avertisements 2

জীবন কাঁপানো দুর্ভোগের শেষ কোথায়

ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ৩ অক্টোবর,সোমবার,২০২২ | আপডেট: ০৩:১২ পিএম, ১৮ ডিসেম্বর, বুধবার,২০২৪

Text

প্রায় পাঁচ বছর ধরে বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পের কারণে বিমানবন্দর থেকে জয়দেবপুর সড়কে অন্তহীন বিড়ম্বনার শিকার রাজধানীবাসী। ঢিমেতালে চলা কাজের ফলে রাজধানীর ব্যস্ততম এই সড়কে যাতায়াতকারী লাখো মানুষ নিত্যদিন অসহ্য যন্ত্রণা বয়ে চলেছে। উন্নয়নের অজুহাতে বছরের পর বছর ধরে রাস্তা কেটে রাখা হয়েছে। এর ওপর দিয়ে যানবাহন চলাচল করায় তৈরি হয়েছে বড় বড় গর্ত। উঁচু-নিচু রাস্তা খানাখন্দে ভর্তি। বছরের পর বছর ধরে এ সড়কে গাড়ি চলছে ধীরগতিতে। সামান্য কারণেই যানজট তৈরি হচ্ছে।

এর ওপর বৃষ্টি হলে তো কথা নেই। সামান্য বৃষ্টিতেই যাত্রীদের অশেষ দুর্ভোগে পড়তে হয়। পানিতে গর্তগুলো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে। ফলে যানবাহন চলাচল প্রায় বন্ধই হয়ে যায়। এক লেনে খুবই আস্তে চলে গাড়ি। এতে তৈরি হয় দীর্ঘ যানজট। রোববার এ ধরনের কারণে দুর্ভোগের শিকার হয়েছেন লাখো যাত্রী। এদিন সকালে ভারি বৃষ্টিপাতে গাজীপুর থেকে ঢাকার গুলিস্তান পর্যন্ত দীর্ঘতম যানজটের সৃষ্টি হয়। যা গোটা শহরে ছড়িয়ে পড়ে। সকালে গুলিস্তান থেকে যাত্রীরা কুড়িল বিশ্বরোডে পৌঁছেছেন পাঁচ ঘণ্টায়। অন্যান্য দিন এ দূরত্ব অতিক্রমে ঘণ্টাখানেক সময় লাগে। যাত্রীদের অনেকেই গাড়িতে বসে থাকার চেয়ে নেমে হেঁটেই গন্তব্যে রওয়ানা দিয়েছেন। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির সঙ্গে ভ্যাপসা গরমে ভারী ব্যাগ, স্যুটকেস কাঁধে নিয়ে অনেককে হাঁটতে দেখা গেছে। বিদেশগামী অনেকেই ফ্লাইট মিস করেছেন। তবে দুপুরের পর থেকে ধীরে ধীরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করে।

এদিন দুর্ভোগের শিকার অধিকাংশ যাত্রীর প্রশ্ন কবে নাগাদ শেষ হবে-বিআরটি প্রকল্পের কাজ? বিভিন্ন মাধ্যমেও ঘুরছে এ ধরনের প্রশ্ন। মেলেনি শুধু উত্তর। কেউ এর সন্তোষজনক জবাব দিতে পারছেন না। ঢাকা বিআরটি কোম্পানি থেকে বিভিন্ন সময়ে কাজ শেষের প্রতিশ্রুতি দিলেও তার কোনো বাস্তবায়ন হচ্ছে না। কাজেই এখন তারা যা বলছে তাতে কেউ আস্থা রাখতে পারছেন না। বিআরটি কর্তৃপক্ষ আরও এক বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধির প্রস্তাব দিয়েছে। এ অবস্থায়ও আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে সড়কের মূল কাজ শেষ করার কথা জোর দিয়ে বলছে বিআরটি। 

এ প্রসঙ্গে বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পের পরিচালক প্রকৌশলী এএসএম ইলিয়াস শাহ যুগান্তরকে বলেন, বিআরটি প্রকল্পের উন্নয়ন কাজের কারণে সড়কের ড্রেনেজ সিস্টেম অকেজো হয়ে পড়েছে, এটা সত্য। এই ধরনের উন্নয়ন কাজের ক্ষেত্রে এটা হতেই পারে। চলমান সড়কে উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ করতে গেলে জনগণের দুর্ভোগ হবে। তবে আর বেশিদিন এই সমস্যা থাকছে না। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে সড়ক ও ড্রেনেজের সব ধরনের কাজ শেষ হবে। তখন থেকে সড়কে চলাচল করতে মানুষের আর তেমন কোনো সমস্যায় পড়তে হবে না। প্রকল্পের অন্য কিছু কাজ বাকি থাকবে। সেজন্য সড়কে কোনো সমস্যা হবে না। 

রোববার ভোরে ঢাকায় বৃষ্টি হওয়ায় বিআরটি প্রকল্প এলাকায় দুর্ভোগ মাত্রা ছাড়ায়। অল্প পরিমাণ বৃষ্টি হলেও বিমানবন্দর, উত্তরা, আব্দুল্লাহপুর এবং গাজীপুর অংশের সড়ক পানিতে তলিয়ে যায়। ফলে ভোর থেকে ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কের বিমানবন্দর থেকে জয়দেবপুর পর্যন্ত সড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে কার্যত যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে পড়ে। এমন পরিস্থিতিতে টঙ্গী থেকে বনানী পর্যন্ত সড়কে ভয়াবহ যানজটের সৃষ্টি হয়। অল্প সময়ের ব্যবধানে যার প্রভাব পড়ে পুরো রাজধানীতে। নিজ নিজ গন্তব্য পাড়ি দিতে তিন থেকে চারগুণ সময় লেগেছে কর্মব্যস্ত নগরবাসীর। তবে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টি কমে সড়কের পানি সরিয়ে ফেলে পুলিশ; এতে করে দুপুরের পরপর যানজট কমে যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক হয়।  

সড়কের জলজট নিরসন করে যানবাহন চলাচল নিশ্চিত করতে ট্রাফিক পুলিশ এগিয়ে আসে। বিমানবন্দর থেকে পাম্পিং মোটর নিয়ে পানি সেচে ধীরে ধীরে যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক করা হয়। বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পের উন্নয়ন কাজের কারণে ওই সড়কের ড্রেনেজ সিস্টেম অকেজো হয়ে পড়ায় বৃষ্টির পানি বের হচ্ছে না। ফলে সড়কে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে। 

সরেজমিন দেখা গেছে, রোববার সকাল ৮টা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত বিমানবন্দর সড়কের যান চলাচল প্রায় থমকে ছিল। ঢাকার ভেতরে প্রবেশ ও বের হওয়ার দুই পথেই ছিল তীব্র যানজট। পাশাপাশি সড়কের বাসস্টপেজগুলোতে কর্মব্যস্ত মানুষের উপচে পড়া ভিড় ছিল। এই কারণে সড়কের ফুটপাত দিয়ে হাঁটাও দায় হয়ে পড়ে। যানজটের কারণে বাস না উঠে শত শত মানুষকে হেঁটে গন্তব্যে রওয়ানা হতে দেখা গেছে। বাসে চড়ে যারা গন্তব্যে যাচ্ছিলেন তাদের অনেকেই বাস থেকে নেমে হেঁটে গন্তব্যে গেছেন। আব্দুল্লাহপুর থেকে ঢাকামুখী সড়কের উত্তরা, এয়ারপোর্ট, খিলক্ষেত, বিশ্বরোড, বনানী, কুড়িল প্রগতি সরণিজুড়ে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। অন্যদিকে গাজীপুরগামী সড়কের বনানী, বিশ্বরোড, কাওলা, বিমানবন্দর, উত্তরা এবং আব্দুল্লাহপুর ছাড়িয়ে যেতে দেখা গেছে যানজটের সারি। 

উত্তরা-আজমপুর বাসস্ট্যান্ডে কথা হয় কর্মব্যস্ত নারী রোকসানা বেগমের সঙ্গে। তিনি জানান, সকাল আটটায় বোর্ডবাজার থেকে ঢাকার কাকরাইলের উদ্দেশে বাসে উঠেছেন। প্রায় চার ঘণ্টা বাসে বসে থেকে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। তাই বাধ্য হয়েই এক পর্যায়ে হাঁটা শুরু করেছেন। 

বেসরকারি সংস্থার কর্মকর্তা আজিজুর রহমান। পল্টনের বাসা থেকে সকাল ৯টায় রওয়ানা হন কুড়িল চৌরাস্তায় তার অফিসের উদ্দেশে। ৪০ মিনিটে গুলশান পৌঁছাতে পারেন। এরপর বিমানবন্দর এলাকার যানজটের প্রভাবে গুলশান-বারিধারা এলাকা থেকে তার অফিসে পৌঁছাতে সময় লাগে প্রায় তিন ঘণ্টা। যেটা স্বাভাবিক সময়ে সর্বোচ্চ ২৫ থেকে ৩০ মিনিট লাগে।

 গুলশানের বাসিন্দা প্রকৌশলী নুরুল ইসলাম বলেন, আব্দুল্লাহপুর থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত সড়কের কারণে মানুষের সীমাহীন দুর্ভোগ হচ্ছে। বিআরটি প্রকল্প বাস্তবায়ন কাজ দীর্ঘসূত্রতার কারণে স্বপ্নের উত্তরার বাসা ছেড়ে অনেকে গুলশান-বনানীতে চলে আসতে চান। আমার পরিচিত কয়েকজন গুলশান-বনানী-বারিধারায় ফ্ল্যাট খোঁজাও শুরু করেছে। উন্নয়ন প্রকল্পের এমন নেতিবাচক দৃষ্টান্ত তৈরি করা উচিত নয়। 

রোববার ভোর থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমও টঙ্গী, আব্দুল্লাহপুর, বিমানবন্দর এলাকার যানজটে বিপর্যস্ত হওয়ার খবরে ভরে ওঠে। বনশ্রীর বাসিন্দা মনিকা হোসেন তার ফেসবুক পেজে যানজটের কয়েকটি ছবি পোস্ট করে লেখেন, ‘আজমপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে বাসে ওঠেন সাড়ে আটটায়। বাসে উঠে যানজটে আটকা পড়েন। পরের তিন ঘণ্টায় গাড়ি জসিম উদ্দিন মোড়ে পৌঁছায়। এরপর গাড়ি থমকে ছিল। নিরুপায় হয়ে বাস ছেড়ে হাঁটা শুরু করেছি। এভাবে কি জীবন চলে?

আব্দুল্লাহপুর ট্রাফিক পুলিশ বক্সের পরিদর্শক মো. সাজ্জাত হোসেন বলেন, টঙ্গীর মিলগেট এলাকায় বিআরটি প্রকল্পের গর্ত-খানাখন্দে বৃষ্টির পানি জমে থাকায় কোনো গাড়ি স্বাভাবিক গতিতে গাজীপুর অংশে ঢুকতে পারছে না। আবার বিমানবন্দর এলাকার সড়কে বৃষ্টির পানি জমেছে। এ কারণে গাজীপুর থেকেও কোনো গাড়ি ঠিকমতো ঢাকায় ঢুকতে পারছে না। তাই সকাল থেকে মানুষ খুব কষ্ট করছে। আমরাও চেষ্টা করছি যান চলাচল স্বাভাবিক করতে। 

ঢাকা মহানগর ট্রাফিক উত্তরার উপপুলিশ কমিশনার নাবিদ কামাল বলেন, বৃষ্টির পানিতে সড়ক তলিয়ে গেছে। এজন্য খানাখন্দে ভরা এই সড়কে যানবাহন চলাচল করতে পারছে না। যানজটের সারি বিমানবন্দর থেকে নিকুঞ্জ এলাকা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। পাশাপাশি অফিসগামী মানুষ সড়কে অবস্থান নেওয়ায় বিশৃঙ্খলা আরও বেড়েছে। 

তিনি বলেন, সড়কের অবস্থা স্বাভাবিক করতে যান চলাচলের উপযোগী করতে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের সহযোগিতায় পাম্পিং মোটর বসানো হয়েছে। আমাদের ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা রাস্তায় গর্তের সামনে অবস্থান নিয়ে যান চলাচল স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। জমে থাকা পানি সেচ দিয়ে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। এজন্য বাড়তি চাপ নিতে হচ্ছে ট্রাফিক পুলিশ।

সড়কের হাঁটুসমান পানিতে দাঁড়িয়ে ট্রাফিকের দায়িত্ব পালনরত কয়েকজন পুলিশ সদস্য জানান, বিমানবন্দর থেকে জয়দেবপুর পর্যন্ত বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। ২০ কিলোমিটার এলাকার বেশিরভাগ সড়কের অবস্থা নাজুক। বিশেষ করে বিমানবন্দর, টঙ্গী, গাজীপুর চৌরাস্তা এবং শিববাড়ী-গাজীপুর এলাকায় সীমাহীন দুর্ভোগ মাড়াচ্ছে মানুষ। আর মানুষের চলাচল স্বাভাবিক করতে নাকাল হতে হচ্ছে আমাদের। পানি নিষ্কাশনের দায়িত্ব সিটি করপোরেশন বা প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের হলেও সে কাজটি পুলিশকে করতে হয়েছে। অন্যদের এ কাজে এগিয়ে আসতে দেখা যায়নি। 

একই বিষয়ে ঢাকা বিআরটি কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, চলমান যে কোনো সড়কে প্রকল্পের উন্নয়ন কাজের কারণে কিছুটা দুর্ভোগ হয়ে থাকে। বিআরটি প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের জটিলতার কারণে এই জটিলতা অনেকাংশে বেড়েছে। তবে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে সেই সমস্যার সমাধান হচ্ছে। তিনি বলেন, আগামী জানুয়ারি থেকে জয়দেবপুর থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত বিআরটি প্রকল্পের সড়কের সব কাজ শেষ হয়ে যাবে। তখন মানুষ নির্বিঘ্নে চলাচল করতে পারবে। তবে প্রকল্পের আরও কিছু কাজ বাকি থাকায় বিআরটি প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। এবার সময় বাড়লেও ব্যয় বাড়ানোর কোনো প্রস্তাব করা হয়নি। 

জানতে চাইলে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম বলেন, বিআরটি ও ঢাকা এলিভেটেড প্রকল্পের কারণে ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কের পানি নিষ্কাশন ড্রেনেজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ কারণে রোববারের বৃষ্টিতে ওই সড়কে জলজটের সৃষ্টি। আর এ জলজটের কারণে সড়কে গাড়ি চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। যার প্রভাবে পুরো রাজধানীতে ভয়াবহ যানজট হয়েছে। এ বিষয়ের সমাধান এবং সংশ্লিষ্টদের জবাবদিহি করতে মঙ্গলবার নগরভবনে সভা আহ্বান করা হয়েছে। সেখানে সমস্যার কারণ ও প্রতিকারের বিষয়ে আলোচনা করে সমাধানের পথ বের করা হবে।  

প্রসঙ্গত, বিআরটি প্রকল্পের কাজ ২০১২ সালে শুরু হওয়া এ প্রকল্প অনুমোদন করে সরকার। আর ২০১৭ সালে পুরোদমে প্রকল্পের কাজ শুরুর পর এখন পর্যন্ত ৮২ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে বলে দাবি করছে ঢাকা বিআরটি কোম্পানি। বাকি ১৮ ভাগ কাজ আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ করে প্রকল্প সড়কগুলো পুরোপুরি চালুর ঘোষণা দিয়েছে। ৪ হাজার ২৬৮ কোটি টাকা ব্যয়ে বাস্তবায়নাধীন এই প্রকল্পের সিংহভাগ কাজ আগামী ডিসেম্বরে শেষ হবে। তবে পুরোপুরি প্রকল্প শেষ করতে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় দাবি করেছে ঢাকা বিআরটি কোম্পানি কর্তৃপক্ষ। 

বিষয়:

আরও পড়ুন

avertisements 2