নির্বাচনের আগে বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়ার ইঙ্গিত মার্কিন প্রতিবেদনে
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ২৭ জুলাই,বৃহস্পতিবার,২০২৩ | আপডেট: ০৮:৪৪ এএম, ২১ ডিসেম্বর,শনিবার,২০২৪
নির্বাচনের আগে বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়ার ইঙ্গিত মার্কিন প্রতিবেদনে বাংলাদেশে আগামী সাধারণ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক অস্থিরতা বেড়ে যেতে পারে। বাংলাদেশ একদলীয় রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার দিকে যেভাবে অগ্রসর হচ্ছে, তাতে সিভিল সোসাইটি গ্রুপগুলো ব্যাপকভাবে উদ্বিগ্ন। এছাড়া বিরোধী রাজনৈতিক গ্রুপগুলোকে যেভাবে কোনঠাসা করা হচ্ছে সেটি নিয়েও সিভিল সোসাইটি চিন্তিত। যুত্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের এক প্রতিবেদনে এসব পর্যবেক্ষণ দেয়া হয়েছে।
বিভিন্ন দেশের বিনিয়োগ পরিস্থিতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র সরকার যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে সেখানে এসব কথা বলা হয়। একটি দেশের ব্যবসায়িক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যালোচনার মাধ্যমে আমেরিকার কোম্পানিগুলো যাতে বিনিয়োগের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারে সেজন্য এই প্রতিবেদন প্রকাশ করে যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট।
১৬৫টির বেশি দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি ও সামগ্রিক পরিবেশ সম্পর্কে মূল্যায়ন করা হয়েছে। এই প্রতিবেদনের বাংলাদেশ অংশে দেশের উন্নয়নের প্রশংসার পাশাপাশি রাজনৈতিক ও মানবাধিকার বিষয়ক বিভিন্ন সমালোচনাও তুলে ধরা হয়।
আগামী নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ
বিভিন্ন দেশের বিনিয়োগ পরিস্থিতি তুলে ধরতে গিয়ে সেসব দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিবেশের দিকেও আলোকপাত করা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের প্রতিবেদনে।
২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ দল সংসদের ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৮৯টি আসনে জয়লাভ করে। সে নির্বাচনে ব্যাপক ভোট কারচুপি, ব্যালট বাক্স ভর্তি করা এবং ভয়ভীতি দেখানো হয়েছিল। নির্বাচনের আগে বিরোধী দলের প্রার্থি ও তাদের সমর্থকদের হয়রানি এবং সহিংসতার কারণে তারা স্বাধীনভাবে নির্বাচনী প্রচারণা ও সমাবেশ করা তাদের জন্য বেশ কঠিন হয়ে উঠেছিল।
এই রিপোর্টের সাথে সংযুক্ত ঢাকাস্থ যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের ‘ইন্টিগ্রেটেড কান্ট্রি স্ট্র্যাটেজি’ রিপোর্টে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আরো বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরা হয়। ২০২২ সালের জুলাই মাসে এটি প্রকাশ করা হয়।
এখানে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ২০১৮ সালের ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচনের পর নাগরিক অধিকারের জায়গা সংকুচিত হয়ে গেছে। এছাড়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও অন্যান্যভাবে ভয়ভীতি প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা, আইনের শাসন, শ্রমিকদের সংগঠিত হওয়ার সক্ষমতা এবং বাক-স্বাধীনতার মতো জায়গাগুলো সংকুচিত করা হয়েছে।
সরকারের কর্তৃত্ববাদী আচরণের কারণে গণতান্ত্রিক জায়গাগুলো যদি সংকুচিত হতে থাকে এবং এর কোনো উন্নতি না হয়, তাহলে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা যেমন নষ্ট হতে পারে তেমনি মানবাধিকারও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এর ফলে অর্থনৈতিক উন্নয়নও বাধাগ্রস্ত হবে বলে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
‘ইন্টিগ্রেটেড কান্ট্রি স্ট্র্যাটেজি’ প্রতিবেদনে বাংলাদেশের জন্য ২০২৩ সালের জাতীয় নির্বাচনকে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে দেখা হচ্ছে কারণ এর মধ্য দিয়ে নির্ধারণ হবে বাংলাদেশ কি আরো ‘গণতান্ত্রিক’ দিকে নাকি ‘স্বৈরতন্ত্রের’ দিকে এগিয়ে যাবে। গণতন্ত্রের জন্য প্রয়োজনীয় পরিবেশের উন্নতি না হলে আমেরিকার সাথে সম্পর্কের অবনতি হতে পারে।
‘বিনিয়োগ পরিবেশ বিবরণী’র এমন প্রতিবেদন তৈরি করা হয় যেন দেশটিতে বিদেশীরা বিনিয়োগ করতে চাইলে সেখানকার পরিবেশ পরিস্থিতি সম্পর্কে একটা পূর্ণাঙ্গ ধারণা পাওয়া যায়। এদিক দিয়ে রাজনীতি একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। এমন রিপোর্ট প্রতিবছরই প্রকাশ করা হয়।
কিন্তু ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর থেকে বাংলাদেশের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের অসন্তোষের জায়গা বেড়েছে এবং একারণে সামনের নির্বাচনকে ঘিরে আমেরিকার তৎপরতা বেড়েছে বলে মনে করছেন সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন।
বিনিয়োগ ও বাণিজ্য
যুক্তরাষ্ট্র মনে করছে, বিনিয়োগ ও বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে অনেক সম্ভাবনার দিক আছে। বাংলাদেশকে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের একটি আকর্ষণীয় বাজার হিসেবে উল্লেখ করছে আমেরিকা। যেসব ক্ষেত্রে বাণিজ্য ও বিনিয়োগের বড় সম্ভাবনা দেখছে আমেরিকা সেগুলো হচ্ছে - বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, কৃষি সামগ্রী, প্রযুক্তি, অবকাঠামো, টেক্সটাইল, প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা সামগ্রী, ই-কমার্স ও স্বাস্থ্য।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিদেশী বিনিয়োগকারীদের প্রতি বাংলাদেশ সরকারের বড় ধরনের কোনো বৈষম্য নেই। তবে সরকার সাধারণত দেশীয় শিল্পকে গুরুত্ব দেয়। উদাহরণস্বরূপ, বিদেশ থেকে আমদানি করা ওষুধ দেশীয় কোম্পানির সাথে প্রতিযোগিতা করে তাহলে আমদানি করা ওষুধের উপর নানা বিধি-নিষেধ থাকে।
এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আমেরিকার কোম্পানিগুলো বাংলাদেশের বিদ্যুৎ ও জ্বলানি খাতে বড় ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশে যত গ্যাস উত্তোলন হয় তার ৫৫ শতাংশ আমেরিকার কোস্পানিগুলো করে। এছাড়া বিদ্যুৎ প্রকল্পগুলোতে সবচেয়ে বড় বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আমেরিকার কোম্পানি রয়েছে।
এছাড়া বাংলাদেশের সমুদ্রে গ্যাস অনুসন্ধানের সুযোগ আছে। বর্তমানে বঙ্গোপসাগরে ২৬টি ব্লক রয়েছে। এসব ব্লকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে গ্যাস মজুদ রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। জ্বালানির চাহিদা মেটানোর জন্য সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশ তরল প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি শুরু করেছে। এজন্য মহেশখালিতে ভাসমান টার্মিনাল নির্মাণ করা হয়েছে ২০১৮ সালে। আমেরিকার একটি কোম্পানি এটি নির্মাণ করেছে এবং আগামী ১৫ বছর সেটি পরিচালনা করবে।
বাংলাদেশের কৃষিখাতকে একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা হিসেবে দেখছে যুক্তরাষ্ট্র।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্ববাজার থেকে বাংলাদেশ ২০২১ সালে প্রাড়ে ১০ হাজার মিলিয়ন ডলারের কৃষিজ পণ্য আমদানি করেছে। এরমধ্যে আমেরিকা থেকে আমদানি করেছে এক হাজার মিলিয়ন ডলার, অর্থাৎ মোট আমদানির ১০ ভাগের এক ভাগ।
বিনিয়োগকারীরা সাধারণত দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা করেন এবং সেজন্য একটি দেশের সুশাসনের জায়গাটি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির।
নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে তিনি বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে দুটি আমেরিকান কোম্পানি বাংলাদেশে এসেও গভর্ন্যান্স বা সুশাসনজনিত জটিলতার কারণে দেশ ছেড়ে চলে যেতে হয়েছে।
‘তারা যেটা জানতে চায় সেটা হলো, এই বিনিয়োগটা করলে এই জায়গাতে আমরা কী পাবো, কী দেবো, এখানে গভার্ন্যান্সের অনেক বিষয় আমরা স্বচ্ছভাবে রাখি না বা রাখতে পারি না’ এমন অস্বচ্ছতার জায়গায় তারা আর স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতে পারে না, বরেন হুমায়ুন কবির।
বাংলাদেশ যতই দাবি করুক না কেন একটি ভালো বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশের, আক্ষরিক চেহারাটা প্রকাশ পায় এমন প্রতিবেদনে এবং সেটা অনেক বেশি নির্ভরযোগ্য বলে উল্লেখ করেন হুমায়ুন কবির।