জালাল উদ্দিন আহমেদ
করোনা কড়চা
প্রকাশ: ০৭:০৪ পিএম, ১ ডিসেম্বর,মঙ্গলবার,২০২০ | আপডেট: ০৫:৪৩ পিএম, ২২ ডিসেম্বর,রবিবার,২০২৪
করোনা একটি ছোট্ট জীবানু। তার দাপটে আজ গোটা বিশ্বে নাভিশ্বাস উঠেছে। মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়েছে এই করোনা নামের জীবানুর তান্ডব। এই করোনার তান্ডবে বিশ্বের তাবড় শক্তিধর মহারথীরা আজ থর থর করে কাঁপছে। সে ছোবলে আমরাও আক্রান্ত। করোনার থাবায় আজ বাংলার উঠানে আহাজারি আর মাতমের দৃশ্য দৃশ্যমান না হলেও একটি নিয়মিত বিয়োগান্তক দৃশ্যপটের অবজেক্ট হয়ে করোনা আমাদের চারপাশে ভীতিকর অবস্থায় বিদ্যমান। তারপরেও বাংলার জনপদে এই মহামারী আজ তুচ্ছ তাচ্ছিল্যের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। একটা গা- সওয়া ভাব নিয়ে এই করোনার সাথে আমাদের নৈমিত্তিক বসবাস। সম্ভবতঃ দীর্ঘ সময়ের সহ-অবস্থানের ফসল হতে পারে এটি। শুরুর প্রথম দিকে এই করোনা আমাদেরকে বেশ চমকে দিয়েছিল। ফলে আমরাও বেশ সন্ত্রস্ত হয়ে সরকারী নিয়মাচার ও বিধিবদ্ধতার আলোকে চলাফেরা করেছি।
সেই মার্চের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে শুরু হওয়া করোনার ছোবল আজ কড়ামিঠা আচরনে আমাদের নিত্য সঙ্গী হয়ে অবস্থান করছে। তাইতো করোনা আজ আমাদের প্রাত্যহিক জীবন ও জীবিকার সঙ্গী হয়ে বসবাস করছে। করোনা একটি সংঘবদ্ধ বৈশ্বিক বিশৃংখলা হলেও এর প্রকোপে বিশ্ব যেভাবে নাস্তানাবুদ হয়েছে বা হচ্ছে সেরকম আঘাতে আমাদের এই জনবহুল বাংলাদেশ কিন্তু ঘায়েল হয়নি। এর কারন অবশ্য একটা আছে। রোগ-শোক আভাব-অনটনের বাঙালী দিন আনি দিন খাইয়ের রোজ নামচায় তার জীবন ও জীবিকার সংস্থান করে। ফলে বার বছরের একজন কিশোর যেমন তার দৈনন্দিন চালচিত্রে কঠোর পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে অতিক্রান্ত করে ঠিক তেমনি একজন ষাটোর্ধ বৃদ্ধকেও একই কায়দায় তার জীবন চালনার পথে হাঁটতে হয়। ফলে তাদের কর্ম ক্ষমতার পারংগমতায় পরিবেশের অন্যান্য বাহ্যিক ক্ষতিকর খারাপ প্রভাব ততটা কাবু করতে পারেনা। জানিনা আমার ব্যাখ্যাটি কোন বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যায় পড়ে কিনা, তবে লোকমুখে প্রচলিত কথাটিই কলমের খোঁচায় সেঁটে দিলাম।
পই পই করে আটটি মাস পেরিয়ে গেল। কিন্তু এই করোনা আক্রান্তের শুরুর দিকে কোন এক টিভি চ্যানেলের একটি ছোট্ট নিউজ ক্লিপ আমাদের অনেককেই কিছু চিন্তার খোরাক যুগিয়েছিল। বাংলাদেশে কম করে হলেও গোটা তিরিশেক টিভি চ্যানেল ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অসংখ্য নিউজ পোর্টাল রয়েছে। তো সেদিনের সেই টিভি চ্যানেলের সংবাদ ক্লিপটি ছিল বেশ চমকপ্রদ। সে সময় করোনার ছোবল সবেমাত্র শুরু হয়েছে। মিডিয়া, সাংবাদিক সবাই এই করোনা নিয়ে তাদের সিংহভাগ সময় ব্যয় করছেন। মানুষজনও কেমন যেন একটু কুঁকড়ে গেছেন। সবাই ঘরে বন্দি। সম্বল একটাই। হাতে মোবাইল সেট না হয় টিভি সেটের সামনে বসে থাকা। এভাবেই করোনার দাপটে আমরা একটু হলেও কুঁকড়ে গিয়েছিলাম। তবে সেদিনের সেই টিভি নিউজ ক্লিপের সাক্ষৎকারটিই মনে হয় বাংলার আনাচে কানাচে একটা নতুন মাত্রা যুগিয়েছিল।
সাংবাদিক সাহেব কি যেন মনে করে তার ক্যামেরা ক্রু নিয়ে ঢাকার মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পে হাজির হলেন। এক্ষেত্রে ক্যাম্প তো ক্যাম্পই। সেখানে হাজার হাজার মানুষের গা-ঘেষা চলাফেরা। কোন স্বাস্থ্য সচেতনতা নেই। কিংবা থাকলেও তা মেনে চলার সে স্পেসও তাদের নেই। জীবন যুদ্ধের তাগিদে তাদেরকে সব সময় দৌড়ের মধ্যে থাকতে হয়। স্বাস্থ্য সচেতনতা বা মানবিক মুল্যবোধের অনেক কিছুই তাদের স্পর্শ করেনা। পাশেই ডাস্টবিন। সঙ্গে লাগোয়া খাবার দোকান। দোকানের নীচ দিয়ে প্রবাহিত খোলা সুয়ারেজ লাইনের মলমুত্রের প্রবাহ। ছয় বাই সাত ফুটের ছোট ছোট খুপড়ি ঘরে না হলেও চার পাঁচ জনের বসতি। দুই ফুট প্রশস্ত সরু গলিপথে তাদের আসা-যাওয়া। এবং তাদের জীবন চাহিদার এধরনের আরো অনেক কিছু এই পরিমাপেই সীমাবদ্ধ। তবুও তারা বেঁচে আছে। করে কম্মে খাচ্ছে। জীবন চাহিদার সবখানেই অংশগ্রহন করছে। সম্প্রতি তারা বাংলাদেশের নাগরিক হওয়ার প্রথম সোপানে পা রেখেছে। ভোটার হিসাবে তারা স্বীকৃতি পেয়েছে।
যাহোক, যা বলার জন্য আমার কলম ধরা তা হচ্ছে করোনা মহামারী। তো সাংবাদিক সাহেব স্বাভাবিক নিয়মেই করোনার সতর্কতা ও স্বাস্থ্য বিধিবদ্ধতার কথা বলে যখন মধ্য বয়স্ক ক্যাম্পের এক অধিবাসীকে জিগ্যেস করলেন, “আপনাদের মধ্যে তো কোন সতর্কতা নেই৷ করোনা মহামারীর জন্য সরকার ঘোষিত কোন স্বাস্থ্যবিধি আপনারা মানছেন না। সুতরাং করোনা যদি একবার ঢুকে পড়ে তাহলে আপনাদের পরিনতির কথা কি আপনারা ভেবেছেন?”। স্বাভাবিক নিয়মেই ভদ্রলোক একজন অবাঙালী। তিনি তার মুখের ভাষায় যা বললেন তা হোল, “ও তো বাংগাল কা রোগ। বিহারীকো ও করোনা কুছ নাহি কর সাকতা”। অর্থাৎ ওটা বাঙালীদের রোগ। করোনা বিহারীদের কিছু করতে পারবে না। আমরা হেসেছিলাম। তবে হাসিটা শুকনো ছিল। ওটা ছিল এ বছরের মে মাসের প্রথম বা দ্বিতীয় সপ্তাহের কোন এক সন্ধ্যার টিভির নিউজ ক্লিপ। এবং আমার মতে ওটাকে বছরের সেরা উক্তি বললেও অত্যুক্তি হবেনা। এরপর থেকে গুনে গুনে কতগুলো মাস পেরিয়ে গেল। করোনা আক্রান্তের বা দৌরাত্মের এই এতদিন পরে মোহাম্মদপুরের বিহারী ক্যাম্পের সেদিনের সেই অবাঙালী ভদ্রলোকের কথার সুত্র ধরে বলতে ইচ্ছে করছে – “ফিকর মত কর ভাইয়া হামলোগ ভি আল্লাহ কি করম সে হ্যায়”।
মহামারীর সংজ্ঞা অনুযায়ী করোনা এখনো আমাদের জনপদে সেরকম কোন আতংক ছড়াতে পারেনি যার ফলে জনপদে ভীতিকর বিশৃংখলার সৃষ্টি হয়। সরকারি প্রচেষ্টায় যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে এই আপদের মোকাবিলা করা হচ্ছে। এবং সুখবর একটাই তা হচ্ছে – যে দুর্নীতি ও অনিয়মের গ্যাঁড়াকলে স্বাস্থ্যবিভাগ বিচরন করছিল তা এই করোনা মহামারী এসে আমাদের কিছুটা হলেও পরিশুদ্ধ করে দিয়েছে বা দিচ্ছে। সেক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিভাগের ক্ষমতা ও দক্ষতার যে ঘাটতিগুলো ছিল তাও আস্তেধীরে শুধরে যাচ্ছে। অনিয়মের যে অসুরীয় জঙ্গল এই বিভাগকে গ্রাস করেছিল তার কাল থাবা থেকে তারা মুক্ত হচ্ছে।
করোনার করাল গ্রাস আমাদের কতটুকু শিখিয়েছে বা মানুষ করেছে তা বলতে গেলে চারিদিকের থেমে থেমে কালো ও বিষাক্ত বুদবুদ গুলোই আমরা শুধু দেখতে পাই। এসকল দুর্গন্ধময় বুদবুদের বিভৎস আচরনে সমাজ সংসার ও ক্ষেত্র বিশেষে রাষ্ট্রকেও বিব্রত হতে হচ্ছে। করোনার বিদ্ধংসী থাবা শুরু হলে এসবের অবসান হবে কিনা সেটাও আমাদের জানা নেই। কারন এতবড় বিশ্বময়তার ব্যাপকতা নিয়ে যে প্যান্ডেমিক দুনিয়াকে নাড়িয়ে দিয়েছে তারপরেও দেখি মানুষ নামের অমানুষগুলোর উচ্ছৃংখল ও স্বেচ্ছাচারী আচরনে জনপদে আহাজারি ও অসহায়ত্বের হাজারো কান্না। করোনার দাপটে যখন জনপদে একটা থমথমে আতংক তখন ধর্মীয় উচ্চারনের সোল এজেন্টরা আমাদেরকে কালোজিরা আর জয়ফলের ওষুধ আবিস্কারের কথা শুনিয়ে ধার্মিক থেকে ধর্মান্ধ বানাতে চেয়েছিল। চেয়ারম্যান মেম্বাররা তাদের চৌদ্দগুষ্টির নাম ঠিকানা বসিয়ে নিজেদেরকে অসহায় ও দুস্থ্ বানিয়ে সরকারী রিলিফের টাকা নিজেদের পকেটে ভরেছিল। কিটস আর মাস্ক নিয়ে সরকারী খবরদারীর খবর তো এখনও আমাদের মাথায় টাটকা হয়েই আছে। সুতরাং করোনা কড়চায় হাজারো অবজেক্ট আমাদের সামনে যমদূতের মত আসলেও সরকারী উচ্চ পর্যায়ের দূরদর্শিতায় তা আমরা আস্তেধীরে কাটিয়ে উঠছি।
শীত এসে গেল। করোনাও বুঝি তার দ্বিতীয় দফা মরন কামড় দেয়ার জন্য দাঁতে শান লাগাচ্ছে। বিজ্ঞজনেরা সেটাই বলাবলি করছেন। দেখা যাক, করোনার দ্বিতীয় ধাক্কায় আমরা কতটা কাবু হই বা করোনা আমাদেরকে কাবু করতে পারে। তবে একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, সরকারী তৎপরতার চলমান প্রবাহ যদি বর্তমান গতিতে অব্যাহত থাকে তবে করোনার ভবিষ্যত ধাক্কা থেকে আমরা নিজেদেরকে বর্তমান ধারাতেই সুসংহত রাখতে পারবো ইনশা আল্লাহ। করোনা কড়চায় আরো দু'একটি কথা না বললেই নয়। এটা শধু আমি বলছিনা। স্বাস্থ্যবিভাগ বলছে। আমার মাননীয় নেত্রী দেশের সম্মানিত প্রধানমন্ত্রীও একথা প্রতিটি অনুষ্ঠানে বলছেন। সুতরাং এই মহামারী থেকে সুরক্ষার একটিই পথ। নিয়মিত হাত ধুয়ার অভ্যেস করুন এবং প্রকাশ্যে বেরোলে বাধ্যতামুলকভাবে মাস্ক পরুন। খুব সহজ সমাধান। আসুন আমরা আত্ম সচেতন হই।
রাজশাহী ২৯.১১.২০২০