খুলনায় সুন্দরী নীলার সিরিজ বিয়ে
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ২৭ সেপ্টেম্বর,মঙ্গলবার,২০২২ | আপডেট: ০৮:৫৫ এএম, ১৯ ডিসেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
জাতীয় পরিচয়পত্র অনুযায়ী তার আসল নাম সুলতানা পারভিন ওরফে নীলা। কখনো তিনি নিজেকে পরিচয় দেন সুমাইয়া আক্তার বৃষ্টি নামে, আবার কখনো নাজিয়া শিরিন শিলা, রুমাইনা ইয়াসমিন রূপা, স্নিগ্ধাসহ আরো অনেক নামে। ৩৯ বছর বয়সী সুন্দরী এই নারীর প্রতারণাই মূল পেশা। সৌন্দর্যকে পুঁজি করে প্রতারণার মাধ্যমে কামিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। করেছেন বাড়ি-গাড়ি। এ পর্যন্ত কুমারী পরিচয়ে আটটি বিয়ে করেছেন। সবগুলোই ছাড়াছাড়ি হয়েছে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে। তার সব সময় টার্গেট ধনী ব্যবসায়ী, প্রবাসীরা। যারাই তার খপ্পরে পড়েছে, তারাই হয়েছে সর্বশান্ত।
খুলনার সোনাডাঙ্গা আবাসিক এলাকার দ্বিতীয় ফেজে তার বাসা। বাবার নাম সুলতানুল আলম বাদল। প্রতারণার মাধ্যমে বিয়ে করা ছাড়াও অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। ৭ নম্বর সাবেক স্বামী এম রহমানের দায়ের করা প্রতারণার মামলায় গত ২৬ সেপ্টেম্বর তাকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। গতকাল সোমবার ঢাকার ১৪ নম্বর আদালতে হাজির হয়ে প্রতারণার মামলায় জামিন আবেদন আবেদন করলে আদালতের বিচারক মাইনুল হোসেন তাকে জেলে পাঠান। এ মামলার অপর আসামি ও নীলার বড় ভাই শফিকুল আলম বিপ্লবের জামিন মঞ্জুর করেছেন আদালত। এর আগে গত ১৩ সেপ্টেম্বর নীলার বিরুদ্ধে গ্রেফতার পরোয়ানা জারি করেন আদালত।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, এ পর্যন্ত ৮ টি বিয়ে করেছেন সুলতানা পারভিন ওরফে নীলা। বিয়ে করাই তার নেশা। বিত্তবানদের পথে বসানোর জন্য তিনি বিয়ে করেন। প্রথমে প্রেমের জালে ফাঁসিয়ে শারিরিক সম্পর্ক করেন, এরপর বিয়ের জন্য চাপ দেন। বিয়ের কিছুদিন পর সহায় সম্পত্তি লিখে দেয়ার জন্য চাপ দেন। না হলে মামলা করার হুমকি দেন, মামলাও দেন। তার হয়রানি মামলার শিকার হয়েছেন সব ক’ জন সাবেক স্বামী। বিয়ে ছাড়াও তার রয়েছে অসংখ্য বয়ফ্রেন্ড। সরকারি আমলা, বড় বড় রাজনৈতিক নেতাদের সাথে তার উঠাবসা। খুলনা মহানগরীর নাজিরঘাট এলাকার আব্দুল জলিলের ছেলে আব্দুল বাকী বৃষ্টির ফাঁদে পড়ে সর্বস্ব হারিয়েছেন। তিনি বৃষ্টির অষ্টম স্বামী। তিনি জানান, বৃষ্টি এ পর্যন্ত তাকেসহ আটটি বিয়ে করেছেন। বিয়ের কিছুদিন পর সেই স্বামীকে ছেড়ে দেন। পরে স্বামীর কাছ থেকে দেনমোহরের টাকাসহ বিভিন্ন কৌশলে বাড়ি-গাড়ি হাতিয়ে নেন। বৃষ্টির মূল টার্গেট সম্পদশালী, ব্যবসায়ী, উচ্চপদের চাকরিজীবী ও প্রবাসী পুরুষ। প্রথমে টার্গেট নিশ্চিত করে ধীরে ধীরে কাঙ্খিত পুরুষের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলেন। এরপর নিজের সৌন্দর্য ও কথা দিয়ে আটকে ফেলেন তাদের।
১৯৯৯ সালে বৃষ্টির প্রথম বিয়ে হয় মাদারীপুর জেলার হরিকুমারিয়া গ্রামের আব্দুল হাকিম শিকদারের জাপান প্রবাসী ছেলে শাহাবউদ্দিন সিকদারের সঙ্গে। তখন বয়স ছিল তখন ১৫ বছরেরও কম। কিছুদিন যেতে না যেতেই স্বামীর ঘর থেকে টাকা ও স্বর্ণালংকার নিয়ে বেরিয়ে যান তিনি। তার উশৃঙ্খল জীবনযাপন ও মালামাল চুরির ঘটনায় মাদারীপুর সদর থানায় একটি জিডি করেন শাহাবউদ্দিন। যার নম্বর ৭৩৮, ১৯ ডিসেম্বর ১৯৯৯। যদিও ২০০১ সালে শাহাবউদ্দিনের সঙ্গে বৃষ্টির বিচ্ছেদ হয়।
দ্বিতীয় বিয়ে হয় ২০০৫ সালের ৬ মে। বৃষ্টির দ্বিতীয় স্বামীর নাম এসএম মুনির হোসেন। তিনি খুলনা মহানগরীর শেরেবাংলা রোড এলাকার মো. মকবুল হোসেনের ছেলে। তখন নিজেকে কুমারী দাবি করে মুনির হোসেনের সঙ্গে এক লাখ টাকার কাবিননামায় বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন তিনি। বিয়ের কিছুদিনের মধ্যেই উশৃঙ্খল জীবনযাপন ও উগ্র আচরণের শিকার হন স্বামী মুনির। একপর্যায়ে স্বর্ণালংকার ও টাকা নিয়ে এ বাড়ি থেকেও বেরিয়ে যান বৃষ্টি। পরে একই বছরের ১০ ডিসেম্বর তাকে তালাক দেন মুনির হোসেন। যদিও পরবর্তীতে তার কাছ থেকে দেনমোহরের টাকা আদায় করতে ২০০৬ সালে মুনির হোসেনের বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন এবং পারিবারিক আদালতে মামলা করেন বৃষ্টি।
সেই ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই ফের নিজেকে কুমারী দাবি করে ২০০৮ সালের এপ্রিলে বিয়ে করেন। এবার খুলনা নগরীর খালিশপুর ওয়ারলেস ক্রস রোডের আব্দুল মান্নানের ছেলে ঠিকাদার মইনুল আরেফিন বনিকে বিয়ে করেন। তবে শর্ত থাকে বিয়ের পর বৃষ্টি নিজের আত্মীয়ের মাধ্যমে বনিকে ইতালি নেবেন। বিদেশে নেয়ার কথা বলে তৃতীয় স্বামীর কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নেন। এর কিছুদিন যেতে না যেতেই প্রকাশ পেতে থাকে বৃষ্টির প্রতারণা। একপর্যায়ে তাদের মধ্যেও বিচ্ছেদ ঘটে। এ ঘটনায় নিজেকে কুমারী পরিচয় দিয়ে প্রতারণার আশ্রয় নেয়ায় বৃষ্টির বিরুদ্ধে মামলা করেন স্বামী শেখ মঈনুল আরেফিন বনি।
২০২০ সালের ডিসেম্বরে খুলনার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে মামলাটি করা হয়। মামলাটি বর্তমানে তদন্তাধীন রয়েছে। তবে যথারীতি টাকা আদায় করতে বনির বিরুদ্ধেও খুলনার বিভিন্ন আদালতে একাধিক মামলা করেন প্রতারক বৃষ্টি। বনির সঙ্গে মামলা চললেও ২০১১ সালে নারায়ণগঞ্জের ইফতিখার নামে আরেকজনকে বিয়ে করেন সুলতানা পারভীন নীলা ওরফে বৃষ্টি। সেখানেও দাম্পত্য জীবন স্থায়ী হয়নি। একপর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান ইফতেখার।
এরপর ২০১২ সালে বিয়ে করেন বাগেরহাটের বাসিন্দা কামাল হোসেনকে। ২০১৭ সালে ইতালি প্রবাসী মাদারীপুরের মোহাম্মদ আজিমকে, ২০১৮ সালে খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার মোহাম্মদ রহমানকে এবং সর্বশেষ ২০১৯ সালে খুলনা মহানগরীর নাজির ঘাট এলাকার মো. আব্দুল বাকীকে বিয়ে করেন। আট নম্বর স্বামী মো. আব্দুল বাকীর সঙ্গে প্রতারণা করায় বৃষ্টির বিরুদ্ধে ঢাকার আদালতে চেক ও টাকা-পয়সা চুরির অভিযোগে মামলা করা হয়।
মামলাটি বর্তমানে পিবিআই ঢাকা মেট্রো দক্ষিণ কার্যালয়ে তদন্তাধীন রয়েছে। এছাড়া সিরাজগঞ্জে থাকার সময় ঢাকার একটি ফ্ল্যাট নিজের নামে লিখে না দেয়ায় আরো এক স্বামীকে নারী নির্যাতন মামলায় ফাঁসানো হয়। এছাড়া তাকে হত্যার হুমকিও দেয়া হয়। ওই ঘটনায় প্রতারক বৃষ্টির বিরুদ্ধে ২০১৯ সালের ২ মে সিরাজগঞ্জ সদর থানায় জিডি করা হয়।
গত বছরের জানুয়ারিতে খুলনা মহানগরীর খালিশপুরে নিজের পূর্ব পরিচয়ের সূত্র ধরে আফরীন আহমেদ নামে এক আত্মীয়ের বাসায় কিছুদিন থাকেন সুলতানা বৃষ্টি। সেই সুযোগে আত্মীয়ের বাসা থেকে একটি চেকের পাতা চুরি করে অ্যাকাউন্ট থেকে ১০ লাখ টাকা তুলে নেন। ওই ঘটনায় তার বিরুদ্ধে জালিয়াতি ও চুরির অভিযোগে মামলা করা হয়। মামলাটি বর্তমানে পিবিআই খুলনা কার্যালয়ে তদন্তাধীন রয়েছে। প্রতারণার শিকার হয়ে সুলতানা পারভীন নীলার বিরুদ্ধে অভিযোগ দেন এসএম মহিবুর রহমান নামে এক স্বামী।
তদন্ত শেষে গত বছরের ৩০ জানুয়ারি এসপি বরাবর প্রতিবেদনে দাখিল করেন সিরাজগঞ্জের এডিশনাল এসপি মো. স্নিগ্ধা আকতার। সেই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, সুলতানা পারভীন নীলা নিজেকে কুমারী, বিধবা ও তালাকপ্রাপ্ত দাবি করে কখনো সুলতানা পারভীন নীলা, কখনো সুলতানা পারভীন বৃষ্টি আবার কখনো সুলতানা পারভীন নাম ব্যবহার করে আরো পাঁচটি বিয়ে করেছিলেন। এভাবে একাধিক লোকের সঙ্গে বিয়ে করেন। বিয়ের পর মিথ্যা মামলার ভয় দেখিয়ে স্বামীর কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নেন। বৃষ্টির অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে দুই স্বামী মারাও গেছেন।
খুলনা জেলা রেজিস্ট্রারের কার্যালয়ের অনুমোদিত তালিকা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, সুলতানা পারভীনের নিকাহ রেজিস্ট্রিকারী মাওলানা এএসএম নুরুল হক। যিনি বৈধ নিবন্ধিত নিকাহ রেজিস্ট্রার নয়। অবৈধ নিকাহ রেজিস্টার দিয়ে প্রতারণার মাধ্যমে বিয়ে পড়াতেন। বিয়ের পর সংসার চালানোর নামে সুকৌশলে নিজের খরচ বাবদ টাকা, দেনমোহর ও স্বামীর থাকা ফ্ল্যাট নিজের নামে করতে বিভিন্নভাবে অত্যাচার চালাতেন। এমনকি বিয়ের কাবিননামায় টাকার অংক পরিবর্তন করে মোটা অংকের টাকা বসিয়ে দেন।