avertisements 2

‘অরাজকতা’ ঠেকাতে সতর্ক সরকার

নিরাপত্তার জালে ঢাকার চারপাশ

ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ১২ নভেম্বর, বুধবার,২০২৫ | আপডেট: ০৫:০৪ পিএম, ১২ নভেম্বর, বুধবার,২০২৫

Text

কার্যক্রম নিষিদ্ধ থাকা আওয়ামী লীগ ঘোষিত বৃহস্পতিবারের ‘ঢাকা লকডাউন’ কর্মসূচির নামে যে কোনো ধরনের নাশকতা ঠেকাতে সতর্ক অবস্থায় রয়েছে সরকার। অরাজকতা সৃষ্টির চেষ্টা হলে ন্যূনতম ছাড় না দেওয়ার মনোভাব নিয়ে সাজানো হচ্ছে নিরাপত্তা বলয়। যার অংশ হিসেবে রাজধানী ঢাকার ভেতর ও প্রবেশপথগুলোতে আজ বুধবার থেকেই কড়া নজরদারি শুরু হচ্ছে। আর আগামীকাল বৃহস্পতিবার প্রবেশপথগুলোতে যে কোনো ধরনের জমায়েত ঠেকাতে কাউকে দাঁড়াতেই দেওয়া হবে না। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে এসব তথ্য মিলেছে।

আওয়ামী লীগ ঘোষিত ‘লকডাউন’ কর্মসূচি সামনে রেখে কয়েকদিন ধরে ঝটিকা মিছিল, হাতবোমা বা ককটেলের বিস্ফোরণ এবং যানবাহনে আগুন দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটছে। তবে পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, বৃহস্পতিবারের ‘কথিত’ ওই কর্মসূচি ঘিরে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই, ভয়েরও কারণ নেই। যে কোনো ধরনের অরাজকতা ঠেকাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী শক্ত অবস্থানে রয়েছে এবং পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকবে। ‘সন্ত্রাসী’দের কোনো ধরনের ছাড় দেওয়া হবে না। এই কর্মসূচি ঘিরে অরাজকতা ঠেকাতে সন্দেহভাজন ব্যক্তি দেখলেই আইনের আওতায় নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। পাশাপাশি এ ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষেরও সহায়তা চেয়েছে সরকার।

এ ছাড়া সারা দেশে সহিংসতা ও অগ্নিসংযোগের মতো নাশকতার ঘটনাকে বিবেচনায় নিয়ে দেশের সব বিমানবন্দরকে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্র জানায়, ‘ঢাকা লকডাউন’ কর্মসূচি ঘোষণার পর থেকেই সারা দেশে পুলিশকে সতর্ক থাকার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। পুলিশ সদর দপ্তর ও ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা দফায় দফায় বৈঠক করেছেন। গতকাল মঙ্গলবার সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটির সভায়ও ১৩ নভেম্বরের নিরাপত্তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। ওই সভায় স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীসহ আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটির সদস্যরা ছাড়াও আইজিপি বাহারুল আলম, ডিএমপি কমিশনার শেখ সাজ্জাত আলী, র্যাবের ডিজি এ কে এম শহিদুর রহমানসহ বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।

পুলিশ সূত্র জানায়, কার্যক্রম নিষিদ্ধ থাকা আওয়ামী লীগের কর্মসূচি ঘোষণার পর গত ৩ দিনে ঢাকায় অন্তত ১৮টি ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ভবন ছাড়াও অন্তত দুটি জায়গায় পুলিশকে লক্ষ্য করে এ হামলা হয়। গত শনিবার থেকে গত সোমবার সন্ধ্যা পর্যন্ত রাজধানীতে ১০টি যানবাহনে আগুন দেওয়া হয়। এসব ঘটনায় গতকাল পর্যন্ত অন্তত ৫০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ ছাড়াও গতকাল ভোরে ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়ায় দাঁড়িয়ে থাকা একটি বাসে দুর্বৃত্তদের দেওয়া আগুনে ভেতরে ঘুমন্ত অবস্থায় পুড়ে মারা গেছেন বাসটির চালক।

ডিএমপির এক কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেছেন, ককটেল নিক্ষেপ ও গাড়িতে অগ্নিসংযোগে জড়িত সন্দেহে এখন পর্যন্ত যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাদের বড় একটা অংশ ঢাকার বাইরে থেকে এসেছিল। অনেকে নাশকতা ঘটিয়ে দ্রুতই ঢাকার বাইরে চলে যাচ্ছে। বেশকিছু পথশিশুকেও ককটেল বিস্ফোরণে ব্যবহার করা হয়েছে। তবে মোটরসাইকেলে চড়ে যাতে ককটেল ছুড়ে বা গাড়িতে আগুন দিয়ে পালাতে না পারে, সেজন্য টহলের পাশাপাশি চেকপোস্টও বাড়ানো হয়েছে। নানা বেশে দায়িত্ব পালন করছেন আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা।

ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে গুজব ছড়ানো হচ্ছে। পুরনো নানা ভিডিও পোস্ট করে ১৩ নভেম্বর ঘিরে আতঙ্ক ছড়ানো হচ্ছে। তবে এসব বন্ধে পুলিশের সাইবার ইউনিটগুলো কাজ করছে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্র আরও জানায়, গোয়েন্দা তথ্য ও সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় ১৩ নভেম্বর ঘিরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সতর্ক অবস্থায় রয়েছে। অরাজকতাকারীদের ন্যূনতম ছাড় না দেওয়ার বার্তা দেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে বেশকিছু নিরাপত্তা পরিকল্পনা সাজানো হয়েছে, যার অংশ হিসেবে অপরিচিত কাউকে বাসাবাড়িতে আশ্রয় না দেওয়ার জন্য নগরবাসীর প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। বিষয়টি দেখভালের জন্য প্রতিটি থানাকে অবহিত করে এলাকায় নজরদারি ও স্থায়ী বাসিন্দাদের কাছ থেকে খোঁজখবর নিতে বলা হয়েছে। পাশাপাশি রাজধানীতে মেস, গেস্ট হাউস ও আবাসিক হোটেলগুলোতে যাতে জাতীয় পরিচয়পত্র ছাড়া কোনো অতিথি না রাখা হয়, সে বিষয়ে প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকদের বার্তা দেওয়া হয়েছে। রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ কিছু এলাকা চিহ্নিত করে বেশ কয়েকটি আবাসিক হোটেল নজরদারির আওতায় নেওয়া হয়েছে। প্রয়োজনে এসব হোটেলে এবং কিছু এলাকায় তাৎক্ষণিক অভিযানও চালানো হতে পারে। সড়কের পাশে বা পাম্পগুলোতে খোলা জ্বালানি বিক্রি বন্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। অরিক্ষতভাবে যাতে বাস বা যে কোনো ধরনের গাড়ি না রাখা হয়, সেজন্য এরই মধ্যে পরিবহন মালিক ও শ্রমিকদের সঙ্গে পুলিশের কর্মকর্তারা বৈঠক করেছেন। পার্কিং স্পেসগুলোতে মালিক-শ্রমিকদের নিজ নিজ দায়িত্বে পাহারা দিতে বলা হয়েছে।

সূত্রগুলো বলছে, নানা ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, যেসব বাসে অল্প যাত্রী থাকে, সেসব বাস টার্গেট করছে দুর্বৃত্তরা। এজন্য বিশেষ করে রাতে কম যাত্রী নিয়ে বাস চলাচলে চালক-মালিকদের নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। ঢাকায় মেট্রো রেল, কমলাপুর রেলস্টেশন, ট্রাইব্যুনাল-আদালতপাড়াসহ অতি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় (কি পয়েন্ট ইনস্টলেশন-কেপিআই) নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে।

ডিএমপির দায়িত্বশীল আরেক কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, ১৩ নভেম্বর বৃহস্পতিবার রাজধানীর প্রবেশপথ গাবতলী, উত্তরার অদূরে টঙ্গী, আবদুল্লাহপুর, যাত্রাবাড়ী-শ্যামপুর, পোস্তগোলা, সদরঘাট, বছিলা-মোহাম্মদপুর ও কেরানীগঞ্জে বাবুবাজার ব্রিজ এলাকায় অতিরিক্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এসব এলাকায় সন্দেহভাজন কাউকে দেখলেই আইনের আওতায় নেওয়ার সিদ্ধান্ত রয়েছে। তা ছাড়া সেসব এলাকায় অহেতুক কাউকে ভিড় করতেও দেওয়া হবে না। তবে সপ্তাহের শেষ দিন হওয়ায় নগরবাসীর যাতে ভোগান্তি বা হয়রানি না হয়, সে বিষয়টিও মাথায় রয়েছে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, গতকাল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটির সভার বেশির ভাগ সময়জুড়ে ১৩ নভেম্বর নিয়ে আলোচনা হয়। এতে উঠে আসে, নাশকতাকারীরা অনেকেই সীমান্ত এলাকায় অবস্থান করে থাকে। সীমান্ত দিয়ে বিস্ফোরক এবং অস্ত্র আসার তথ্যের বিষয়েও আলোচনা হয়। এজন্য দেশের সীমান্ত এলাকাগুলোতে কঠোর নজরদারির সিদ্ধান্ত হয়।

ওই সভা শেষে প্রেস ব্রিফিংয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী নাশকতা সৃষ্টি করতে পারে এমন সন্দেহভাজন কাউকে দেখলেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জানানোর আহ্বান জানান।

তিনি বলেন, দেশে যে কোনো ধরনের অরাজকতা ঠেকাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কঠোর ভূমিকা পালন করছে, শক্ত অবস্থানে আছে এবং পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকবে। কোনোরকম অপ্রীতিকর ঘটনার আশঙ্কা নেই। সন্ত্রাসীদের কোনো ধরনের ছাড় দেওয়া হবে না।

স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, রাস্তার পাশে যে বিভিন্ন দোকানে তেল (জ্বালানি) বিক্রি হয়, এটা কিছুদিনের জন্য বন্ধ করা হবে। অনেক সময় এ তেল ব্যবহার করে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটানো হচ্ছে। তা ছাড়া মেট্রোরেল, রেলস্টেশন, ট্রাইব্যুনালসহ কেপিআই এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে।

সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কয়েক জায়গায় বাসে আগুন ও কয়েকটি কটকেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। এগুলো যাতে আর না ঘটে, সেজন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তিনি এ সময় সব রাজনৈতিক দলকে অগ্নিসংযোগসহ সব ধরনের নাশকতা প্রতিরোধে একযোগে কাজ করার আহ্বান জানান।

উপদেষ্টা বলেন, সীমান্তরক্ষী বাহিনীকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে এবং সেখানে নিরাপত্তা আরও কঠোর করা হচ্ছে, যাতে কোনো ধরনের সন্ত্রাসী দেশে না ঢুকতে পারে এবং দেশের ভেতর কোনো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড না চালাতে পারে।

এদিকে গতকাল বিকেলে সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে গণমাধ্যমের সামনে আসেন ডিএমপি কমিশনার শেখ সাজ্জাত আলী। রাজধানীর মিন্টো রোডে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ১৩ নভেম্বর ঘিরে আতঙ্কের কিছু নেই, ভয়েরও কোনো কারণ নেই।

আওয়ামী লীগের নাম উল্লেখ না করে ডিএমপি কমিশনার বলেন, কার্যক্রম নিষিদ্ধ একটি দল ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা আত্মগোপনে থেকে রাজনৈতিক কার্যক্রম চালানোর অপচেষ্টা করছে। টাকার বিনিময়ে ঢাকার বাইরে থেকে রাজধানীতে ঝটিকা মিছিল করে আতঙ্ক সৃষ্টির চেষ্টা করছে। গত অক্টোবর থেকে গতকাল পর্যন্ত ঢাকায় ১৪টি ঝটিকা মিছিলে অর্থায়ন ও অংশ নেওয়া অন্তত ৫৫২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

ঢাকায় অপরাধ খুবই নিয়ন্ত্রণে এবং তা সন্তোষজনক মন্তব্য করে ডিএমপি কমিশনার বলেন, ‘১৩ তারিখ ঘিরে এক সপ্তাহ ধরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শঙ্কার কথা বলা হয়েছে। তবে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। শঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। ভয়েরও কোনো কারণ নেই। ঢাকাবাসীই নাশকতাকারীদের প্রতিহত করবে এবং তাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সহায়তা করবে।’

দেশের সব বিমানবন্দরে সর্বোচ্চ সতর্কতার নির্দেশ: সহিংসতা ও অগ্নিসংযোগের মতো নাশকতার বিষয় বিবেচনায় নিয়ে দেশের সব বিমানবন্দরকে সতর্ক থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। গত সোমবার বেবিচক বিমানবন্দরগুলোকে এ-সংক্রান্ত চিঠি পাঠায়।

বেবিচকের সদস্য (নিরাপত্তা) এয়ার কমডোর মো. আসিফ ইকবাল স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে বলা হয়, ‘দেশের সামগ্রিক নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করে বিমানবন্দরগুলোতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা অবিলম্বে সর্বোচ্চ মাত্রায় জোরদার করতে হবে।’ সব আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দরে নিরাপত্তার জন্য ওই চিঠিতে ১২ দফা নিরাপত্তা নির্দেশনাও দেওয়া হয়। এ ছাড়া তিন কার্যদিবসের মধ্যে নিরাপত্তা ব্যবস্থার প্রতিবেদন দিতেও বলা হয়।

সৌজন্যে: কালবেলা
 

বিষয়:

আরও পড়ুন

avertisements 2