জালাল উদ্দিন আহমেদ
আপনি আচরি ধর্ম
প্রকাশ: ১০:১৮ পিএম, ১৯ নভেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২০ | আপডেট: ১১:৩১ পিএম, ১৮ ডিসেম্বর, বুধবার,২০২৪
সংস্কৃতে একটি প্রবাদ আছে “আপনি আচরি ধর্ম”। সম্ভবতঃ শিক্ষা জীবনের বুনিয়াদ বিনির্মানের সময় এই প্রচলিত প্রবাদটি আমাদের শিখানো হয়েছিল। সেই ছোটবেলার কথা। তবে বর্তমান সময়ে 'আচরি' থেকে যে আচরনে আমরা আছি তাতে সেটা ভুলে যাওয়ারই কথা। আমার পারিপার্শ্বকতা বিশেষ করে রাজনীতির অস্বচ্ছ আচরন ও রাষ্ট্রীয় দুর্বৃত্তায়নে সৃষ্ট
সামাজিক মুল্যবোধের অবক্ষয়ে সে কথাই
জানান দেয়। এখনকার সময়ে তাই নিজেদের কথা ভুলে আমরা পরচর্চা ও আচরন নিয়েই বেশী ব্যস্ত থাকি। এটা আমাদের জাতিগত ভাবেই এখন মজ্জাগত হয়ে গেছে। আমি কি করছি, কোথায় দাঁড়িয়ে আছি, কোন মানদন্ডে আমার অবস্থান–এসব জিগ্যাসার কোন পরিকাঠামোতেই আমরা নেই। আমরা কে, কি, কেন এসব জিগ্যাসার সঠিক জবাব কি আমাদের আছে!
আমাদের রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি ও রাষ্ট্রনীতির সমস্ত কিছুর বিবেচনায় আমরা কি “আপনা আচরি ধর্মে”র পর্যায়ে আছি? যদি থেকেও থাকি তবে কতটুকু আছি কিভাবে আছি সে থাকার ওজনই বা কতটুকু তা ভাবতে হবে বৈকি? বাংলার আঙ্গিনায় একটি প্রবাদ বেশ প্রচলিতই বলা যায়। জানি না এটা খণার বচন কি না। তবে বাঙালীর সামাজিক ও রাজনীতির চলনে এই প্রবাদটি বহুল ব্যবহৃতও বটে। “ যার বিয়ে তার খবর নাই, পাড়া পড়শির ঘুম নাই”। এই প্রবাদের সঙ্গে আমরা বেশ লাগসই বলা যেতে পারে।
এতসব কথা বলা হোল এই কারনে যে বিগত একমাস ধরে আমাদের ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়া এবং সেসবের একেকজন বাঘা বাঘা বুদ্ধিজীবি(!) যেভাবে তাদের মাথার ঘাম পায়ে ফেলে গলদঘর্ম থেকেছেন এবং এখনো তা নিয়ে একই স্পীডে কপচিয়ে যাচ্ছেন তা সত্যিকার অর্থেই নিজেদেরকে অন্যমাত্রায় নিয়ে যাওয়ার একটি প্রচ্ছন্ন ধারনা দেয়। প্রসঙ্গগটি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। একটি দেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে যে আয়োজন ও এন্তেজামে আমাদের মিডিয়গুলো সরব এবং নীতি ও নৈতিকতায় যেসব চুলচেরা বিশ্লেষন আমরা দেখলাম এবং এখনো দেখছি তা রীতিমত চমৎকার ও বাহবা পাওয়ার যোগ্য। এমন অবাধ ও সত্য উচ্চারনের কথাবার্তা অনেকদিন শোনা হয়নি। কি স্বতঃস্ফুর্ত পান্ডিত্যের ঝলক। সে টিভি টকশো বলুন কিংবা পত্রিকার উপ সম্পাদকীয়। সবখানে সরব ও নির্মোহ নিরপেক্ষতার নিক্তিতে চুলচেরা বিশ্লেশন। এরাই তো আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রের মুখ এবং বিবেক। এদের সত্য ভাষনেই তো আমরা বাঙালীরা আলোর পথ পেয়েছি। শিখেছি-জেনেছি-জ্ঞানার্জন করেছি। এরা শিক্ষক, এরা সমাজ বিজ্ঞানী, রাষ্ট্র বিজ্ঞানী এবং জাতির বিবেক। আন্তর্জাতিকতাবাদের বহু ক্ষেত্রে এসব পন্ডিতেরা তাদের জ্ঞানের সততা ও কর্ম প্রচেষ্টায় নিজেদের উৎকর্ষতা বাড়িয়েছেন। বাঙালী হিসাবে এসব পন্ডিত বা বুদ্ধিজীবিরা নিজেদেরকে অন্যমাত্রায় উপস্থাপন করে খ্যাতি কুড়িয়েছেন। স্বচর্চায় এদের পথচলা কুসুমস্তীর্ন বিধায় অবাধ গতিতে এদের পরচর্চা বিকশিত হয়েছে।
বিগত একমাস ধরে এসব পন্ডিতদের ব্যাখ্যা বিশ্লেষন শুনে যা মনে হোল তাতে দেখা যায় আমেরিকার আর্থ-সামাজিক ও রাজনীতি এদের বহুদিনের চেনা গলিপথ। তাছাড়া বাংলাদেশের ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার অবাধ আয়োজনে এদের স্বতঃস্ফুর্ত ও নির্মোহ বক্তব্য শুনেমনে হোল “আহারে এইসব পন্ডিতেরা যদি নিজ দেশের অলিগলির চুলচেরা বিশ্লেষনে নিজেদেরকে নিয়োজিত করতেন তাহলে আমাদের দেশটার চেহারাটাই বদলে যেত”। কিন্তু সমস্যা তো অন্যখানে। এইসব মুখচেনা পন্ডিত বা বুদ্ধিজীবিরা যখন আপন চিন্তায় মগ্ন হয়ে দেশ মার্তৃকার ভালমন্দের চুলচেরা বিশ্লেষনে তাদের নির্মোহ অভিমত প্রকাশে অগ্রসর হন তখন তাদের হাতে পায়ে বেড়ি বেঁধে ক্যামেরার সামনে আনা হয়। নিজ দেশের বা আপনি আচরির বিষয়টা তখন স্বতঃস্ফুর্ততায় চাঙ্গা থাকতে পারে না। নিজের কথা তখন তারা নিজের মত করে বলতে পারেন না। কোন এক অদৃশ্য চোখ রাঙানী তখন জ্ঞান চর্চার মুক্তবাককে বেড়ি বেঁধে আটকিয়ে দেয়া হয়।
দেশে গনতন্ত্রের নামে, দেশ পরিচালনার নামে এবং বাংলার আনাচে কানাচে রাজনীতির নামে যে অনৈতিক ও অশুদ্ধ আচরনের সার্কাস চলছে তাকে লাগাম দেয়ার মুক্তচিন্তায় আমরা আছি কি? একজন বুদ্ধিবৃত্তির সম্মানিত অধ্যাপক যখন রাজনীতির পক্ষ-বিপক্ষের শিখন্ডি হয়ে নিজ দেশের সামাজিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কথাবার্তা নিয়ে ক্যামেরার সামনে প্রকাশিত হন তখন বাংলার খন্ডিত চেহারার উন্নয়ন ও রাজনীতির কথকতা আমাদের আশাহত করে। নিজ দেশের অখন্ডতার সর্বময়তার আঙ্গিকে উপস্থাপনে তারা ব্যর্থ হন বা তাদেরকে সেপথে হাঁটতে নিবৃত করা হয়। এক্ষেত্রে মিডিয়াগুলোই বোধ হয় এসব ব্যাপারে স্বতঃস্ফুর্ত। কারন গনতন্ত্র ও রাজনীতি নামক কর্মধারার আশীর্বাদে প্রতিষ্ঠিত বাংলার সিংহভাগ মিডিয়া আজ পক্ষ বিপক্ষের রাজনীতির ক্রীড়নক হিসাবে তাদের কর্মকান্ড সুচারু রূপে সম্পন্ন করছে বলে বিজ্ঞজনেরা বলে থাকেন।
এই যে দেশে এতকিছু অঘটন ও অনৈতিক কায়কারবার চলছে তার পোষ্টমর্টেমে তো বুদ্ধিজীবিদেরই সর্বাগ্রে এগিয়ে আসতে হবে। কোথাও মুক্তকন্ঠে কথা বলার জো নেই। যদিওবা ছিটেফোঁটা আলোচনা সমালোচনা দেখা যায়, সেটাও বাঁধা শেকলের বেড়ির মধ্যে থেকেই বলতে হয়। প্রতিবাদ করার ভাষায় সাধারন মানুষ রাস্তায় দাঁড়িয়ে মৌন মানব বন্ধনেও বাধাগ্রস্ত হন। তাছাড়া চ্যাম্পিয়ন জাতির চ্যাম্পিয়ন আইন কানুনে কথা বলা বা প্রতিবাদ করার আদব লেহাজও বাতলে দেয়া হয়।
সুতরাং কোন দুঃখে এক জীবনের এই মানুষ বিশেষ করে বাঙালী জাতি তার বাল্য শিক্ষার “আপনি আচরি ধর্ম” পালনে মুক্তকন্ঠে স্বদেশের অলগলিতে বিচরন করবে-বলতে পারেন! তথাস্তু ভাবনায় তাই আমাদের মাথাওয়ালারা আমেরিকা ইউরোপের নিকাশী করে খ্যাতি কুড়াচ্ছেন। এই নিয়ে যে কথা শুনতে হয় না তা কিন্তু নয়। তির্ষক সমালোচনায় তারা মাঝে মধ্যেই বিদ্ধ হন। “নিজ দেশের হাজারো অনিয়ম ও উইপোকার ঢিপির মত বেড়ে চলা রাজনীতির অনৈতিকতা ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসকে পাশ কাটিয়ে তোমরা কোন মুখে আমাদেরকে নিয়ে আলোচনা সমালোচনা কর” এসব প্রশ্নের উত্তরে তারা ক্ষনিকের জন্য হলেও সে সময় নিথর বা অপ্রস্তুত হয়ে যান।
দেশের হাজারো কথা ও কর্মে আজ আমরা জর্জরিত। মুক্তমনে মত প্রকাশের অবকাশ নেই আজ বিশ্বের “রোল মডেল” খ্যাত গনতান্ত্রিক দেশে। পক্ষ-বিপক্ষের তকমা লাগিয়ে দেশকে বিভাজিত করা হয়েছে। বিপক্ষে কথা বললে বা আলোচনা করলে শত্রুপক্ষ হয়ে শক্ত আইনের বেড়াজালে আবদ্ধ হবেন নতুবা দলকানা রাষ্ট্রীয় মেকানিজমের রোষানলে পড়ে জীবনভর মামলা হামলার কষাঘাতে জীবন ও জীবিকা বিষাক্ত হয়ে যাবে। সুতরাং উন্নয়নের রোল মডেলের দেশে আজ মানুষ শুধু উন্নয়ন দেখে যাবে। মুক্ত নিঃশ্বাসে ভোগ করার কোন অবকাশ তাদের নেই। পাঁচ'শ টাকার বালিশ পাঁচ লাখ টাকায় শাব্যস্ত হলেও তার করার কিছু নেই। ন'হাজার কোটি টাকার প্রকল্প মুল্য বেড়ে নব্বই হাজার কোটি হলেও করদাতা হিসাবে তার কোন বক্তব্য এখানে কচুপাতার ফোঁটা জলের মতই গড়াগড়ি খায়।
পরচর্চা,পরনিন্দা এবং পরোপকার করেই আমাদের জীবন ও জীবিকার সন্ধানে ছুটে চলা। নিজের হেসেলে কি হচ্ছে তার খবর রাখার জো কি আমাদের আছে! আমলাতান্ত্রিক কামলার সর্বোচ্চ আসনের কতিপয় অবসরীয় আদম আজ দেশের রাষ্ট্রনীতি ও রাজনীতির বড়বাবু সেজে গনতান্ত্রিক রাজনীতির রাষ্ট্র পরিচালনার সর্বোচ্চ মন্ত্রক হয়েছেন। এই সুত্রে দেশের সর্ব উঠানে আজ আমলারা মুক্ত বিহঙ্গের মত বিচরন করছেন। সর্বক্ষেত্রে আজ “বিধিবদ্ধতা”র এন্তেজাম। এবং সেটা শুধুই আম জনতার জন্য। রাজনীতির আদর্শ যখন কলুষিতার পঙ্গিলতায় আচ্ছন্ন হয় তখন এসব বাঙালী আমলারা নিজেদের বেন্টিং ডায়ারদের চলনে বলনে স্বরূপে আবির্ভূত হন। আমরা তো কোন ছার। তখন আপন ঐতিহ্য ভুলে ওইসব শপথ নেয়া মানুষেরাও পরচর্চা নিয়ে প্রকাশ্য হন। তাইতো দেখি, শপথ নেয়া মহামান্যও চুপ থাকতে না পেরে নিজের ফোকলা দাঁতের দিকে নজর না দিয়ে গর্ব করে বলে ফেলেন “নির্বাচন বিষয়ে আমেরিকারও আমাদের কাছে শিক্ষা নেয়ার আছে”।
সত্যই সেলুকাশ! কি বিচিত্র এই দেশ।