রোগীর চাপ সামলাতে পারছে না আইসিইউ
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ১৯ নভেম্বর,শনিবার,২০২২ | আপডেট: ০১:৪৪ পিএম, ২২ ডিসেম্বর,রবিবার,২০২৪
রাজধানীর পুরান ঢাকার রয়েল কেয়ার অ্যান্ড সার্জিক্যাল হাসপাতালে ৪ নভেম্বর নাসিমা আক্তার কন্যাসন্তানের জন্ম দেন। শারীরিক জটিলতা থাকায় নবজাতককে নিওনেটাল ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে (এনআইসিইউ) নেওয়ার পরামর্শ দেন চিকিৎসক। তবে ওই হাসপাতালে এনআইসিইউ খরচ দৈনিক ২০ হাজার টাকা করে নেওয়ায় স্বজনরা নবজাতককে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে স্থানান্তরের চেষ্টা করেন। সেখানে এনআইসিইউ শয্যা ফাঁকা না পেয়ে আরও ছয়টি সরকারি হাসপাতালে খোঁজ নেওয়া হয়। তবু মেলে না এনআইসিইউ।
অর্থ সংকটে পড়ে নাসিমা আক্তার ৪ দিনের কন্যাসন্তানকে আর রাখতে পারেননি ওই বেসরকারি হাসপাতালের এনআইসিইউতে। তিন-চার দিন অপেক্ষার পরও সরকারি হাসপাতালে এনআইসিইউ না পেয়ে নবজাতককে বাঁচানো যায়নি। শুধু এই নবজাতকের ক্ষেত্রে নয়, বড়দের আইসিইউ সেবাতেও একই দুর্গতি। অথচ দেশের সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে করোনা রোগীর জন্য তৈরি সাড়ে ৭০০ আইসিইউ শয্যা ফাঁকা রয়েছে। সম্প্রতি ডেঙ্গুর প্রকোপ ও শীত ঘিরে শ্বাসকষ্ট, নিউমোনিয়াসহ নানা রোগ বেড়ে যাওয়ায় হঠাৎ কয়েকদিন ধরে রাজধানীতে সরকারি হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ সংকট তীব্র রূপ নিয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাজধানীর ঢামেক হাসপাতাল, মুগদা জেনারেল হাসপাতাল, সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, হৃদরোগ ইনস্টিটিউটসহ সরকারি একটিতেও আইসিইউ শয্যা ফাঁকা নেই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন অনুসারে, হাসপাতালে মোট শয্যার ১০ শতাংশ আইসিইউ থাকার কথা থাকলেও দেশের সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে সেই নির্দেশনা মানা হচ্ছে না। ঢামেক হাসপাতালে মোট ৩ হাজার শয্যার অনুপাতে ৩০০ আইসিইউ শয্যা থাকার কথা থাকলেও আছে মাত্র ১০০টি।
এ ব্যাপারে ঢামেক হাসপাতালের পরিচালক নাজমুল হক সমকালকে বলেন, বিভাগীয় শহরে বা জেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ শয্যার সচল রাখা ও সঠিকভাবে পরিচালনা করা সম্ভব না হলে ঢাকা মেডিকেলে ১ হাজার শয্যার আইসিইউ স্থাপন করেও সংকট নিরসন সম্ভব নয়।
সংশ্নিষ্টরা বলছেন, বর্তমানে সাধারণ রোগীর সেবায় দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ শয্যা রয়েছে মাত্র ৩৫০টি। এর মধ্যে সবগুলো আবার সচল নয়। এর বিপরীতে বেসরকারি হাসপাতালগুলোয় রোগীর সংখ্যা কম হলেও আইসিইউ শয্যা রয়েছে এক হাজারের বেশি। সরকারি হাসপাতালের আইসিইউতে বিনামূল্যে সেবা দেওয়া হয়। তবে বেসরকারি হাসপাতালে প্রতিদিন আইসিইউতে রোগীপ্রতি ৩০ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা খরচ হয়।
এ কারণে দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির কাছে সরকারি হাসপাতালের আইসিইউর চাহিদা বেশি। দরিদ্র মানুষ আইসিইউর জন্য হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ছুটছে। রাজধানীর বাইরেও কয়েকটি হাসপাতালে আইসিইউ সংকটের তথ্য মিলেছে। সম্প্রতি সরকারির পাশাপাশি বেসরকারি হাসপাতালেও আইসিইউর চাহিদা বেড়েছে। তবে বেশি খরচের কারণে বেসরকারি আইসিইউর সেবা নেওয়া দরিদ্র মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। এ পরিস্থিতিতে সুসংগঠিত আইসিইউ শয্যা বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মত, বেসরকারি হাসপাতালে আইসিইউতে ভর্তি হলে যে টাকা খরচ হয় তাতে দরিদ্র ও মধ্যবিত্তের পক্ষে সেই সেবা নেওয়া সম্ভব নয়। সরকারি হাসপাতালে বিনামূল্যের আইসিইউ তাদের ভরসা। সেই সেবা নেওয়ায় আরেকটি বাধা ক্ষমতাবানদের তদবির।
স্বাস্থ্যের সাবেক পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোতে প্রতি বছর প্রায় ৪ কোটি রোগী চিকিৎসা নেয়। এর মধ্যে সংকটপূর্ণ রোগী ৫০ হাজারের বেশি। তাদের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক রোগীকে আইসিইউতে রেখে চিকিৎসার প্রয়োজন হয়। সরকারি হাসপাতালে আইসিইউ সংকটে ওই সেবায় মূল ভূমিকা রাখছে বেসরকারি হাসপাতালগুলো। যদিও বেসরকারি হাসপাতালের আইসিইউ সেবার উচ্চ ব্যয় বহনে রোগীর স্বজনের হিমশিম খেতে হচ্ছে। অনেক সময় বেসরকারি হাসপাতালের বিরুদ্ধে আইসিইউতে লাশ আটকে বিল আদায়ের অভিযোগও ওঠে। অনেক হাসপাতাল আইসিইউ সেবা দেওয়ার নামে প্রতারণা করছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বিশ্ববিদ্যালয়ের আইসিইউ বিশেষজ্ঞ মনোজ কান্তি মজুমদার বলেন, সংকটপূর্ণ ৫০ হাজার রোগীর চিকিৎসায় মাত্র ৭২ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রয়েছেন। আইসিইউ পরিচালনায় দক্ষ নার্স ও ওয়ার্ডবয়ের অভাবে চালু রাখা সম্ভব হচ্ছে না। রাতারাতি এই অবস্থার পরিবর্তন হবে না। মাত্র তিন হাসপাতালে ইনটেনসিভ কেয়ারের বিষয়ে কোর্স চালু রয়েছে; এটি আরও প্রসার করতে হবে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ লেলিন চৌধুরী বলেন, অনেকগুলো সেবার সমন্বয়ে আইসিইউ শয্যা তৈরি হয়। এগুলো যথাযথ সেবা নিশ্চিত করছে কিনা তা দেখার দায়িত্ব স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের। তবে অধিদপ্তর সেভাবে তদারকি করছে না।
সার্বিক বিষয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, করোনার মধ্যে চাহিদা অনুযায়ী আইসিইউ শয্যা বাড়ানো হয়েছিল। আবার অনেক হাসপাতালে সেন্ট্রাল অক্সিজেন লাইন স্থাপন করা হয়েছে। আইসিইউ সংকট নিরসনে দেশের ৬২ জেলা হাসপাতালে ১০ শয্যার আইসিইউ ইউনিট করা হচ্ছে। তবে অবকাঠামো সমস্যায় এক-তৃতীয়াংশ হাসপাতালে এই সেবা চালু করা সম্ভব হয়নি। নানা কারণে দেশের ১৯ জেলা হাসপাতালে আইসিইউ ইউনিট স্থাপন সম্ভব নয়।