জালাল উদ্দিন আহমেদ
রাজনীতির উত্তরাধিকার
প্রকাশ: ১০:৫০ পিএম, ২৫ নভেম্বর, বুধবার,২০২০ | আপডেট: ১০:৫৭ এএম, ২২ ডিসেম্বর,রবিবার,২০২৪
যখন স্কুলে পড়তাম তখন রাজনীতি বলতে বাপ-ভাইদের রাজনীতির মতাদর্শের ভালমন্দ আলাপের বিভিন্ন গঠনমূলক কথাগুলো শুনতাম। তাদের রাজনীতির সক্রিয় ও সাপোর্টিভ কর্মচাঞ্চল্যে পুলকিত হতাম। আগ্রহ নিয়ে তাদের সংগ্রহে থাকা বিভিন্ন পোস্টার ফেস্টুন বা লিফলেট গুলো নাড়াচাড়া করতাম। তবে তা লুকিয়ে তাদের অগোচরে। এভাবেই বাঙালী সন্তানরা নিজের অজান্তেই রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট হয়। মাধ্যমিক শেষ করে কলেজে পদার্পন করার পর ছাত্র রাজনীতির সক্রিয়তায় তখন রাজনীতির প্রথম পাঠটা শুরু হয়ে যায়। কখনো সংঘবদ্ধভাবে, কখনওবা আপন তাগিদে নিজের বুনিয়াদ শক্ত করার মানসে বাংলার দামাল ছেলেরা এসব কাজে উৎসাহিত হয়। পরবর্তী সময়ে ছাত্র নেতৃত্বের বিকাশ এবং কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় পার হয়ে রাজনীতির প্রকৃত অনুশীলনের উঠানে পা রাখার এন্তেজাম। এভাবেই বাংলার উঠানে রাজনীতির হাতে খড়ি হয় ছাত্র যুবাদের। পর্যায়ক্রমে নিজ নিজ এলাকায় সাংগঠনিক দক্ষতা দেখিয়ে জাতীয় রাজনীতির পাদপীঠে আরোহন করেন তারা।
রাষ্ট্র, রাজনীতি, গনতন্ত্র বা সমাজতান্ত্রিক চিন্তায় এভাবেই নেতৃত্বের বিকাশ হয়ে তা জাতীয় পর্যায়ে বিকশিত হয়। অবশ্য সমাজতন্ত্রের রাজনীতির পাঠশালা এবং তার অনুশীলন অন্যভাবে বিকশিত হয়। আমাদের এই ভুখন্ডে বিশেষ করে পুর্ব বাংলায় আমরা যেসব রাজনৈতিক মহাপুরুষদের সামনে পেয়েছি বাল্যকাল হতেই তারা এভাবে অনুশীলনের মাধ্যমে আমাদের নেতা হয়ে কিংবা রাজনীতির মহাপুরুষ হিসাবে আমাদের সামনে প্রতিভাত হয়েছেন। বর্ণিত কর্মধারায় উঠে এসে তারা আমাদের নেতৃত্বের কান্ডারী হয়েছেন। তাদের সংস্পর্শে থাকা উত্তরাধিকারীরা আস্তেধীরে বাংলার রাজনীতির উঠানে নিজেদেরকে এভাবেই বিকশিত করেছেন।
রাজা রাজড়া ও জমিদারী প্রথা বিলুপ্ত হওয়ার পর উপমহাদেশ তথা বাংলায় এভাবেই নেতৃত্বের বিকাশ হয়েছে। রাজতন্ত্রের যুগেও বিচ্ছিন্নভাবে নেতৃত্বের স্ফুরন ঘটেছে। তবে রাজতন্ত্র বা জমিদারি প্রথার পারিবারিক নিষ্পেষনে সেসব আলোকছটা বেশীদূর এগোতে পারেনি। সেক্ষেত্রে আমাদের রাজনীতির উত্তরাধিকার বলতে যা বুঝায় তার বিকাশ ঘটে গত শতাব্দীর প্রথম ভাগে এবং তা অবশ্যই ক্ষমতার পালা বদলের সোপান হিসাবে সামনে এসেছে। আমরা যদি বঙ্গবন্ধুর বেড়ে উঠা এবং তার নেতৃত্বের পাদপীঠে উঠে আসার স্টেপগুলো দেখি তাহলে তার ঘাত প্রতিঘাতের শিক্ষা নিয়ে এগিয়ে চলার যে রাজনৈতিক স্পৃহা, তা সত্যিকার অর্থেই শিক্ষনীয় ও অনুকরনীয়। একথা বলতে দ্বিধা নেই যে রাজনীতির মন্ত্রই হচ্ছে মানবতা, সহমর্মিতা, দেশপ্রেম, কৃচ্ছ্বসাধন এবং দেশ ও জাতির মঙ্গল কামনায় নিজেকে সঁপে দেয়া। বঙ্গবন্ধুর “অসমাপ্ত আত্মজীবনী” তো আমাদের সেটারই জানান দেয়। অবিভক্ত বাংলার প্রথম প্রধানমন্ত্রী শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের জীবনী থেকেও আমরা এই শিক্ষা পাই যে নিজেকে বিকশিত করে এবং মেধা ও যোগ্যতার সাজুয্য ঘটিয়ে রাজনীতি ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার শীর্ষে আসা যায়। সেক্ষেত্রে জাতির মঙ্গল কামনায় নিজেকে সঁপে দেয়া এবং সতত জনকল্যানে নিঃস্বার্থভাবে কাজ করাই হচ্ছে রাজনীতির মূলকথা। সত্যিকার অর্থে রাজনীতির উত্তরাধিকার বলতে যা ঘটেছে এই ভূখন্ডে তা হোল মাটি ও মানুষের কাছাকাছি থেকে এবং জন মানুষের আপনজন হয়ে বেড়ে উঠে রাজনীতির নেতৃত্ব আমাদের রাজনীতিকে বিকশিত করেছে।
আমরা একজন বঙ্গবন্ধু পেয়েছি। পেয়েছি শেরে বাংলা, সোহরাওয়ার্দী, ভাসানীর মত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও নেতৃত্ব। তারা তাদের শ্রম মেধা ও কঠোর অনুশীলনে রাজনীতির উঠানে প্রস্ফুটিত হয়েছেন। তাদের সংস্পর্শে থেকে গড়ে উঠেছেন হাজারো রাজনৈতিক কর্মী ও নেতা। বাংলার আনাচে কানাচে ছড়িয়ে থাকা মুক্ত মনের তরুন যুবসারা তাদের আদর্শেই ছাত্র থেকে যুব রাজনীতি হয়ে মূল রাজনীতির উঠানে সামিল হয়েছেন। এভাবেই রাজনীতির অঙ্গন নেতা কর্মীদের কল কাকলিতে উচ্চকিত হয়েছে।
আমাদের মনে রাখতে হবে মুদ্রার দুটো পিঠ থাকে। এই দুই পিঠের চেহারা ও তার বিবরন দুরকম। যদিও সেটা মুদ্রা। মুদ্রার গুনাগুন বিচারে সে তার নিজস্ব ওজন ও মুল্য নিয়েই বিচরন করে। এক্ষেত্রে বৈশ্বিক নিয়মে চলার পথে মুদ্রা তার মান ও মুল্যগত মানদন্ডে মুল্যায়িত হয়। নেতৃত্বের উত্তরাধিকারী খোঁজার মানদন্ডে ইদানীংকার রাজনীতি চলছে মুদ্রার উল্টো পথের মত। আর্থাৎ যা কিছুই লেখ বা যতটুকুই তার ওজন হোক না কেন তার মুল্যমানে সেটা এক টাকা বা পাঁচ টাকাতেই নির্ধারিত। আজকের দিনে রাজনীতি করতে সততা সহমর্মিতা কৃচ্ছ্বসাধন বা দেশপ্রেমের প্রয়োজন পড়ে না।৷ মাসল আর অর্থ থাকলে পারিবারিক ডাইনেস্টির নেতৃত্বের আশীর্বাদ পুষ্ট হয়েই রাজনীতির নেতা হওয়া যায়। ছোটবেলায় দেখতাম ত্যাগ-তিতিক্ষা ও নীতি আদর্শের বলে বলীয়ান হয়ে সমাজ থেকে রাজনীতির নেতৃত্ব বেরিয়ে আসে। এখনকার দিনে বাংলা তথা তৃতীয় বিশ্বে রাজনীতির নেতৃত্ব আসে পারিবারিক বলয় থেকে। সেক্ষেত্রে রাজনীতির প্রথম পাঠ না থাকলেও বিগত হওয়া নেতার পরিবারের উত্তরাধিকারীরা চলে আসেন নেতৃত্বের উচ্চাসনে। আর প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে উঠে আসা পোড় খাওয়া গনমানুষের প্রবল প্রতাপশালী নেতারা হন তাদের সেকেন্ড বা থার্ড ইন কমান্ড। এক সময় নীতিবান ওইসকল নেতা কর্মীরা পারিবারিক বলয়ের পিছনে দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে নিজের আপন স্বকীয়তা ভুলে ফ্যামিলি ডাইনেস্টির মোসাহেব হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেন। তখন রাজনীতির বেসিক স্ট্রাকচারে তারা থাকতে পারেন না। কিংবা থাকতে চাইলেও ততদিনে ফ্যামিলি ডাইনেস্টির পরাক্রমশালী ক্ষমতার ছত্রছায়ায় থেকে রাজনীতির মূল আবেদন থেকে নিজেদেরকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেন। তখন মাটি থেকে উঠে আসা ওইসকল নীতিবান সফল নেতা কর্মীরা পারিবারিক আজ্ঞাবহ রাজনৈতিক কর্মী হিসাবে নিজেদের রুটি রুজির ধান্ধায় কিংবা স্বাচ্ছন্দে টিকে থাকার মানসে সমাজে বিচরন করেন। ফলে সমাজে তখন নতুন নেতৃত্বের আশা ফিকে পানসে হয়ে যায়। সেক্ষেত্রে সততা স্বচ্ছ্বতা ও নৈতিক আবহের রাজনৈতিক বিচরন তখন মরিচীকার পর্যায়ে ঠাঁই নেয়।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পরবর্তীকালে নেতৃত্বের শিখরে থাকা মহান নেতার বিয়োগান্তক বিদায়ের পর যখন এদেশে সামরিক শাসন এল তখন নেতৃত্বের পাদদেশে এলেন ব্যারাকে থাকা ক্যান্টমেন্টের পোষাকী মানুষ। তিনি তার খায়েশে রাজনীতি করে গনমানুষের পছন্দের রাজনীতিবিদ হয়ে প্রবল প্রতাপে দেশ শাসনে ব্রতী হলেন। তারও বিয়োগান্তক বিদায় হোল। এলেন আর এক পোষাকী জেনারেল। তিনি তার ধুর্ত্যামীর পারংগমতায় এক দশক দেশ শাসন করলেন। ততদিনে তৃণমুল থেকে রাজনীতি করে আসা মানুষগুলো জাতীয় রাজনীতির নেতৃত্বে গ্রহনযোগ্যতা না পেয়ে অবশেষে নিজেদের রাজনৈতিক অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার মানসে মহান নেতার পারিবারিক বলয়কে সামনে রেখে নিজেদেরকে আবদ্ধ করে ফেলেন। পাশাপাশি গনমানুষের পছন্দের জেনারেলের পারিবারিক ফ্রন্ট তৈরী করে রাজনীতির এক অদ্ভুতুড়ে ফ্যামিলি ডাইনেস্টির সুত্রপাত করেন। এভাবেই বাংলার রাজনীতিতে ফ্যামিলি ডাইনেস্টির সুত্রপাত হয়ে রাজনীতির উত্তরাধিকার নির্নয়ে এক অলিখিত রাজা রাজড়া আদলের গনতন্ত্রে বাংলাদেশের পথচলা শুরু হয়। ফলে ফিডব্যাক বা মাটি থেকে উঠে আসা নেতৃত্বের ধারা এএভাবেই বিনষ্ট হয়ে গেল। এখন জাতীয় নেতৃত্বের মগডালে দুই উত্তরসুরী ও তাদের উত্তর পুরুষদের জয়জয়কার। রাজনীতি হবে, গনতন্ত্র হবে কিন্তু নেতৃত্বে আসবেন সেই রাজা রাজড়ার আদলে ফ্যামিলি ডাইনেস্টির উত্তরাধিকারীরা। সে জাতীয় পর্যায়ের টপ লেভেলেই হোক কিংবা ব্যাক্তি পর্যায়ের মাঠ লেভেলেই হোক – সর্বক্ষেত্রে এই একই নীতি আমাদের রাজনীতির উত্তরাধিকার নির্নয়ের মাপকাঠি।
আমাদের রাজনীতির উত্তরাধিকার আজ এভাবেই বাংলার আনাচে কানাচে তাদের প্রবল পরাক্রম ও শক্তি নিয়ে বিদ্যমান। এ থেকে বেরিয়ে আসার পথ আমাদের অজানা। উত্তরাধিকারের ভোগ বিলাসী রাজনীতির রাহু থেকে বেরিয়ে আসতে হলে আমাদের প্রয়োজন গ্রাম থেকে উঠে আসা সেই মুজিব বা ভাসানীদের, যাদের সংস্পর্শে বাংলার মানুষ হেসেছিল কেঁদেছিল এবং এখনো কাঁদে।