে বেশ দৃশ্যমান। হয়তো সেই ঘোড়ার গাড়ী নেই বা এক সময়ের গরু মহিষের গাড়ী আজ কালের অন্তরালে হারিয়ে গেছে কিন্তু তবুও এখানকার মাটি ও মানুষের আদি বাঙালীয়ানার ছাপ নগরের অলিগলিতে প্রকাশিত হতে দেখি। বর্তমান সময়ে রাজশাহীর অবকাঠামোগত উন্নয়নে বেশ চোখে পড়ার মত কাজগুলো হচ্ছে। একটি উন্নত শহর বা নগরের মূল কথাই হোল তার যোগাযোগ ব্যবস্থা ও পরিকল্পিত উন্নয়ন। সেক্ষেত্রে এখন রাজশাহীর রাস্তাঘাট উন্নয়নে সিটি কর্পোরেশনের বর্তমান প্রশাসন যেসব প্রকল্পগুলো হাতে নিয়েছেন তা বেশ লক্ষ্যণীয়ভাবেই দৃশ্যমান। শুনেছি পূর্ব্ববর্তী মেয়র মিজানুর রহমান মিনুর সময়কালে রাজশাহী উন্নয়নের যে মাস্টার প্ল্যান তৈরী করা হয়েছিল তার উপর ভিত্তি করেই এসব কাজ এগিয়ে যাচ্ছে। তারপরেও যে জিনিসটা দেখে এখনো চোখটা ফিরে যায় সেই পুরনো রাণী বা রাজন্য যুগের কথায় তা হোল রাস্তার মোড়ে মোড়ে পানির ঢপ(বিশেষ জলাধার) যার মাধ্যমে এখনো আম-জনতার সার্বক্ষনিক পানি সরবরাহের সংস্থান করা হয়। আধুনিকতার ছোঁয়া লাগলেও নগরের রাণীবাজার মালোপাড়া মিয়াপাড়া ও পুরনো এলাকাগুলোতে রাজতন্ত্র বা বৃটিশদের বসানো সেইসব পানির ঢপগুলো এখনো ইতিহাসের সাক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে জনসেবায় নিজেদেরকে সমুন্নত রেখেছে। এটা অবশ্যই ইতিহাস ও ঐতিহ্যের অংশ।
ক'দিন আগে এই নগরীর একটি ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানের পনের বর্ষ পুর্তি অনুষ্ঠানের দাওয়াতে গিয়েছিলাম। ঐতিহ্যবাহী বলছি এই কারনে যে রাজশাহীর গুটিকয় সম্মানিত ব্যক্তির প্রচেষ্টায় একবিংশের শুরুর দিকে এখানে “হেরিটেজ রাজশাহী” নামে একটি অরাজনৈতিক ও অলাভজনক প্রতিষ্ঠানের গোঁড়া পত্তন হয়েছিল। নগরীর প্রথিতযশা কিছু মানুষ এতদাঞ্চলের ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে তুলে ধরার মানসে এই গবেষনাধর্মী ও অলাভজনক প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তোলেন। লক্ষ্য করলাম পুলিশ বিভাগের এক অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এব্যাপারে বেশ উদ্যোগী এবং তার অক্লান্ত প্রচেষ্টায় এই প্রতিষ্ঠানটি বর্তমানে রাজশাহীর ইতিহাস, ঐতিহ্য ও প্রত্নতাত্বিক বিষয়াদি নিয়ে বেশ ভাল ভাল কাজ করছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজন গবেষক অধ্যাপক এব্যাপারে বেশ উৎসাহী এবং তাদের শ্রম কাজে লাগিয়ে রাজশাহীর ঐতিহ্যকে তুলে ধরার প্রয়াসে এগিয়ে এসেছেন। অবসরপ্রাপ্ত সেই সম্মানিত পুলিশ কর্মকর্তা জনাব মাহবুব সিদ্দিকীকে স্টাডি করে জানলাম তার ঐকান্তিকতা ও রাজশাহীকে ভালবেসে এই প্রতিষ্ঠানটিকে জাতীয় পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত করার অক্লান্ত পরিশ্রমের কথা। তিনিই এখন এই প্রতিষ্ঠানের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। লক্ষ্য করলাম প্রশাসন ও একাডেমিক পর্যায়ে তার সখ্যতা ও গ্রহনযোগ্যতার প্রতিফলন। তার সভাপতিত্বে সেই সন্ধ্যার অনুষ্ঠানে স্থানীয় সাংসদ ফজলে হোসেন বাদশার উপস্থিতি এক নতুন মাত্রার সুচনা করেছিল। তাছাড়া কবি সাহিত্যিক ও বিদগ্ধ জনদের উপিস্থিতিতে সেই অনুষ্ঠানটি আলোকিত হয়েছিল বললেও অত্যুক্তি হবেনা। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোভিসিসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের চেয়ারম্যান ও আরো কয়েকজন গবেষক অধ্যাপক সেই অনুষ্ঠানে তাদের গবেষনালব্ধ আলোচনায় অনুষ্ঠানটি প্রানবন্ত করে তোলেন। শতবর্ষীয় রাজশাহী কলেজের স্বনামধন্য অধ্যক্ষ জনাব হাবিবুর রহমান ও রাজশাহী জেলার পুলিশ সুপারের উপস্থিতি উক্ত অনুষ্ঠানের শ্রীবৃদ্ধি করেছিল নিঃসন্দেহে। প্রত্যেকের ঐকান্তিকতা ও আগ্রহ বিশেষ করে রাজশাহীর সন্তান সাংসদ ফজলে হোসেন বাদশার সম্পৃক্ততা সেই সন্ধ্যার অনুষ্ঠানটিকে প্রানবন্ত করে রেখেছিল। বহুদিন পরে মাটির টানে মানুষের আপন হয়ে থাকার সদিচ্ছায় উপর তলার মানুষগুলির ঐকান্তিকতায় আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম। দেশ, মাটি ও মানুষের কথা বলার সময় লক্ষ্য করলাম প্রতিটি বক্তার আত্মার টানে গ্রাম্য বাঙালী হয়ে প্রকাশিত হওয়ার আগ্রহের স্ফুরন। সবচেয়ে ভাল লেগেছে, এখানে কোন রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষের শ্লোগান মিশ্রিত বক্তব্য ছিলনা। ভাল একটি সন্ধ্যায় আলোচনা ও মতবিনিময় অন্তে নৈশভোজ করে মেয়ের বাসা সপুরা উপশহরে পোঁছেছিলাম। বন্ধুবর অগ্রজ সৈয়দ মাহবুবুল হক রুমি তিতু ও হেরিটেজ রাজশাহীর সাধারন সম্পাদক তৌফিকুর রহমান লাভলু ভাইয়ের আগ্রহেই আমার সে অনুষ্ঠানে যাওয়া হয়েছিল।
ইদানীং বন্ধুবর অগ্রজ মোখলেসুর রহমান মন্টুর ছেলে রাণীবাজারে “ইয়া তাই” নাম দিয়ে একটি জাপানী রেস্টুরেন্ট খুলেছে। ভাজিজার ইচ্ছা চাচাদের দাওয়াত দিয়ে তার রেস্টুরেন্টের পথচলা শুরু করবে। সেখানেও এক সন্ধ্যায় দাওয়াতে গেলাম। ডজন খানেক বন্ধু বান্ধবসহ সন্ধ্যেটা ভালই কাটলো। রাজশাহী সিটির প্রাক্তন মেয়র মিজানুর রহমাম মিনু, মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার নজরুল ইসলাম খোকা, প্রাক্তন ফুটবলার মুরাদুজ্জামান এলান ও জাহাঙ্গীর আলম রতনও সে সন্ধ্যায় সেখানে উপস্থিত ছিলেন। সেই সুত্রে তারাও এখন আমার ভাল বন্ধু হয়ে গেলেন। এই বয়সে এসে রাজশাহীর এই মাস দুয়েক অবস্থানে আমার বন্ধুত্বের পরিসরটা বেশ বড় হয়ে গেল মনে হয়। যদিও ঢাকায় একটা সময় খুব সংক্ষিপ্ত পরিসরে আমার বন্ধু বান্ধব ছিল। আমার শিক্ষা জীবনের মতিয়ুর, লোকমান, হালিম, ডাঃআলতাফ, মঞ্জু এরা বেশ ভাল বন্ধু হিসাবে প্রতিষ্ঠিত। তবে সমাজ জীবনে এসে পেলাম অগ্রজ হাসানুজ্জামান ইতি ভাইকে। তিনি একাধারে আমার খেলাধুলার মেন্টর ও রাজনৈতিক সহকর্মীও বটে। ইতি ভাই বন্ধু হলেও মুরুব্বীর ভুমিকায় আমাদের সব সময় আগলে রাখতেন। রাজশাহী সিটির বর্তমান মেয়র খাইরুজ্জামান লিটনের চাচা তিনি।
৮৭'তে অর্থাৎ ১৯৮৭ সালে চাকুরীজীবি হিসাবে বছর দেড়েক রাজশাহীতে কাটিয়েছিলাম। সেই সুত্র ধরেই হয়তো আজকে আমার রাজশাহী সম্পৃক্ততা পোক্ত শিকড়ের ন্যায় গেঁথে গেছে। প্রথম মেয়ের কথা আগেই বলেছি। সে প্রকৃতপক্ষে একজন ইঞ্জিনিয়ার। দ্বিতীয় মেয়ের বিয়েও রাজশাহীতে দিয়েছি। দ্বিতীয় জামাই আইটি ইঞ্জিনিয়ার। রুপালী ব্যাংকের সাবেক জিএম মৌলুদ আহমেদ আমার মেজ বিহাই। মেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলা নিয়ে মাস্টারস করেছে। ছোট ছেলে প্রশাসক হিসাবে একটি বহুজাতিক অনলাইন শপিং কোম্পানীতে কাজ করছে। তারও বিয়ে দিয়েছি বর্তমান প্রধান মন্ত্রীর ফুফুর নাতনীর সঙ্গে। শামস তাব্রিজ আমার ছোট বিহাই যিনি রাজশাহীর ক্রীড়াঙ্গনে একটি পরিচিত নাম। সে সময় রাজশাহী পুর্ব পশ্চিমে একটি লম্বাটে শহর ছিল যা এখন রেল ক্রসিং পেরিয়ে উত্তর দিকে প্রশস্ত হচ্ছে। আজকের একবিংশের এইদিনে রাজশাহী এখন বেশ বড় পরিসরে বিস্তৃত এবং ক্রমবর্ধমান আধুনিক সিটি হিসাবে বিকশিত হচ্ছে। পদ্মার প্রমত্ততা বা আগের সেই গর্জন ও গৌরব তেমন না থাকলেও বর্ষা মৌসুমে এর প্রকৃত রূপ এখনো বিদ্যমান। ইদানীং পদ্মাপাড় কেন্দ্রিক কিছুটা ছোটখাট এবং স্থানীয় ভাবভিত্তিক পর্যটন ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। রাজশাজী নগরের পরিবহন ব্যবস্থা সাধারন জনগনের সুবিধাজনক অবস্থানে থাকলেও তা শুধুমাত্র অটোরিক্সা বা রিক্সা কেন্দ্রিক। মেট্রোপলিট্যান সিটির ন্যুনতম সুযোগ সুবিধা বা তার লক্ষন অন্ততঃ রাজশাহী নগরীতে দৃশ্যমান নেই। তবে যেভাবে শহরের বিস্তার এখন উত্তরমুখী ধাবমান তাতে খুব শীঘ্রই হয়তো নগর পরিবহনে বাস-মিনিবাসের পরিসেবা চালু হলেও হতে পারে। আরও একটি বিষয় বেশ লক্ষনীয়ভাবে দৃশ্যমান এই নগরীতে তা হোল সরকারী পরিসেবার দপ্তরগুলি বৃহৎ আয়োজনের বড় বড় অবকাঠামো ও জায়গা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমার কাছে এসব ভূমি ব্যবস্থাপনার অপচয়ের দৃশ্য বলেই মনে হয়েছে।। নগর উন্নয়নে এসব বিষয়গুলো কেন্দ্রীয়ভাবে সুনির্দিষ্ট স্থানে প্রতিষ্ঠা করলে সরকার এসব জমি জায়গায় অন্যান্য সামাজিক উন্নয়ন্মুলক প্রকল্পে এগিয়ে নিতে পারবে বলে আমি মনে করি। পাশাপাশি সরকারী সেবা প্রতিষ্ঠান গুলির গুচ্ছসেবা সুনির্দিষ্ট এলাকা ভিত্তিক করে তা সহজলভ্য করা যাবে।
অযাচিত ভাবে অনেক কথাই হয়তো বলে ফেললাম। তবে বাঙালীর প্রকৃত বাঙালিয়ানা উপভোগে এখনো ঢাকার বাইরের মহানগর বা শহরগুলি এখনও সে যোগ্যতায় বিদ্যমান বলে আমার কাছে মনে হয়েছে। চট্টগ্রামের মাত্রাটা একটু অন্যভাবে আঁচ করা গেলেও অন্যান্য মহানগরের সবখানেই দেখেছি বাংলার প্রকৃত উচ্চারনের প্রাকৃতিক আবাহন। তবে যেভাবে ডিজিট্যালাইজেশনের আশীর্বাদে দেশ এগোচ্ছে তাতে সেদিন হয়তো বেশী দূরে নয় যখন সারা বাংলাই হবে শহর কেন্দ্রিক দেশ। যদিও আশা করছি গ্রাম বাংলার প্রকৃতি ও ঐতিহ্য সমুন্নত রেখেই তার বিদ্যমান অস্তিত্ব প্রকাশিত থাকবে। আটষট্টি হাজার গ্রামের বাংলা তখন পুরোটাই আলোকিত হয়ে নগর ও শিল্প সভ্যতায় বিকশিত হবে।
রাজশাহী (১৭-১২-২০২০)