avertisements 2

ষড়যন্ত্র, তথ্য পাচার ও বিশ্বাসভঙ্গের অভিযোগে বিতর্কের কেন্দ্রে

সাবেক সচিব নূরুল ইসলামের বিরুদ্ধে অভিযোগের পাহাড়

নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ১১ এপ্রিল,শুক্রবার,২০২৫ | আপডেট: ০৩:৫১ এএম, ১৩ এপ্রিল,রবিবার,২০২৫

Text

সাবেক সচিব ও বর্তমান গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেড (জিটিসিএল)-এর বোর্ড চেয়ারম্যান এবং “উদ্দীপন” এনজিও’র প্রশাসক এ এইচ এম নূরুল ইসলাম একাধিক অনিয়ম, তথ্য পাচার ও ষড়যন্ত্রমূলক কর্মকাণ্ডের অভিযোগে আবারও বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে এসেছেন।

উদ্দীপনের সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) বিদ্যুৎ কুমার বসুকে জোরপূর্বক পদত্যাগে বাধ্য করার ঘটনায় এ এইচ এম নূরুল ইসলামের প্রত্যক্ষ মদদ ছিল বলে অভিযোগ করেছেন সংস্থার একাধিক কর্মকর্তা। অভিযোগে বলা হয়, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সংস্থার প্রধান কার্যালয়ে সিইওকে অফিসে আটকে রেখে মানসিক চাপে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়। বিষয়টি আদাবর থানায় সাধারণ ডায়েরির (জিডি) মাধ্যমে নথিভুক্ত আছে।

দায়িত্বে থেকেও প্রশাসক নীরব

প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর তার মূল কাজ ছিল সংস্থায় নির্বাচন আয়োজন ও একটি গ্রহণযোগ্য বোর্ড গঠন নিশ্চিত করা। কিন্তু দীর্ঘ সময় পার হলেও তিনি নির্বাচন দেননি বরং সংস্থার কার্যক্রমে সরাসরি হস্তক্ষেপ করে নানা সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। সংস্থার একাধিক উন্নয়ন প্রকল্প হঠাৎ করেই বন্ধ করে দেওয়া হয়, যার ফলে কয়েকশ' কর্মকর্তা-কর্মচারী অনিশ্চয়তায় পড়েছেন।

অভিযোগ: আর্থিক অনিয়ম ও নিয়োগে স্বজনপ্রীতি

সূত্র জানায়, প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর এ এইচ এম নূরুল ইসলাম তার ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসান। মানবসম্পদ বিভাগের উপপরিচালক মনির হোসেনের নেতৃত্বে একটি গোষ্ঠী বর্তমানে সংস্থার আর্থিক খাতসহ যাবতীয় সিদ্ধান্ত নিয়ন্ত্রণ করছে। ঋণ কার্যক্রমে স্বচ্ছতা নেই, নিয়োগ-বিনিয়োগে নিয়মনীতি উপেক্ষিত হচ্ছে—এমন অভিযোগ পাওয়া গেছে।

বিশেষ স্বার্থে প্রভাব খাটানোর অভিযোগ

অভিযোগ রয়েছে, এ এইচ এম নূরুল ইসলাম তার প্রশাসনিক ক্ষমতা ব্যবহার করে সংস্থার জমি ও অন্যান্য সম্পদে প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করছেন। উদ্দীপনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন বোর্ড কিংবা সংশ্লিষ্ট কমিটির অনুমোদন ছাড়াই।

প্রথম আলোচনায় উঠে আসেন ষড়যন্ত্রমূলক তদন্ত দিয়ে

২০০১-২০০৬ সালে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার একান্ত সচিব হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পরপরই শুরু হয় তার প্রতি সন্দেহ। অভিযোগ রয়েছে, প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত না করে বিএনপির তৎকালীন সিনিয়র নেতা তারেক রহমান ও প্রয়াত মন্ত্রী আব্দুল মান্নান ভূঁইয়ার বিরুদ্ধে দুর্নীতির তদন্তে নির্দেশ দেন তিনি। সেই অভিযোগ ছিল বেনামি দরখাস্তের ভিত্তিতে—যা প্রশাসনিক রীতিনীতি ও পদসংশ্লিষ্ট গোপনীয়তা লঙ্ঘনের সামিল। শুধু তাই নয়, অভিযোগে বলা হয়, অফিসের গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্ট সিডিতে কপি করে ডিজিটাল পদ্ধতিতে পাচার করেন তিনি, যা এক ভয়ানক তথ্য সুরক্ষা লঙ্ঘনের উদাহরণ।

এর পরই তাকে বরখাস্ত করা হয়, এবং বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয় জনস্বার্থে—যা ছিল গুরুতর অপরাধের তুলনায় নিতান্তই হালকা শাস্তি।

মিথ্যা বয়ানে বিভ্রান্তিকর সাক্ষাৎকার

২০০৭ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি, দৈনিক ‘প্রথম আলো’ পত্রিকায় প্রথম পাতায় বড় শিরোনামে “দ্বিতীয় মেয়াদে খালেদা জিয়া বেপরোয়া হয়ে পড়েন” শিরোনামে একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়, যেখানে এন আই ইসলাম খালেদা জিয়া ও বিএনপির শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে বিভ্রান্তিকর, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও বানোয়াট বক্তব্য প্রদান করেন। পরদিনই সেই সাক্ষাৎকার ইংরেজিতে অনুবাদ করে ‘দ্য ডেইলি স্টার’ এ প্রকাশ করে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিএনপির ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করার চেষ্টা চালানো হয়।

 

আদালতে রিট ও বিচারকের বিতর্কিত রায়

জনাব ইসলাম বাধ্যতামূলক অবসরের বিরুদ্ধে আদালতে রিট দায়ের করেন। বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক ও মো. মমতাজ উদ্দিন আহমেদের বেঞ্চ রায়ে উল্লেখ করে, তাকে “অসহনীয় চাপে” বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা এই রায় নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, কারণ দুই বিচারপতি ও তৎকালীন এন আই খান ছিলেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী সরকারের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত।

অতীত ষড়যন্ত্রের ধারা অব্যাহত: উদ্দীপন ও জিটিসিএল নিয়ন্ত্রণে প্রশ্ন

বর্তমানে “উদ্দীপন”-এর প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালনে তার বিরুদ্ধে উঠেছে ক্ষমতার অপব্যবহার, স্বজনপ্রীতি, এবং এনজিও নির্বাচন না দিয়ে একক কর্তৃত্বে চলার অভিযোগ। সংস্থার পুরোনো কর্মকর্তাদের মত প্রকাশে বাধা ও প্রকল্প বন্ধ করে কর্মীদের বেকার করে দেওয়ার মতো সিদ্ধান্তও তার বিরুদ্ধে অভিযোগের তালিকায় রয়েছে।

একইসাথে, জিটিসিএল-এর মত একটি কোটি কোটি টাকার লেনদেন ও গ্যাস সরবরাহ নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানে চেয়ারম্যান হিসেবে তার নিয়োগও প্রশ্নবিদ্ধ। অতীতে যিনি গোপন নথি পাচার ও ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল ও নেতাদের বিভ্রান্তিকরভাবে জনসমক্ষে হেয় করতে সক্ষম হন, তিনি এখন একটি রাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় কী ভূমিকা পালন করছেন, তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা।

বিশ্লেষণ: বিশ্বাসভঙ্গের ইতিহাস ও বর্তমান দায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন

নূরুল ইসলামের অতীত কর্মপন্থা, রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট গোপন ষড়যন্ত্র এবং তথ্য ফাঁসের অভিযোগ—সব মিলিয়ে তাকে গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে রাখার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একজন সচিবের কাছে রাষ্ট্র ও জনগণের বিশ্বাস সবচেয়ে বড় সম্পদ। আর সেই বিশ্বাসভঙ্গ যিনি একাধিকবার করেছেন, তার হাতে জনস্বার্থ কি নিরাপদ?

বিষয়:

আরও পড়ুন

avertisements 2