তিনদিনের বাজেট একদিনেই শেষ, ফিরে গেছেন অনেক পর্যটক
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ২০ ডিসেম্বর,সোমবার,২০২১ | আপডেট: ০৭:০৩ এএম, ১৯ ডিসেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
অন্যসময় কক্সবাজারে তিন রুমের ফ্ল্যাট বাসায় ২ হাজার টাকায় থাকা গেলেও এবার একদিনেই তিন রুমের একটি ফ্ল্যাটের ভাড়া গুনতে হয়েছে ২০ হাজার টাকা। বিজয় দিবস ও সপ্তাহিক ছুটি মিলিয়ে তিনদিনের জন্য পরিকল্পনাহীন কক্সবাজার বেড়াতে আসা অনেক পর্যটক ভ্রমণসূচি সংক্ষিপ্ত করে ফিরে গেছেন। আগে থেকে রুম বুকিং না দিয়ে পরিবার কিংবা গ্রুপে বেড়াতে এসে দু'রাতের ভাড়ার পরিমাণ টাকায় এক রাত অবস্থান করে অনেকে একদিন পরই হোটেল ছেড়ে দিয়ে কক্সবাজার ত্যাগ করেছেন বলে খবর পাওয়া গেছে।
এ ঘটনা স্থায়ী পর্যটনের জন্য 'অশনি সংকেত' বলে মন্তব্য করেছেন সচেতন মহল। চট্টগ্রাম মহানগরীর কালামিয়া বাজার এলাকার আবদুল মান্নান নিজেদের গাড়িতে পরিবার নিয়ে ১৬ ডিসেম্বর বিকেলে কক্সবাজার আসেন। পরিকল্পনা ছিল ১৬-১৭ ডিসেম্বর দু'রাত হোটেলে থেকে ১৮ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম রওয়ানা হবেন। কিন্তু পরিচিত হোটেলে গিয়েও রুম খালি পাননি। আগেই বুকিং নেয়া একজনের ৪টি রুম ১৬ হাজার টাকায় নিয়ে এক রাত থেকে ১৭ ডিসেম্বর রাতে চট্টগ্রাম ফিরে যান তিনি।
হোটেলের নাম প্রকাশ না করার শর্তে আবদুল মান্নান বলেন, "হোটেলটিতে অন্যসময় এলে রুমপ্রতি এক হাজার টাকায় থাকতাম। যেহেতু চাহিদা বেশি তাই হিসাব করেছিলাম দু'হাজার টাকায় রুম নিয়ে দিনে ৮ হাজার টাকা করে দুইদিনে ১৬ হাজার টাকা আবাসন বাবদ খরচ করবো। কিন্তু দ্বিতীয় হাত বদল হয়ে রুম নিতে হওয়ায় একরাতেই ১৬ হাজার টাকা গুনতে হয়েছে। ফলে, বাজেটের স্বল্পতায় সফর সংক্ষিপ্ত করে ফিরে এসেছি।"
তারমতো ১০-১২ জনের দল নিয়ে বিজয় দিবসের দিন কক্সবাজার পৌঁছান সিলেটের গোলাপগঞ্জের আফজাল হায়দার। অন্য সময়ে তিন রুমের ফ্ল্যাট বাসায় ২ হাজার টাকায় থেকে গেলেও এবার একদিনেই তিন রুমের একটি ফ্ল্যাটের ভাড়া গুনেছেন ২০ হাজার টাকা। ইনিও মধ্যস্বত্বভোগীর কাছ থেকে ফ্ল্যাটটি ভাড়া নেন। ফলে তারাও সফর সংক্ষিপ্ত করে শুক্রবার রাতেই সিলেটের উদ্দেশে কক্সবাজার ত্যাগ করেন।
আফজাল বলেন, "এক ফ্ল্যাটে সফরসঙ্গী সবাই একসাথে থাকতে পারলেও এত বেশি ভাড়া দেয়ায় মনটা খারাপ ছিলো। শুক্রবার বিকেলে প্রশাসনের সহযোগিতায় কিছু টাকা ফেরত পেয়েছি। এরপরও ভালো না লাগায় আমরা ফিরে এসেছি।"
শুধু তারা নন, এভাবে দু'দিন বা তিনদিনের বাজেট এক-দু'দিনে খরচ হয়ে যাওয়ায় অনেক পর্যটক সফর সংক্ষিপ্ত করে কক্সবাজার ত্যাগ করেছেন। তাদের মতে, লোকসমাগম বেশি হওয়ায় হোটেলের কক্ষ ভাড়া যেমন অতিরিক্ত গুনতে হয়েছে তেমনি টমটম-সিএনজি-রিক্সা ভাড়াও দিতে হয়েছে বেশি। পরিবার নিয়ে বেড়াতে আসা পর্যটকরা এ ভোগান্তিতে পড়েন সবচেয়ে বেশি।
পাশাপাশি কক্সবাজারের রেস্তোরাঁগুলোতেও অন্য সময়ের চাইতে মাছ, মাংসের দাম বাড়তি দিতে হয়েছে। ডিম, সবজি, ডাল এসব দিয়ে যারা খেয়েছেন তারা মোটামুটি পুরনো বিলেই খেতে পেরেছেন।
রাঙ্গামাটির হানিফ মোহাম্মদ বলেন, "বন্ধুদের নিয়ে বেড়াতে এসে খাবার খেতে গিয়ে চরম বিড়ম্বনায় পড়ি। সামুদ্রিক মাছ, গরুর মাংস, মুরগি বা অন্য মাছের দাম যা চাওয়া হচ্ছিল তা আমাদের মতো মধ্যবিত্ত পর্যটকদের আওতার বাইরে। একাধিক রেস্তোরাঁর একই অবস্থা। কোথাও ডিম, সবজি বা ডাল বিক্রি করছিলো না। গ্রাহক বেশি হওয়ায় রেস্তোরাঁগুলো কথা বলার ফুরসতও পাচ্ছিল না। পরে ওশান প্যারাডাইসের পূর্ব পাশের গলিতে 'স্বাধীন বাংলা' নামের একটি রেস্তোরাঁয় ডিম, সবজি ও ডাল দিয়ে ভাত খেয়ে জনপ্রতি ৯০ টাকা বিল দিয়ে স্বস্তি পেয়েছি। অবশ্য ব্যাচেলর বন্ধুর বাসায় থাকার সুযোগ পাওয়ায় আমাদের রুম ভাড়ার ভোগান্তি পোহাতে হয়নি।"
"তবু কোথাও ভালোমতো হাঁটাচলার সুযোগ না পেয়ে আমরাও একদিন পর শুক্রবার রাতে কক্সবাজার ত্যাগ করে চট্টগ্রাম চলে এসেছি। পরে শনিবার বিকেলে রাঙ্গামাটি পৌঁছাই।"
সংশ্লিষ্টদের মতে, এবারের বিজয় দিবসের এ ছুটিতে নানাভাবে দুর্ভোগে পড়েছেন হাজারো পর্যটক। অনেক পর্যটক হোটেলে ঠাঁই না পেয়ে বাস, সৈকতের কিটকট চেয়ারে (বিনোদন ছাতা), ফুটপাত এবং দোকানের বারান্দায় বা সৈকতের খোলা আকাশের নিচে রাত্রিযাপন করেছেন। কিন্তু যারা রুম পেয়েছেন তাদের অতিরিক্ত টাকা গুনতে হয়েছে। পরিবারসহ ভ্রমণ করতে আসা লোকজন রুম না পেয়ে বাস-ফুটপাতে রাত কাটাতে গিয়ে শৌচাগার নিয়ে বিড়ম্বনায় পড়েন।
হোটেল সী নাইটের ব্যবস্থাপক শফিক ফরাজী বলেন, "ডিজিটাল যুগে বাস করেও আমাদের পর্যটকরা এখনো অপরিকল্পিত ভ্রমণে বের হন। ওয়েবসাইট কিংবা ফেসবুক পেইজে প্রায় প্রতিটি হোটেল-গেস্ট হাউজের যোগাযোগ নাম্বার দেয়া আছে। সেখানে কন্টাক্ট করে সরাসরি বুকিং দিলে কেউই ঠকতো না। তাছাড়া সবাই শুধু বন্ধের দিনগুলোতে আসার জন্য মুখিয়ে থাকেন। ফলে চাপের কারণে থাকা-খাওয়া সবখানেই বাড়তি টাকা দেয়ার পাশাপাশি ভোগান্তির মধ্য দিয়ে যান। সাপ্তাহিক খোলার দিনগুলোতে বেড়াতে আসা বুদ্ধিমান পর্যটকের কাজ।"
কক্সবাজার সিভিল সোসাইটির সভাপতি আবু মোরশেদ চৌধুরী বলেন, "পরিকল্পিত নগরায়নের পাশাপাশি সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনাও জরুরী এটা এবারের বিজয় দিবসের ছুটি স্পষ্ট করে দিয়েছে। একটা পর্যটন এলাকায় যে যার মতো ভাড়া, খাবারের বিল নিতে পারে না। কোন সময়ে কী পরিমাণ বিল নেয়া যাবে সেটা বীচ ম্যানেজমেন্ট কমিটি কর্তৃক ঠিক করে দেয়া দরকার। এটি নিশ্চিত করা না গেলে হয়রানি ও ভোগান্তির ভয়ে কক্সবাজার বিমুখ হবেন পর্যটকরা।"
কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের পর্যটন সেলের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সৈয়দ মুরাদ ইসলাম বলেন, "এত সংখ্যক হোটেল-রেস্তোরাঁয় কী ঘটছে খেয়াল রাখা মুশকিল। কিন্তু কারো সাথে অন্যায্য কিছু ঘটে থাকলে প্রশাসনের তথ্য কেন্দ্রে যোগাযোগের জন্য মাইকিং করা হয়। অভিযোগ পেলে দ্রুতই ব্যবস্থা নেওয়া যায়। শুক্রবারও সী-পার্ল-১ ও ২ নামক ফ্ল্যাট আবাসন এবং হোটেল ওপেলায় অভিযোগের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে জরিমানা করা হয়েছে।"
কক্সবাজার বীচ ম্যানেজমেন্ট কমিটির সভাপতি ও জেলা প্রশাসক মো. মামুনুর রশীদ বলেন, "বিজয় দিবস ও সাপ্তাহিক ছুটিতে আসা পর্যটকদের নিয়ে কিছু আবাসন ও রেস্তোরাঁর অপ্রীতিকর পরিস্থিতি নিয়ে চারপাশে অভিযোগ ও আলোচনা হচ্ছে। সামনের দিনে এসব বিষয়ের যেন আর পুনরাবৃত্তি না হয় সেজন্য করণীয় নির্ধারণ করার উদ্যোগ নেয়া হবে।"
এরপরও কেউ প্রতারণার শিকার হয়েছেন বুঝলেই সৈকত এলাকার জেলা প্রশাসনের তথ্য সেলে যোগাযোগ করতে অনুরোধ জানান ডিসি।