ডিসি অফিসের নাজিরের আলিশান ভবন, কয়েক কোটি টাকার সম্পদ
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১২:৪৬ এএম, ১১ সেপ্টেম্বর,শুক্রবার,২০২০ | আপডেট: ১০:২৮ পিএম, ২৩ ডিসেম্বর,সোমবার,২০২৪
বরিশাল ডিসি অফিসের নাজির হাবিবুর রহমান। সাকুল্যে বেতন কুড়ি হাজার টাকা। এর মধ্যে ৫ হাজার ২০০ টাকা জমা রাখেন ভবিষ্যৎ তহবিলে। চলমান দুর্মূল্যের বাজারে বাকি ১৪ হাজার ৮০০ টাকায় যখন ৪ জনের সংসার চালানোই দায়, তখন বরিশাল নগরীর গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় আলিশান বাড়ি করেছেন তিনি, গড়েছেন কয়েক কোটি টাকার সম্পদ।
ছেলেকে পড়াচ্ছেন ঢাকায় বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসে (বিইউপি)। কোন আলাদিনের চেরাগবলে এত কিছু করলেন হাবিব, তার অনুসন্ধানে নেমেছে দুদক।
এরইমধ্যে চিঠি দেয়া হয়েছে সব ব্যাংক ও ভূমি অফিসে। তবে অভিযোগ অস্বীকার করে হাবিবুর রহমান দাবি করেছেন, বৈধ আয়েই এসব সম্পদ গড়েছেন তিনি।
হাবিবুরের বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির নানা অভিযোগ যায় দুর্নীতি দমন কমিশনে। এর ভিত্তিতে দুদক বিষয়টি তদন্তের দায়িত্ব দেয় সংস্থাটির বরিশাল সমন্বিত জেলা কার্যালয়কে।
১০ মার্চ সম্পদের বর্ণনা চেয়ে হাবিবুরকে চিঠি দেন সহকারী পরিচালক রণজিৎ কুমার কর্মকার। প্রায় ৫ মাস পর ৯ আগস্ট সম্পদের বর্ণনা দাখিল করেন এই সার্টিফিকেট সহকারী।
দুদক সূত্র বলছে, যে বর্ণনা তিনি দিয়েছেন, তাতেই বিপুল অবৈধ সম্পদের তথ্য এসেছে। বৈধ আয়ের সঙ্গে সম্পদের বিশাল ফারাক রয়েছে।
বরিশালের বাকেরগঞ্জে ১৯৯১ সালে সার্টিফিকেট সহকারী পদে চাকরিতে যোগ দেন হাবিবুর রহমান। সেই থেকে একই পদে থাকলেও প্রেষণে তাকে বরিশাল ডিসি অফিসের নাজিরের দায়িত্বে আনা হয় ৩ বছর আগে। ডিসি অফিসের কর্মচারীরা এটিকেও অবৈধ বলছেন।
তাদের মতে, সার্টিফিকেট সহকারীদের মধ্যে সবচেয়ে জ্যেষ্ঠ ব্যক্তিই পেতে পারেন নাজিরের দায়িত্ব। কিন্তু রহস্যজনক কারণে তার ক্ষেত্রে মানা হয়নি সে নিয়ম।
ডিসি অফিসের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘চাকরিজীবনের শুরু থেকেই নানা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ ছিল হাবিবুরের বিরুদ্ধে।
২০০৯ সালে তার বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করেছিলেন বাকেরগঞ্জের তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শাহ আবদুল তারিক। এতে কোর্ট ফি’র বিপুল অর্থ আত্মসাৎ ও এক শিক্ষকের বেতন ছাড়ের ক্ষেত্রে মোটা অঙ্ক ঘুষ রাখাসহ কয়েকটি গুরুতর অভিযোগ আনেন তিনি। বিষয়টি নিয়ে তদন্তও হয়।
কিন্তু অজ্ঞাত কারণে তার বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।’ এ সম্পর্কে জানতে চাইলে হাবিবুর রহমান বলেন, ‘সেই অভিযোগের নিষ্পত্তি হয়ে গেছে।’ কীভাবে নিষ্পত্তি হল তার সদুত্তর তিনি দিতে পারেননি।
সূত্রমতে, হাবিবুরের একচ্ছত্র আধিপত্য বরিশালের ডিসি অফিসেও। কোনো নিয়োগ থেকে শুরু করে প্রায় সব ক্ষেত্রে যেন হাবিবই শেষকথা। ডিসি অফিসের নানা কেনাকাটা ও সাধারণ মেরামতের ভুয়া ভাউচার দেখিয়ে লাখ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
দাখিল করা সম্পদের বর্ণনায় বরিশাল নগরীর বগুড়া ও আলেকান্দা মৌজায় ৬ এবং সোয়া ৪ শতাংশের দুটি প্লটের কথা উল্লেখ করেছেন হাবিবুর। এ সোয়া ১০ শতাংশ জমির দাম বলা হয়েছে ১৫-৫০ হাজার টাকা।
অথচ ভূমি অফিসের তথ্য বলছে, ওই এলাকায় প্রতি শতাংশ জমির সরকার নির্ধারিত মূল্যই ৫ লাখ ৬১ হাজার ৩০৭ টাকা।
সে হিসাবে এসব জমির মূল্য কমপক্ষে ৫৭ লাখ ৫৩ হাজার টাকা। এর বাইরে বরিশাল সদর উপজেলার চরআইচা এলাকায় ৩৩ শতাংশ জমি থাকার কথা উল্লেখ করেছেন তিনি।
দাম বলা হয়েছে মাত্র ৩৩ হাজার টাকা। ভূমি অফিসের তথ্য অনুযায়ী, এখানে জমির দামের সরকার নির্ধারিত রেট প্রতি শতাংশ ৫০ হাজার টাকা।
সেই হিসাবে মূল্য দাঁড়ায় ১৬ লাখ টাকারও বেশি। আলেকান্দা ও চরআইচা এলাকায় বসবাসকারী লোকজন জানান, সরকার নির্ধারিত ওই মূল্যের চেয়ে ৪-৫ গুণ বেশি দামে এখানে জমি বিক্রি হচ্ছে ১০-১২ বছর আগে থেকে।
এসব জমি কেনার উৎস সম্পর্কে জানতে চাইলে হাবিবুর রহমান বলেন, ‘২০-২২ বছর আগে চরআইচার (৩৩ শতাংশ) জমি কিনেছি আমি। তখন রেট কম ছিল। আলেকান্দার জমি কিনেছি ২০০৩ সালে। নগরীর আর্শেদ আলী কন্ট্রাক্টর গলিতে আমার কিছু জমি ছিল।
১৯৯৯ সালে ওই জমি বিক্রি এবং তার সঙ্গে আরও কিছু টাকা জমিয়ে এই ৬ শতাংশ জমি কিনেছি। বাকি জমি সঞ্চয়ের টাকা দিয়ে কেনা।’
মাত্র ১৫ হাজার টাকায় সংসার চালিয়ে ছেলেকে ঢাকায় রেখে পড়ানো আর মেয়ের লেখাপড়ার খরচের পরও কী করে এত টাকা সঞ্চয় করলেন-এ প্রশ্নের উত্তর দেননি তিনি।
হাবিবুরের দেয়া বর্ণনায় আরও এসেছে, আলেকান্দা কাজীপাড়ায় ৬ শতাংশ জমির ওপর একটি ৫ তলা আলিশান ভবনও নির্মাণ করেছেন তিনি। একজন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারকে সঙ্গে নিয়ে ভবনটির চারপাশ ঘুরে দেখার পর ওই প্রকৌশলী জানান, এটি নির্মাণে দেড় থেকে দুই কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে।
ভবনটি থেকে ভাড়া বাবদ মাসে ৬০-৭০ হাজার টাকা আয় হয়, তা আয়কর রিটার্নে দেখাননি হাবিবুর। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘২০০৭ সালে নির্মাণকাজ শুরু করে ২০১২ সালে শেষ হয় এ ভবনের কাজ। এ বছরই ভবন নির্মাণের ব্যয় নিরূপণ করে এটি আয়কর ফাইলে সংযুক্ত করা হবে।’
এটি নির্মাণে ৪০ লাখ টাকার বেশি খরচ হয়নি দাবি করে হাবিবুর বলেন, ‘ভবন নির্মাণে হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স থেকে ২৫ লাখ টাকা ঋণ নেয়া হয়েছে।
সোনালী ব্যাংক ও আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে নেয়া ধারসহ আমার মোট ঋণ ৩৯ লাখ ৯২ হাজার টাকা। তাছাড়া আমার স্ত্রীও সরকারি চাকরি (অফিস সহকারী) করে। এখানে তার আয়েরও অংশ রয়েছে।’
দুদকের একটি সূত্র জানায়, ‘এ পর্যন্ত যে তথ্য রয়েছে তাতে নাজির হাবিবুর ও তার স্ত্রীর সমন্বিত বৈধ আয়ের তুলনায় সম্পদের পরিমাণ কয়েকগুণ বেশি। তা কয়েক কোটি টাকা।
২০১২ সালে যদি বাড়ির নির্মাণকাজ শেষ হয় তাহলে টানা ৮ বছর এটি এবং বাড়ি ভাড়া বাবদ আয় হওয়া টাকার তথ্য গোপন রাখাও একটি অপরাধ।
তার উল্লেখ করা সম্পদের বাইরেও জমি-ফ্ল্যাটের তথ্য আসছে আমাদের কাছে। আমরা সেগুলো যাচাই-বাছাই করছি। পাশাপাশি জেলার সব ভূমি কর্মকর্তা এবং তফসিলি ব্যাংকগুলোকে চিঠি দিয়েছি। সব তথ্য-প্রমাণ পাওয়ার পর পরবর্তী ব্যবস্থা নেয়া হবে।
বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে চাইলে তদন্তের দায়িত্বে থাকা রণজিৎ কুমার কর্মকার বলেন, এখন তদন্ত চলছে, শেষ হওয়ার আগে কথা বলা ঠিক হবে না।
জানতে চাইলে বরিশাল জেলা প্রশাসক এসএম অজিয়র রহমান বলেন, ‘হাবিবুরের বিষয়ে দুদকের একটি চিঠি আমরা পেয়েছি। তারা যেসব তথ্য জানতে চেয়েছে, তা লিখিতভাবে তাদের জানানো হয়েছে। তদন্তে অভিযোগ প্রমাণিত হলে আইনানুগভাবেই ব্যবস্থা নেয়া হবে।’