৫ বছরে ঝরেছে ২ শতাধিক প্রাণ, এত মৃত্যু কেন?
পৃথিবীর সবচেয়ে ব্যয়বহুল ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে যেন মৃত্যুফাঁদ
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ৩০ ডিসেম্বর,সোমবার,২০২৪ | আপডেট: ০৫:৩৯ পিএম, ২ জানুয়ারী,বৃহস্পতিবার,২০২৫
পৃথিবীর সবচেয়ে ব্যয়বহুল (কিলোমিটার প্রতি ব্যয় ২০০ কোটি ৮০ লাখ টাকা) খ্যাত দেশের একমাত্র এক্সপ্রেসওয়ে ঢাকা-মাওয়া মহাসড়ক উদ্বোধনের পর থেকেই ঘটছে একের পর এক দুর্ঘটনা। এটি রাজধানীতে যাতায়াত আরও সহজ করার কথা থাকলেও আদতে এটি এখন পরিণত হয়েছে মরণফাঁদে।
২০২০ সালের মার্চে উদ্বোধনের পর ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত এক্সপ্রেসওয়েতে ৭৯টি দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ৬৫ জন, গুরুতর আহত হয়েছেন ৬৭ জন। ২০২২ সালে ১৯৬টি দুর্ঘটনায় ৭৪ জন নিহত ও ২৬৫ জন গুরুতর আহত হয়েছেন। আর এ বছর ২৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৬৪টির বেশি দুর্ঘটনায় ৮৫ জন আহত হয়েছেন। মারা গেছেন ২২ জন। এর মধ্যে ডিসেম্বরেই মারা গেছেন ১০ জন।
হাইওয়ে পুলিশের তথ্যানুসারে, গত সপ্তাহে এই এক্সপ্রেসওয়েতে অন্তত তিনটি দুর্ঘটনা ঘটেছে। অনেকে আবার বলছেন, কিছু ঘটনা রিপোর্ট করা হয়নি, ফলে প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি হবে।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, উদ্বোধনের পর থেকে চলতি ডিসেম্বর পর্যন্ত পৌনে ৫ বছরে এক্সপ্রেসওয়েতে দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন দুই শতাধিক মানুষ। আহতের সংখ্যা হাজারের ওপরে।
স্থানীয়রা জানান, সকাল-দুপুর-রাত, কুয়াশা, ঝড়-বৃষ্টি সব সময় চালকরা বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালায়। কয়েক সপ্তাহ ধরে প্রতিরাতেই এক্সপ্রেসওয়েতে কুয়াশা পড়ছে। এ কারণে কিছু গাড়ি ধীরে চলে, কিছু গাড়ির গতি সীমার বাইরে বেপরোয়া গতিতে চলছে। এতে এক্সপ্রেসওয়েতে দুর্ঘটনায় প্রাণহানি বাড়ছে। এক্সপ্রেসওয়েতে পুলিশের নজরদারি জোরালো না থাকায় চালকরা কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কাই করেন না। তারা যেন নিজের সঙ্গেই নিজে প্রতিযোগিতায় মেতে ওঠেন। এসব বিষয়ে প্রশাসনের ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।
শুক্রবার সকালে এক্সপ্রেসওয়ের ধলেশ্বরী টোল প্লাজায় বাসচাপায় দুই পরিবারের ৬ জন নিহত হন। আহত হয়েছেন ৫ জন। হতাহতরা প্রাইভেটকার ও মোটরসাইকেলের যাত্রী ছিলেন। এ জন্য অবশ্য বেপরোয়া গতি দায়ী ছিল না। তবে, ২২ ডিসেম্বর ভোরে এক্সপ্রেসওয়ের মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগরের ষোলঘর থেকে হাসাড়া পর্যন্ত কুয়াশার মধ্যে বেপরোয়া গতিতে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ৪ থেকে ৫ কিলোমিটারের মধ্যে ৪টি স্থানে যাত্রীবাহী বাস, ট্রাক, প্রাইভেটকার, পিকআপ ভ্যান ও কাভার্ডভ্যানসহ ১০টি গাড়ির সংঘর্ষ হয়। এসব গাড়ি কোথাও সড়ক বিভাজকের সঙ্গে ধাক্কা খেয়েছে। কোথাও আবার একটি গাড়ি আরেকটির পেছনে ধাক্কা দিয়েছে। এসব দুর্ঘটনায় ফরহাদ হোসেন (৪০) নামে এক গাড়িচালক মারা গেছেন। এক্সপ্রেসওয়েতে যে দুর্ঘটনাগুলো ঘটেছে, এর পেছনে পুলিশ ও সংশ্লিষ্টদের দায়িত্বে অবহেলা রয়েছে। এছাড়া বিপুল খরচের মাধ্যমে নির্মাণ করা এক্সপ্রেসওয়ের সাইন-সংকেত ব্যবস্থাও আধুনিক নয়, গতানুগতিক। নেই সিসিটিভি। এসব দুর্ঘটনার ধরন হচ্ছে, ঘন কুয়াশার কারণে একটি যানবাহন দুর্ঘটনায় পড়লে পেছন থেকে একের পর এক যান এসে ধাক্কা দেয়। একে ‘পাইলআপ’ বলে। এ জন্য দৃষ্টিসীমা একেবারে কমে গেলে যানবাহন চলাচল বন্ধ রাখা বাঞ্ছনীয়। মহাসড়কের আব্দুল্লাহপুরের বাসিন্দা শিপলু জানান, কুচিয়ামোড়া, ধলেশ্বরী টোলপ্লাজা, হাসাড়া, ষোলঘর, পদ্মা থানার কাছাকাছি এক্সপ্রেসওয়েতে বেশি দুর্ঘটনা ঘটে। অথচ পুলিশ এসব এলাকায় নামমাত্র টহল দেয়। কুয়াশাসহ বিভিন্ন দুর্যোগে পুলিশসহ সড়কের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের জোরালো আইন প্রয়োগ করা দরকার। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পুলিশের নিরাপত্তা চৌকি বসানো দরকার। সড়ক আইন মানে না এমন চালকদের ও পরিবহণ মালিকদের বিচারের আওতায় আনা দরকার, তাহলে দুর্ঘটনা কমে আসবে।
শ্রীনগর ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তা দেওয়ান আজাদ হোসেন বলেন, এসব দুর্ঘটনা ঘন কুয়াশায় ফগ লাইট না জ্বালানো, ট্রাফিক আইন না মেনে বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো, চালকদের গাফিলতি, ঘুম ঘুম ভাব নিয়ে গাড়ি চালানো, আগে যাওয়ার প্রতিযোগিতা, যত্রতত্র গাড়ি থামানো, ত্রুটিযুক্ত গাড়ি রাস্তায় বের করার কারণে ঘটেছে। এসব ঘটনা রাতের আঁধারে, ঘন কুয়াশা এবং বৃষ্টির মধ্যে বেশি ঘটে। ট্রাফিক আইন মেনে গাড়ি চালানো, চালকদের বাস্তবসম্মত প্রশিক্ষণ দেওয়া ও যাত্রীরা সচেতন হলেই এই দুর্ঘটনা কমিয়ে আনা সম্ভব।
পুলিশের টহলদারি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে হাসাড়া হাইয়ে থানার ওসি আব্দুল কাদের জিলানী জানান, প্রতিদিন রাতে দুটি গাড়ি দিয়ে ধলেশ্বরীর টোলপ্লাজা থেকে শুরু করে মাওয়ার প্রায় ২৯.২ কিলোমিটার এলাকায় টহল দিচ্ছেন। সে সময় চালকদের বারবার ট্রাফিক আইন মেনে এবং ধীরগতিতে গাড়ি চালাতে বলা হয়। পুলিশের সামনে ধীরগতিতে গাড়ি চালালেও পুলিশ চলে গেলে আবার চালকরা বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালাচ্ছেন। এর ফলে এসব দুর্ঘটনা ঘটছে বলে মনে করেন তিনি।
আব্দুল কাদের জিলানী আরও বলেন, রোববার ও সোমবার যে দুটি দুর্ঘটনা ঘটেছে দুটোই ভোর বেলা ঘটেছে। আর এ সময় অতিরিক্ত কুয়াশায় আচ্ছন্ন থাকে এক্সপ্রেসওয়ে। দুর্ঘটনাগুলো ঘটেছে অতিরিক্ত ঘন কুয়াশা ও চালকদের বেপরোয়া গতির কারণে। সড়ক আইন মেনে যদি চালকরা গাড়ি চালাতেন তাহলে হয়তো এমন দুর্ঘটনা ঘটত না।
বেপরোয়া চালক ও পরিবহণের বিরুদ্ধে প্রতিদিন আইনি কার্যক্রম চলছে বলে জানিয়েছেন মুন্সীগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপার মুহাম্মদ শামসুল আলম সরকার। তিনি বলেন, দুর্ঘটনা কমিয়ে আনতে হলে চালকসহ সবাইকে সচেতন হতে হবে। অন্যদিকে দুর্ঘটনা রোধে প্রতিনিয়ত আইনের মাধ্যমে জরিমানাসহ বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।