রাতের ভোটে'র ৩০ জেলা প্রশাসক এখনো গুরুত্বপূর্ণ পদে বহাল
                                    
                                    
                                        
                                            ডেস্ক রিপোর্ট
                                        
                                    
                                   
                                     প্রকাশ:  ১২:০০ এএম,  ৫ জানুয়ারী,রবিবার,২০২৫ | আপডেট:  ০২:২৫ পিএম,  ৪ নভেম্বর,মঙ্গলবার,২০২৫
                                
                        
                    পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত ‘রাতের ভোট’ হিসেবে খ্যাত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দায়িত্ব পালনকারী ৩০ জেলা প্রশাসক এখনো প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে বহাল তবিয়তে রয়েছেন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের প্রায় পাঁচ মাস অতিবাহিত হলেও এখন পর্যন্ত রাতের ভোটের সেই কারিগরদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারেনি। সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় ও দফতরে এখনো দায়িত্ব পালন করছেন ওই সব কর্মকর্তা।
বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের জেলা ও মাঠ প্রশাসন অনুবিভাগে যুগ্মসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন বিসিএস ২০ ব্যাচের কর্মকর্তা আনারকলি মাহবুব। এই কর্মকর্তাকে রাতের ভোটের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে নির্বাচনের মাত্র চার মাস আগে ৯ আগস্ট ২০১৮ সালে শেরপুরের জেলা প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। এর পর ২০২১ সালের ২১ জুন তাকে জেলা প্রশাসক থেকে তুলে এনে মন্ত্রিপরিষদের মতো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ে পদায়ন করা হয়। এখনো বহাল তবিয়তে আছেন এই কর্মকর্তা।
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের সদস্য (পরিকল্পনা) হিসেবে কাজ করছেন একই ব্যাচের কর্মকর্তা মোহাম্মদ আব্দুল আহাদ। একইভাবে রাতের ভোটের চার মাস আগে এই কর্মকর্তাকে সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। ২০২১ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত এই কর্মকর্তা সেখানে জেলা প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এর পর তাকে রাজউকের মতো লোভনীয় জায়গায় পদায়ন করা হয়।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব হিসেবে কাজ করছেন বিসিএস ২১ ব্যাচের কর্মকর্তা ড. সাবিনা ইয়াসমিন। রাতের ভোটের মাত্র দু’ মাস আগে ৯ অক্টোবর তাকে পঞ্চগড়ের জেলা প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেয় হাসিনা সরকার। ২০২১ সালের ২২ জুন পর্যন্ত সেখানে দায়িত্ব পালনের পর তাকে যুগ্মসচিব পদে পদোন্নতি দিয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়ে পদায়ন করা হয়।
পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন মো: হামিদুল হক। বিসিএস ১৮ ব্যাচের এই কর্মকর্তা রাতের ভোটে ঝালকাঠির জেলা প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। অন্তর্বর্তী সরকারের সময়েও তিনি মন্ত্রিপরিষদের মাঠ প্রশাসনের মতো গুরুত্বপূর্ণ শাখার অতিরিক্ত সচিব হিসেবে কাজ করছেন।
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন রাতের ভোটের দায়িত্ব পালন করা তিন সাবেক জেলা প্রশাসক। পরিচালক (প্রশাসন) হিসেবে আছেন ভোটের দু’ মাস আগে পটুয়াখালীর ডিসি হিসেবে পদায়ন হওয়া মতিউল ইসলাম চৌধুরী। ২০২১ সালের ২৪ জুন পর্যন্ত সেখানে ডিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এর পর তাকে যুগ্মসচিব পদোন্নতি দিয়ে বিমানের মতো লোভনীয় জায়গায় পদায়ন করা হয়। একইভাবে ভোটের দুই মাস আগে দিনাজপুরের জেলা প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ পান মাহমুদুল আলম। ২০২১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দায়িত্ব পালন শেষে তাকে যুগ্মসচিব পদোন্নতি দিয়ে বিমানে পদায়ন করা হয়। একই দিনে ভোটের মাত্র দুই মাস আগে ব্রাহ্মণবাড়ীয়ার জেলা প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন হায়ত-উদ-দৌলা খান। ২০২২ সালের ১২ জানুয়ারি পর্যন্ত দায়িত্ব পালন শেষে যুগ্মসচিব পদোন্নতি দিয়ে বিমানে পদায়ন করা হয়।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব হিসেবে কর্মরত আছেন অঞ্জন চন্দ্র পাল। ২০১৮ সালের রাতের ভোটের সময় এই কর্মকর্তা লক্ষ্মীপুরের জেলা প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। শিল্প মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব মো: মাজেদুর রহমান খান ২০১৮ সালের ৫ মার্চ থেকে ২০২১ সালের ৩ জানুয়ারি পর্যন্ত চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এর পর পদোন্নতি দিয়ে তাকে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পদায়ন করা হয়।
মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ মোখলেসুর রহমান সরকার ২০১৬ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে গোপালগঞ্জ জেলার জেলা প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এর পর ২০১৯ সালের ২৩ মার্চ পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করে তাকে যুগ্মসচিব ও পরে অতিরিক্ত সচিব হিসেবে পদোন্নতি দেয় আওয়ামী লীগ সরকার।
শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন সৈয়দা ফারহানা কাওনাইন। ২০১৮ সালের ১১ মার্চ তিনি নরসিংদীর জেলা প্রশাসক হিসেবে যোগদান করেন। ২০২১ সালের ২১ জুন পর্যন্ত তিনি সেখানে থাকার পর যুগ্মসচিব পদে পদোন্নতি দিয়ে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ে পদায়ন করা হয়।
নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব (প্রশাসন ও বাজেট) শাখার যুগ্মসচিব কাজী আবু তাহের। ২০১৮ সালের ৫ মার্চ এই কর্মকর্তাকে শরীয়তপুর জেলা প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। ২০২১ সালের ৮ অক্টোবর পর্যন্ত তিনি সেখানে দায়িত্ব পালন করেন। এর পর তাকে যুগ্মসচিব হিসেবে পদোন্নতি দিয়ে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে পদায়ন করা হয়।
পরিকল্পনা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন আবু সালেহ মো: ফেরদৌস খান। ২০১৮ সালের ৪ মার্চ থেকে ২০২০ সালের ৮ জুলাই পর্যন্ত এই কর্মকর্তা ঢাকার ডিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব (আইআইটি) হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন মোহাম্মদ দাউদুল ইসলাম। রাতের ভোটের চার মাস আগে এই কর্মকর্তাকে বান্দরবানের জেলা প্রশাসক হিসেবে পদায়ন করে পতিত সরকার। ২০২১ সালের ৪ জানুয়ারি পর্যন্ত সেখানে দায়িত্ব পালন শেষে তাকে যুগ্মসচিব পদে পদোন্নতি দেয় সরকার।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন বিসিএস ২০ ব্যাচের কর্মকর্তা এ কে এম মামুনুর রশিদ। রাতের ভোটের ৯ মাস আগে এই কর্মকর্তাকে রাঙ্গামাটির জেলা প্রশাসক হিসেবে পদায়ন করে শেখ হাসিনার সরকার। এর পর সেখানে ২০২১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের অতিরিক্ত সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন মোহাম্মদ শফিউল আরিফ। ২০১৮ রাতের ভোটের সময় এই কর্মকর্তা লালমনিরহাটের জেলা প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এর পর যুগ্মসচিব পদে পদোন্নতি দিয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ এপিডি অনুবিভাগে পদায়ন করা হয় এই কর্মকর্তাকে।
বিদ্যুৎ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব ফয়েজ আহমদ রাতের ভোটের সময় বগুড়ার জেলা প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এর পর শেখ হাসিনার সরকার দু’ দফায় তাকে যুগ্মসচিব ও অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি দেয়।
প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব হিসেবে কর্মরত আছেন রাতের ভোটের চাঁপাইনবাবগঞ্জের জেলা প্রশাসক এ জেড এম নুরুল হক। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব হিসেবে কর্মরত আছেন রাতের ভোটের সাতক্ষীরার জেলা প্রশাসক এস এম মোস্তফা কামাল। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব হিসেবে কর্মরত আছেন রাতের ভোটের বাগেরহাট জেলা প্রশাসক তপন কুমার বিশ্বাস। সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ে কর্মরত আছেন রাতের ভোটের চুয়াডাঙ্গার জেলা প্রশাসক গোপাল চন্দ্র দাস। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের পরিচালক হিসেবে কর্মরত আছেন রাতের ভোটের বরগুনা জেলা প্রশাসক কবির মাহমুদ এবং গাইবান্ধার জেলা প্রশাসক আব্দুল মতিন। সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে কর্মরত আছেন রাতের ভোটের খুলনা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হেলাল হোসেন। পানি উন্নয়ন বোর্ডের অতিরিক্ত মহাপরিচালক হিসেবে কর্মরত আছেন রাতের ভোটের বরিশাল জেলা প্রশাসক এস এম অজিয়র রহমান। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের সচিব হিসেবে কর্মরত আছেন রাতের ভোটের ভোলার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মাসুদ আলম সিদ্দিকী। সৌদি আরবের বাংলাদেশ দূতাবাসের মিনিস্টার (স্থানীয়) হিসেবে কর্মরত আছেন রাতের ভোটের সিলেটের জেলা প্রশাসক কাজী এমদাদুল ইসলাম। কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের মতো গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন ড. এনামুল হাবীব, যিনি রাতের ভোটের সময় রংপুরের জেলা প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের যুগ্মসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন রাতের ভোটে রাজশাহীর জেলা প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করা যুগ্মসচিব এস এম আবদুল কাদের।
উল্লেখ্য, ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ এককভাবেই ২৫৮টি আসনে জয়ী বলে নির্বাচন কমিশন ঘোষণা করে। এ নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি দেখানো হয় ৮০.২০ শতাংশ। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ পায় মোট ভোটের ৭৪.৪৪ শতাংশ। নির্বাচনের কয়েক দিন পর নির্বাচন কমিশন তাদের ওয়েবসাইটে কেন্দ্রভিত্তিক ফলাফল প্রকাশ করে। এতে দেখা যায়, ২১৩টি কেন্দ্রে শতভাগ এবং এক হাজার ৪১৮টি কেন্দ্রে ৯৬ শতাংশের ওপর ভোট পড়েছে। এ নির্বাচন নিয়ে টিআইবির (ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ) এক গবেষণায় বলা হয়, ৫০টি আসনের মধ্যে ৪৭টিতে কোনো না কোনো অনিয়ম হয়েছে।
এ নির্বাচনের ফলাফল, বিভিন্ন কেন্দ্রে ভোট প্রদানের হার এবং প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের মধ্যে ভোটের ব্যবধান নিয়ে নানা রকম প্রশ্ন তৈরি হয়। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটের পরিস্থিতি ও ফলাফল যে স্বাভাবিক ছিল না, সাবেক নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার নির্বাচননামা বইয়ে তা বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। তার মতে, জনগণের কাছে এ নির্বাচন ‘রাতের নির্বাচন’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। স্বৈরাচারী সরকারের দল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা জড়িত থাকলেও রাতের ভোটের নেপথ্যের নায়ক ছিলেন তৎকালীন জেলা প্রশাসকরা। তারাই এই নির্বাচনের রিটার্নিং অফিসারের দায়িত্ব পালন করেন। সহকারী রিটার্নিং অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক এবং উপজেলা নির্বাহী অফিসাররা।
ওই নির্বাচনে ভোটকেন্দ্র ছিল ৪০ হাজার ১৮৩। সমানসংখ্যক প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর কর্মকর্তা প্রিজাইডিং কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সহকারী প্রিজাইডিং, পোলিং কর্মকর্তা, নিরাপত্তা বাহিনীসহ সাত লাখের বেশি সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী নির্বাচনের দায়িত্বে ছিলেন। দায়িত্ব পালনের আগে এসব কর্মকর্তা-কর্মচারীর রাজনৈতিক মতাদর্শ যাচাই-বাছাই করে সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। তাদের তদন্তে বিরূপ মন্তব্য থাকায় ভোটের বাইরে রাখা হয় বহু কর্মকর্তাকে। 
 


                                    
                                    
                                    
                                    
                                    


