avertisements 2

বেশি মাত্রায় ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব

ড. মিহির কান্তি মজুমদার
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ১৬ জুলাই,রবিবার,২০২৩ | আপডেট: ১০:৫৪ এএম, ২৬ ডিসেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪

Text

উষ্ণমন্ডলীয় এলাকার রোগ ডেঙ্গু, যার শুরু আফ্রিকা মহাদেশে। রোগটি আফ্রিকা এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশে সীমিত ছিল শত শত বছর ধরে।  জাহাজযোগে বৈদেশিক বাণিজ্যের প্রসারের সাথে সাথে এডিস প্রজাতির এ মশা জাহাজে করে দেশান্তরী হয়। সাথে নিয়ে যায় ডেঙ্গু ভাইরাস। বর্তমানে সারা পৃথিবীতে বিশেষ করে বাংলাদেশসহ অনেক দেশে  শক্তভাবেই আস্তানা গেড়েছে। এদেশে ১৯৬০ এর দশকে ডেঙ্গু ধরা পড়লেও প্রাণঘাতী হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছে সেই ২০০০ সালে। তারপরে প্রতি বছর কিছু কিছু  সংক্রমণ ঘটেছে। তবে ২০১৯ সালে প্রাদুর্ভাব ঘটিয়েছে বেশ জোরেসোরেই। পরবর্তী একটু বেশি মাত্রার প্রাদুর্ভাব ২০২১ ও  ২০২২ সালে করোনা মহামারীর মধ্যে। তবে এ বারের সংক্রমণের মাত্রা আরো বেশি। বর্তমান সময়ে দু’হাজারের বেশি রোগী হাসপাতালে ভর্তি। বাড়ীতে কতজন চিকিৎসা নিচ্ছেন সে পরিসংখ্যান জানা নেই। আক্রান্ত রোগীর শতকরা ২৫ ভাগেরও বেশি শিশু। এ রোগে এ বছরে মৃত্যুও ঘটনাও বেশি। ৬০ জনের বেশী মৃত্যু হয়েছে জুন মাস পর্যন্ত। 

ডেঙ্গু যে দেশে প্রবেশ করে, সে দেশ থেকে সহজে আস্তানা উঠায়না। বরং আস্তানার খুঁটি শক্ত করে প্রতিবছর। কারণ এ রোগের বাহক এডিশ প্রজাতির মশা। এ প্রজাতির মশা ডেঙ্গুর পাশাপাশি চিকুনগুনিয়ার প্রাদুর্ভাব ঘটিয়েছে।  পৃথিবীতে মশা প্রতি বছর যত রোগ সৃষ্টি করে  ও মানুষের মৃত্যু ঘটায়, আর কোন জীব তার ধারে কাছেও থাকেনা। প্রতি বছর পৃথিবীতে মশা সংক্রমিত রোগে দশ লক্ষাধিক মানুষের মৃত্যু হয়। মশার বংশ বিস্তার পদ্ধতি খুবই দ্রæত। একটি মশা প্রতি ০৩ দিন অন্তর ডিম পাড়ে। কিউলেক্স প্রজাতির মশা ময়লা পানিতে ডিম পাড়ে। ডেঙ্গু রোগের বাহক এডিস ইজিপ্টাই স্বচ্ছ/পরিষ্কার বদ্ধ পানিতে ডিম পাড়ে। এমনকি এক চামচ পরিমাণ স্বচ্ছ পানি থাকলেও তার ডিম পাড়ার জন্য যথেষ্ট। তাই অন্য প্রজাতির মশা কখনই নির্মূল করা না গেলেও ডেঙ্গু রোগের বাহক এডিস ইজিপ্টাই মশা নিয়ন্ত্রণ অন্য মশার চেয়ে একটু সহজ। পরিষ্কার বদ্ধ পানির উৎস বন্ধ করলেই যথেষ্ট। তাছাড়া এ শ্রেণীর মশা সন্ধ্যা ও সকালের আলো আঁধারিতে কামড়ায়। দিনে বা রাতে এরা ঘরের দড়ি, কাপড় ও অনুরুপ ঝুলন্ত বস্তুতে বসে থাকে। কাজেই অন্য মশার চেয়ে এ মশা নিধন করা আরো বেশী সহজ। চাই একটু বেশি সচেতনতা এবং একটু বেশি উদ্যোগ। 
অথচ এ কাজটা আমরা মোটেই করতে পারিনি। আর পারিনি বলে প্রতি বছর ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বাড়ছে। বাড়ছে রোগের তীব্রতা ও মারণঘাতী ক্ষমতা। কারণ ডেঙ্গু ভাইরাসের ৪টি সেরোটাইপ আছে। কোন সেরোটাইপে আক্রান্ত হলে ঐ সেরোটাইপের এন্টিবডি শরীরে তৈরী হয়। কিন্তু অন্য সেরোটাইপের সংক্রমণের আশঙ্কা থাকে। দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হলে রোগের তীব্রতা ও মারণঘাতী ক্ষমতা বাড়ে। ৪টি সেরোটাইপ বিধায় একজন ব্যক্তি সর্বমোট ৪ বার এ রোগে আক্রান্ত হতে পারেন। কিন্তু দ্বিতীয়, তৃতীয় বা চতুর্থবার আক্রান্তের ক্ষেত্রে রোগের ভয়াবহতা বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কাও বৃদ্ধি পেতে থাকে । বর্তমানে ডেঙ্গু ভাইরাসের সেরোটাইপ ২ ও ৩ তান্ডব চালাচ্ছে। এর মধ্যে সেরোটাইপ ২ সংক্রমিত রোগীর সংখ্যাই বেশী।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর প্রতি বছর বর্ষার পূর্বে, বর্ষাকালে এবং বর্ষা পরবর্তীকালে মশার জরীপ চালায়। গত জুন মাসে প্রাক-বর্ষা জরীপে ঢাকার ৯৮টি ওয়ার্ডের ৫৫টিতে উচ্চমাত্রার এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেছে। মশার লার্ভা প্রাপ্তির ঘনত্বকে “ব্রæটো ইনডেক্স” নামে চিহ্নিত করা হয়। যদি ১০০টি পাত্র পরীক্ষা করে ২০টি পাত্রে মশার লার্ভা পাওয়া যায় তবে “ব্রæটো ইনডেক্স ২০” গণ্য করা হয়। এ সমীক্ষায় ৫৫টি ওয়ার্ডে ব্রæটো ইনডেক্স ২০ এর বেশি। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের ৩৫ নং ওয়ার্ডে (মগবাজার, দিলু রোড, পেয়ারাবাগ) এ ইনডেক্সের হার ১০০। অর্থ্যাৎ সমীক্ষায় নেওয়া সকল পাত্রেই এডিশ মশার লার্ভা আছে। এরুপ অবস্থা চলতে থাকলে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব কেন কমবে? সিটি কর্পোরেশনই বা কি করবে? সিটি কর্পোরেশন কয়েকটি ড্রোন দিয়ে এডিশ মশার উৎস খোঁজার চেষ্টা করছে। সকল বাড়ীর ছাদ দেখতে গেলে ড্রোন লাগবে শত শত। সাথে থাকবে শত শত জনবল। ড্রোন দিয়ে না হয় ছাদের পাত্র দেখা যাবে। কিন্তু ঘরের আনাচে কানাচে দই/ আইসক্রিম/কপির কাপ, বোতলের ছিপি, ভাঙ্গা পাত্র, পুরানা টায়ারে জমা পানি কে দেখবে? ঘরের টব, ছোট পাত্র, ফ্রিজের নিচের জমা পানি নিজ নিজ বাড়ীর লোকজনকেই দেখতে হবে। বর্জ্য ছুড়ে ফেলার উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া অভ্যাস আমাদের বদলাতে হবে।
ডেঙ্গু জ্বরের উপসর্গের মধ্যে আছে উচ্চমাত্রার জ্বর, শরীরের গিটে গিটে ব্যথা, চোখ ব্যাথা, পেট ব্যাথা, বমি হওয়া। তবে বিপদজনক লক্ষণ হচ্ছে মাড়ি বা নাক থেকে রক্তপাত, পায়খানার সাথে রক্ত যাওয়া, শরীরে পানি জমা, রক্তচাপ কমে যাওয়া, অতিরিক্ত রক্তপাত, অচেতন হওয়া বা শক সিনড্রমে চলে যাওয়া ইত্যাদি। এসব ক্ষেত্রে হাসপাতাতে ভর্তি হয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসা সেবা নিতেই হবে। মনে রাখতে হবে ডেঙ্গু জ্বর কমে যাবার কয়েকদিনের মধ্যে এসব মারাত্মক উপসর্গ দেখা দিতে পারে।
স্বাভাবিকভাবে একজন মানুষের শরীরে প্রতি মাইক্রোলিটারে ১.৫ থেকে ৪.৫ লক্ষ প্লাটিলেট থাকে। এটি রক্তের একটি প্রোটিন, যা রক্ত জমাট বাঁধতে সাহায্য করে। শতকরা ৮০ ভাগ ডেঙ্গু রোগীর ক্ষেত্রে এ মাত্রা এক লক্ষের নিচে নেমে যায়। শতকরা ১০ থেকে ১৫ ভাগ রোগীর প্লাটিলেট ২০০০০ এর নিচে নেমে যায়। প্লাটিলেট রক্ত জমাট বাঁধার উপকরণ, কাজেই এটি কমে গেলে রক্তক্ষরণের আশঙ্কা বৃদ্ধি পায়। প্লাটিলেট ১০০০০ এর নিচে নামলে  শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে রক্তক্ষরণ শুরু হয়। রোগের এ মারাত্মক পর্যায়ে রোগী শক সিনড্রোমে চলে যায়, কোন কোন ক্ষেত্রে রোগী মৃত্যুবরণ করে। কাজেই, প্লাটিলেট কমা ঠেকাতে হবে, রক্তক্ষরণ বন্ধ করতে হবে। রক্তকনিকা তৈরী হয় অস্থিমজ্জায়। ভাইরাস সেখানে সংক্রমণ করলে প্লাটিলেট তৈরী হতে পারেনা। রোগীর রক্তে তখন অন্যের রক্তের প্লাটিলেট দিতে হয়। সবুজ শাক-সবজি, পেঁপে পাতার রস, টক জাতীয় ফল, আয়রন সমৃদ্ধ খাবার, ভিটামিন-সি খেলে প্লাটিলেট বাড়ে।
ডেঙ্গু রোগ প্রতিরোধে এডিস মশার বংশ বিস্তাররোধে গণ সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। পাশাপাশি বর্জ্য ছুঁড়ে ফেলার মানসিকতা সম্পূর্ণ পরিহার করতে হবে। নিজ নিজ বাড়ীর ভিতর এবং বাইরে স্বচ্ছ পানি জমার ছোট-বড় সকল পাত্র ধ্বংস করতে হবে, অথবা সেখানে পানি না জমার ব্যবস্থা নিতে হবে। ডেঙ্গু সংক্রমণ ঘটলে প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ দিয়ে জ্বর কমাতে হবে, বারবার ভেজা কাপড় দিয়ে শরীর মুছে শরীরের উত্তাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। বেশি বেশি পানি ও তরল খাবার খাওয়াতে হবে। কোন ক্রমেই এসপিরিণ ও প্রদাহনাশক ওষুধ (আই-ব্রæফেন) খাওয়ানো যাবেনা। কারণ এগুলো রক্ত পাতলা করে। রক্ত জমাট রাখার উপাদান প্লাটিলেট কমে যাওয়ায় এসপিরিণ শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের রক্তক্ষরণ ত্বরান্বিত করে । মোট কথা ডেঙ্গু প্রেিরাধ এবং ডেঙ্গু রোগ ব্যবস্থাপনায় আমাদের অনেক কিছু করতে হবে। এটি একটি সামাজিক সমস্যা। যে কোন সামাজিক সমস্যা নিরসনে সমাজের সকল অংশের মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। শুধু সিটি কর্পোরেশনের উপর দোষ চাপিয়ে লাভ হবেনা। আমাদের সমস্যা আমাদেরকেই নিরসন করতে হবে। না হলে ডেঙ্গুতো যাবেই না, ভবিষ্যতে জিকা ও ইয়োলো ভাইরাস সংক্রমণের রাস্তা তৈরী করবে। কারণ এডিস ইজিপ্ট প্রজাতির মশা ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার পাশাপাশি জিকা ও ইয়োলো ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটায়। 

লেখকঃ সাবেক সচিব

বিষয়:

আরও পড়ুন

avertisements 2