avertisements 2

ওমিক্রন ঠেকানোর ছক কতটা মজবুত

ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ৩ জানুয়ারী,সোমবার,২০২২ | আপডেট: ০৭:৪৭ পিএম, ২৭ এপ্রিল,শনিবার,২০২৪

Text

বিশ্বজুড়ে এরই মধ্যে ভীতি ছড়িয়েছে করোনাভাইরাসের নতুন ধরন ওমিক্রন। বিশেষ করে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে অনেকটা টালমাটাল পরিস্থিতি। প্রেক্ষাপট এমনই ভয়াবহ, যুক্তরাষ্ট্রে এক দিনে পৌনে ছয় লাখ, ফ্রান্সে দুই লাখের বেশি, যুক্তরাজ্যে এক লাখ ৮০ হাজারের মতো মানুষের শরীরে শনাক্ত হয়েছে এই প্রাণঘাতী ভাইরাস।

ওমিক্রন সংক্রমণ ঠেকাতে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করেছে কয়েকটি দেশ। বিশ্বে চার হাজার ৪০০ ফ্লাইট বাতিল হয়েছে। এর মধ্যে একা যুক্তরাষ্ট্রেই রয়েছে দুই হাজার ৫০০ ফ্লাইট। প্রতিবেশী দেশ ভারতেও ওমিক্রন ভয়ংকর ফণা তুলেছে। হুহু করে বাড়ছে সংক্রমণ। বাংলাদেশ লাগোয়া ভারতের পশ্চিমবঙ্গে এক দিনে আক্রান্ত বেড়েছে চার হাজারের ওপরে। এরপর গতকাল রোববার থেকে জনসাধারণের চলাচলে বেশকিছু বিধিনিষেধ আরোপ করেছে সেই দেশটির রাজ্য সরকার।

দেশেও ওমিক্রন নিয়ে ভয় বাড়ছে। এ পর্যন্ত ১০ জনের শরীরে ওমিক্রন শনাক্ত হয়েছে। সম্প্রতি মাধ্যমিক পরীক্ষার ফল প্রকাশ ও স্কুল শিক্ষার্থীদের পাঠ্যবই বিতরণ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, সংক্রমণ বাড়লে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রাখা সম্ভব হবে না। সর্বশেষ গত শনিবার মানিকগঞ্জে এক অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, সংক্রমণ পরিস্থিতি ঊর্ধ্বমুখী হলে আবারও লকডাউন দেওয়া হতে পারে।

তবে ওমিক্রন সংক্রমণ ঠেকাতে স্বাস্থ্য বিভাগ কতটা প্রস্তুত তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ওমিক্রন সংক্রমণ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের প্রস্তুতিতে ঘাটতি আছে বলে মনে করেন জনস্বাস্থ্যবিদদের অনেকে। তাদের অভিমত, আফ্রিকার কয়েকটি দেশের যাত্রীদের বাংলাদেশে প্রবেশের ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ জারি করা ছাড়া স্বাস্থ্য বিভাগের তেমন কোনো প্রস্তুতি চোখে পড়ছে না। এর বাইরে ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশে ওমিক্রন ছড়িয়ে পড়লেও সেসব দেশ থেকে আগতদের ক্ষেত্রে কোনো বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়নি। একই সঙ্গে হাসপাতালে চিকিৎসাসহ সার্বিক প্রস্তুতি সম্পর্কেও সবাই রয়েছে অন্ধকারে। দ্রুত এ ঘাটতি দূর করে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ দিয়েছেন তারা।

সংক্রমণ ৬০ শতাংশ বাড়ল :দেশে আবারও করোনা সংক্রমণ বাড়ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান বলছে, গত এক সপ্তাহে সংক্রমণ বেড়েছে ৬০ শতাংশ। গতকাল রোববার এক ব্রিফিংয়ে সংক্রমণ বাড়ার তথ্য তুলে ধরে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র ও অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক রোবেদ আমিন বলেন, গত ২০ ডিসেম্বর থেকে দেশে সংক্রমণের হার বাড়তে শুরু করে। ২৭ ডিসেম্বর থেকে সংক্রমণ ২ শতাংশ পেরিয়ে যায়। গত এক সপ্তাহে সংক্রমণ বেড়েছে ৬০ শতাংশ। একই সঙ্গে মৃত্যুও বেড়েছে।

তবে ওমিক্রন না ডেলটা ধরন এ সংক্রমণ বাড়াচ্ছে সে বিষয়ে কিছু জানা যায়নি।
জানতে চাইলে জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এএসএম আলমগীর সমকালকে বলেন, 'বিদেশফেরতদের মধ্যে যাদের নমুনা করোনা পজিটিভ পাওয়া গেছে, তাদের জিনোম সিকোয়েন্সিং করা হয়েছে। এর মধ্যে ১০ জনের শরীরে ওমিক্রন শনাক্ত হয়েছে।'

ওমিক্রন সংক্রমণ এখনও খুব বেশি ছড়ায়নি বলে মনে করেন ডা. আলমগীর। এর পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে তিনি বলেন, 'গত এক সপ্তাহে ৬০ শতাংশ রোগী বেড়েছে। একই সঙ্গে হাসপাতালে ভর্তির হারও বেড়েছে। এসব ব্যক্তি ওমিক্রনে সংক্রমিত হলে হাসপাতালে ভর্তির সংখ্যা বাড়ত না। কারণ, ওমিক্রন সংক্রমিত দেশগুলোতে হাসপাতালে রোগী ভর্তির হার কম। ফলে দেশে ওমিক্রন এখনও ততটা ছড়ায়নি। এটি ডেলটার সংক্রমণ বলে ধারণা আইইডিসিআরের এই কর্মকর্তার।

স্বাস্থ্য বিভাগ কতটা প্রস্তুত :বিশ্বজুড়ে আতঙ্ক ছড়ানো ওমিক্রন মোকাবিলায় স্বাস্থ্য বিভাগের প্রস্তুতি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বিমান, নৌ ও স্থলবন্দরে স্ট্ক্রিনিং ব্যবস্থা এবং আফ্রিকার সাত দেশ থেকে আসা ব্যক্তিদের কোয়ারেন্টাইন করার বাইরে স্বাস্থ্য বিভাগের প্রস্তুতি তেমন নেই। হাসপাতালগুলোর প্রস্তুতি সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিষয়ে মানুষকে সচেতন করে তুলতে গত ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে জেলা প্রশাসক ও সিভিল সার্জনদের চিঠি দেয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এই আদেশ জারির মধ্যেই কার্যক্রমটি সীমাবদ্ধ রয়েছে। কারণ রাস্তঘাট, গণপরিবহন, শপিংমল কোথাও স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে না। অধিকাংশ মানুষ মাস্ক ছাড়াই চলছে। বিনোদন ও পর্যটনকেন্দ্রে উপচে পড়া ভিড়। চলছে রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও।

সংক্রমণ ঠেকাতে স্বাস্থ্য বিভাগের প্রস্তুতি সম্পর্কে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম সমকালকে বলেন, 'দেশের বিমান, নৌ ও স্থলবন্দরে স্ট্ক্রিনিং জোরদার করা হয়েছে। সন্দেহভাজন ব্যক্তির নমুনা পরীক্ষা করা হয়। হাসপাতালগুলো প্রস্তুত রাখতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। রোগী বাড়লে যাতে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা যায়, সেটি স্বাস্থ্য বিভাগের দায়িত্ব। ওমিক্রন মোকাবিলায় সম্প্রতি আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক হয়েছে। সেখানে সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা ও মাস্ক ব্যবহারে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

আফ্রিকার বাইরে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের পাশাপাশি ইউরোপের অনেক দেশে ওমিক্রন সংক্রমণ পরিস্থিতি ভয়াবহ। কিন্তু বাংলাদেশে প্রবেশের ক্ষেত্রে আফ্রিকার সাতটি দেশের ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ আরোপ করা হলেও অন্য দেশের বেলায় তা করা হয়নি। এর কারণে সম্পর্কে ডা. নাজমুল ইসলাম বলেন, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এ-সংক্রান্ত বিষয়ে কোনো নির্দেশনা দেয়নি। নির্দেশনা পেলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর তা বাস্তবায়ন করবে।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক সমকালকে বলেন, দেশে ওমিক্রন এখনও সেভাবে ছড়ায়নি। এটি প্রতিরোধে মনোযোগ দিচ্ছি। যেসব হাসপাতালে রোগী বেশি আছে, সেগুলোতে জিনোম সিকুয়েন্সিং করা হচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে ১০ জনের শরীরে ওমিক্রন শনাক্ত হয়েছে। শনাক্ত হওয়া ব্যক্তিদের আইসোলেশনে এবং কন্টাক্ট ট্রেসিং করে সংক্রমিত ব্যক্তির সংস্পর্শে যাওয়া ব্যক্তিদের কোয়ারেন্টাইন করা হয়েছে। একই সঙ্গে হাসপাতালগুলো সর্বোচ্চ প্রস্তুত রাখতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। স্বাস্থ্য বিভাগের প্রস্তুতিতে কোনো ঘাটতি নেই।

করোনার সংক্রমণ মোকাবিলা একটি সমন্বিত কার্যক্রম উল্লেখ করে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, অধিকাংশ মানুষ মাস্ক পরছে না, স্বাস্থ্যবিধিও মানছে না। একই সঙ্গে পর্যটনকেন্দ্র, রাজনৈতিক কর্মসূচি, বিয়েসহ নানা সামাজিক অনুষ্ঠানের হিড়িক পড়েছে। এসব ঠেকানোর দায়িত্ব তো স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নয়। এ ধরনের কার্যক্রমে সংক্রমণ বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। সরকারের সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগ মিলে একযোগে কাজ করতে হবে।

জোরালো প্রস্তুতির আহ্বান বিশেষজ্ঞদের :বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম সমকালকে বলেন, ওমিক্রন সংক্রমণপ্রবণ হলেও হাসপাতালে ভর্তির হার অনেক কম। একই সঙ্গে মৃত্যুও কম। কিন্তু অতীতে দেখা গেছে, ভাইরাস রূপ বদল করে ভয়াবহ হয়। সেটি বিবেচনায় নিয়ে প্রস্তুতি গ্রহণের প্রয়োজন আছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ সমকালকে বলেন, গত নভেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে আফ্রিকার একটি দেশে প্রথম ওমিক্রন শনাক্ত হয়। এরপর এক মাসের কিছু বেশি সময়ে বিশ্বের দেড়শর মতো দেশে ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ে। কয়েকটি দেশে ভয়াবহ রূপ নেয়। এটি মনে করার কোনো কারণ নেই যে, বাংলাদেশে এটি ছড়িয়ে পড়বে না। চীনের উহানে করোনার সংক্রমণ শনাক্ত হওয়ার পর অনেকের ধারণা ছিল, বাংলাদেশে আসবে না। কিন্তু মারাত্মক সংক্রমণ ছড়িয়েছিল।

ডা. বে-নজির আহমেদ আরও বলেন, দেশের প্রবেশদ্বারে সর্বোচ্চ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। করোনা নেগেটিভ সনদ ছাড়া প্রবেশ ঠেকানো এবং বিদেশফেরতদের ১৪ দিনের প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে সামাজিক জমায়েত বন্ধ ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। দ্রুততার সঙ্গে জনসাধারণকে টিকার আওতায় আনতে হবে। অন্যথায় রূপ বদল করা ধরনের সংক্রমণ এড়ানো কঠিন হবে।

 

বিষয়:

আরও পড়ুন

avertisements 2