avertisements 2

মুসলিম বিশ্বের ইতিহাসে স্মরণকালের বড় জানাজা

ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ১ জানুয়ারী,বৃহস্পতিবার,২০২৬ | আপডেট: ০৫:৩১ এএম, ১ জানুয়ারী,বৃহস্পতিবার,২০২৬

Text

লাখ লাখ মানুষের অংশগ্রহণে বিএনপি চেয়ারপার্সন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার জানাজা শুরু হয়েছে। বুধবার দুপুর ৩টা ৩ মিনিটে জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় এ জানাজা শুরু হয়। জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের খতিব মুফতি মোহাম্মদ আবদুল মালেক খালেদা জিয়ার জানাজা পড়ান।শুধু মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ নয়, আশ পাশের কয়েক কিলোমিটার জুড়ে মানুষ অবস্থান নেয় জানাজায় অংশ নিতে। তিল ধারণের জায়গা নেই। ধারণা করা হচ্ছে, এটি কোনো মুসলিম নারীর বৃহৎ জানাজা ইতিহাসে। শুধু বাংলাদেশ নয়, মুসলিম বিশ্বের স্মরণকালের বড় জানাজা।

প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস, উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য বৃন্দ, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ দলের শীর্ষ নেতারা এবং লাখ লাখ নেতাকর্মী জানাজায় অংশ নেন। প্রত্যক্ষদর্শীরা মনে করছেন, খালেদা জিয়ার জানাজায় জনসমুদ্র শব্দটিও যেন বিশালতার কাছে হার মেনেছে। কেননা যেদিকে চোখ যায় সেদিকেই কেবল চোখে পড়েছে মানুষের মাথা। শোনা গেছে লাখো কণ্ঠের কান্নাজড়িত দোয়া। মুসলিম বিশ্বের কোনো নেতার জানাজায় এত মানুষ হয়নি বলে মনে করেন প্রত্যক্ষদর্শীরা। 

জানাজায় অংশ নেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। তিনি বলেন, রাজধানীর মানিক মিয়া এভিনিউ ছাপিয়ে জনস্রোত আছড়ে পড়েছে আশেপাশের কয়েক কিলোমিটার এলাকা জুড়ে। যেদিকে চোখ যায়, শুধু মানুষ আর মানুষ। দলমত-নির্বিশেষে শোকার্ত মানুষের এই ঢল প্রমাণ করল, রাজনীতির ‘আপসহীন নেত্রী’ বেগম খালেদা জিয়া মানুষের হৃদয়ে কতটা গভীরে স্থান করে নিয়েছিলেন। প্রবীণ রাজনৈতিক বিশ্লেষক থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ, সবাই একবাক্যে স্বীকার করছেন, ‘দেশে এমন জানাজা এর আগে আর দেখেনি কেউ।’

বেলা ৩ টায় যখন জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় বেগম জিয়ার জানাজা শুরু হয়, তখন ঢাকা মানিক মিয়া এভিনিউয়ের আশেপাশের সড়কগুলো কার্যত স্থবির। জানাজাস্থল মানিক মিয়া এভিনিউ পূর্ণ হয়ে সেই ভিড় ছড়িয়ে পড়েছিল উত্তরে জাহাঙ্গীর গেট, পশ্চিমে মিরপুর রোড এবং পূর্বে ফার্মগেট পেরিয়ে কারওয়ান বাজার, বাংলামোটর ও মগবাজার পর্যন্ত। মাইকের আওয়াজ যতদূর পৌঁছায়, মানুষ ততদূরেই রাস্তায় কাতারবন্দী হয়ে দাঁড়িয়েছেন। অনেকের চোখের কোণে জল, কেউবা হাত তুলে নীরবে দোয়া করছেন। 

এর আগে শীত উপেক্ষা করে গতকাল মঙ্গলবার রাত থেকেই মানুষ মানিক মিয়া এভিনিউ, দলীয় কার্যালয়, এভারকেয়ারসহ বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নিয়েছিলেন। আজ বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের ঢল রূপ নেয় এক বিশাল জনসমুদ্রে। জানাজায় অংশ নিতে আসা পুরান ঢাকার সত্তরোর্ধ্ব ব্যবসায়ী হাজী আবদুল লতিফ বলেন, ‘১৯৮১ সালে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের জানাজা দেখেছিলাম। ভেবেছিলাম, বাংলাদেশে আর হয়তো এমন দৃশ্য দেখব না। আজ ৪৪ বছর পর তাঁর স্ত্রীর জানাজায় এসে মনে হচ্ছে, ইতিহাস আবার ফিরে এসেছে। এমন ভালোবাসা জোর করে আদায় করা যায় ন। এটা আল্লাহ প্রদত্ত বিষয়। তিনি যাকে সম্মান দেন, কেউ তাকে অসম্মান করতে পারে না।’

শুধু দলীয় নেতাকর্মী নন, জানাজায় অংশ নিয়েছেন সাধারণ চাকরিজীবী, শিক্ষার্থী, রিকশাচালক থেকে শুরু করে দেশের সর্বস্তরের মানুষ। ভিড়ের চাপে সংসদ ভবনের আশপাশের গাছ, ফুটপাত, এমনকি নিকটস্থ ভবনগুলোর ছাদও ছিল লোকে লোকারণ্য। জানাজার ঠিক আগমুহূর্তে খালেদা জিয়াকে নিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খানের কান্নাবিজড়িত বক্তৃতার পর যখন তারেক রহমান তাঁর মায়ের জন্য দোয়া চাইলেন, পিনপতন নীরবতায় তখন পুরো এলাকা যেন দেশনেত্রীর বিরহ-বেদনায় ভার হয়ে ওঠে। 

বেগম জিয়ার এই শেষ বিদায়ে উপস্থিত ছিলেন বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধিরা। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য,চীন, ভারত, পাকিস্তান, জাপান, সৌদি আরবসহ ঢাকাস্থ ৩২টি দেশের কূটনীতিক ও প্রতিনিধিরা জানাজায় অংশ নেন। যার মধ্যে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, ভূটানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, নেপালের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, পাকিস্তানের স্পিকার উপস্থিত ছিলেন। বিদেশি কূটনীতিকদের জন্য নির্ধারিত স্থানে দাঁড়িয়ে তাঁরা এ সময় প্রত্যক্ষ করেন বাংলাদেশের মানুষের এই আবেগঘন বিদায় মুহূর্ত।

বেগম জিয়ার জানাজায় নারীদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। জানাজাস্থলের মূল অংশে নারীদের প্রবেশাধিকার সীমিত থাকলেও আশপাশের নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে হাজারো নারী অশ্রুসজল চোখে বিদায় জানিয়েছেন দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রীকে। তাঁদের অনেকের হাতে ছিল কালো ব্যাজ, মুখে ছিল শোকের ছায়া।

১৯৮১ সালের ৩০ মে কিছু বিপথগামী সেনাসদস্যের হাতে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা ও তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান শহীদ হওয়ার পর বিশেষ পরিস্থিতিতে রাজনীতিতে আসেন গৃহবধূ খালেদা জিয়া। ১৯৮২ সালে বিএনপিতে যোগ দেন। শুরু হয় তাঁর চার দশকের বেশি সময়ের রাজনৈতিক পথযাত্রা। প্রয়াত রাষ্ট্রপতির স্ত্রী হিসেবে তিনি বিএনপিতে মর্যাদার আসন পেলেও এরশাদের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনে আপসহীন রাজনৈতিক নেতা হিসেবে তিনি নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন।

সামরিক শাসক এরশাদের শাসনকে বৈধতা দেওয়া ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালের তৃতীয় ও চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তাঁর দল বিএনপি অংশ নেয়নি। রাজনীতিতে আসার মাত্র ১০ বছরের মাথায় ১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে তাঁর দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সরকার গঠন করে। বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি ইতিহাসে ঠাঁই করে নেন। বাংলাদেশের মতো একচেটিয়া পুরুষতান্ত্রিক আবহাওয়া এই অর্জন নানা দিক থেকে অনন্য। নিজের রাজনৈতিক স্বকীয়তা দিয়ে তিনি তা অর্জন করেছিলেন। বাংলাদেশকে রাষ্ট্রপতিশাসিত থেকে প্রধানমন্ত্রীশাসিত সরকারব্যবস্থায় রূপান্তরের ক্ষেত্রেও খালেদা জিয়া গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। খালেদা জিয়ার দীর্ঘ ৪৩ বছরের রাজনৈতিক জীবনে তিনি নানা সময়ে সরকার ও বিরোধী দলে থেকেছেন।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বেগম খালেদা জিয়ার এই জানাজা কেবল একটি ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা ছিল না, এটি ছিল বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের এক অন্যতম বড় ঘটনা।

দীর্ঘ রোগভোগ, কারাবাস আর নানা চড়াই-উৎরাইয়ের পর তাঁর এই বিদায় প্রমাণ করে, ক্ষমতার বাইরে থেকেও একজন নেতা কীভাবে গণমানুষের মনে বেঁচে থাকতে পারেন। বিএনপির সদ্যপ্রয়াত চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার জন্য সবার কাছে দোয়া চেয়েছেন তাঁর বড় ছেলে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। আজ বুধবার বেলা তিনটার পর খালেদা জিয়ার জানাজা শুরুর আগে সবার কাছে মায়ের জন্য দোয়া চান তিনি । রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে লাখ লাখ মানুষের অংশগ্রহনে খালেদা জিয়ার জানাজা হয়। ইতিহাসের স্মরণকালের এই জানাজায় অংশ নিতে আসা বিপুল মানুষের উদ্দেশে তারেক রহমান বলেন, ‘ দোয়া করবেন। আল্লাহ তাআলা যাতে ওনাকে (খালেদা জিয়া) বেহেশত দান করেন।’

তারেক রহমান বলেন, খালেদা জিয়া জীবিত থাকাকালে যদি কারও কাছ থেকে কোনো ঋণ নিয়ে থাকেন, দয়া করে তাঁরা যেন তাঁর (তারেক রহমান) সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তিনি তা পরিশোধের ব্যবস্থা করবেন।

তারেক রহমান আরও বলেন, খালেদা জিয়া জীবিত থাকাকালে তাঁর কোনো ব্যবহারে, কোনো কথায় যদি কেউ আঘাত পেয়ে থাকেন, তাহলে মরহুমার পক্ষ থেকে আমি ক্ষমাপ্রার্থী।

বেলা তিনটা তিন মিনিটে জানাজা শুরু হয়ে তিনটা পাঁচ মিনিটে শেষ হয়। জানাজা পড়ান বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের খতিব মুফতি আবদুল মালেক। এই জানাজায় অংশ নেন তারেক রহমান। পাশে ছিলেন অন্তবর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ডা. মুহাম্মদ ইউনূস। একই সারীতে ছিলেন বাংলাদেশ সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর প্রধান, বিএনপি মহাসচিব ও স্থায়ী কমিটির সদস্যগণ, বাংলাদেশ জামায়াতের আমীর, এনসিপির আহ্বায়কসহ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ ও রাজনীতিবিদরা অংশ নেন।

এর আগে বেলা পৌনে তিনটার দিকে জানাজা কার্যক্রম সঞ্চালনা শুরু করেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান। তিনি খালেদা জিয়ার জীবন, রাজনৈতিক সংগ্রাম, সাফল্য ও নিগ্রহের শিকার হওয়ার ঘটনা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, দল–মতনির্বিশেষে সবার শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, সম্মান নিয়ে খালেদা জিয়া বিদায় নিলেন। তিনি রেখে গেলেন অনন্য উদাহরণ।

বিষয়:

আরও পড়ুন

avertisements 2