ইউটিউব দেখে কমলা চাষ, হতাশায় বাগান কাটলেন কৃষক
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ২৪ ডিসেম্বর,শুক্রবার,২০২১ | আপডেট: ০৩:২২ পিএম, ১৬ ডিসেম্বর,সোমবার,২০২৪
ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার ৬নং ত্রিলোচনপুর ইউনিয়নের দাঁদপুর কৃষক আসাদুজ্জামান। ২০১৯ সালে তিনি ৬০ শতক (দেড় বিঘা) জমিতে পেয়ারা চাষের পাশাপাশি একই জমিতে মেরিন্ডা জাতের কমলা এবং আলাদাভাবে ২০ শতক (১০ কাঠা) জমিতে চায়না কমলা চাষ করেন। এক বছর পর থেকে তার বাগানে ফল আসতে শুরু করে। এ বছর তার বাগানে ২০ মণ চায়না কমলার ফলন হয়েছে। কিন্তু তার বাগানের কমলাগুলোতে স্বাভাবিক কমলার থেকে রস কম, ভিতরে বিচি বেশি এবং খেতে একটু তিতা হওয়ায় বাজারে ন্যায্যমূল্য পাননি। ফলে তিনি হতাশা ও ক্ষোভে তার কমলা বাগান কেটে দিয়েছেন।
কৃষক আসাদুজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি এই কমলা চাষ করে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। এখন সেখানে নতুন ফলের বাগান করতে চাই।
তিনি বলেন, খুব শখ করে দুই বিঘা জমিতে কমলা বাগান করেছিলাম। ২০ শতক (১০ কাঠা) জমিতে চায়না কমলা ও ৬০ শতক (দেড় বিঘা) জমিতে মেরিন্ডা কমলা। ভবিষ্যতে কিছু করতে পারব এই ভেবে আশায় বুক বেঁধেছিলাম। বাগানে প্রচুর কমলাও ধরেছিল। কিন্তু এই কমলা যখন পরিপক্ক হয়ে বিক্রয় উপযোগী হল এবং পাকা শুরু করল তখনই সমস্যাটা দেখা দিল। কমলাগুলো ঢাকায় পাঠাতে গিয়ে বিভিন্ন বাধার সম্মুখীন হই। পাশের ইউনিয়নের এক ভাই ঢাকায় কমলা পাঠিয়ে ২০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেছেন। আমিও সেই আড়তে কমলা পাঠানোর জন্য ফোন দিই। কিন্তু তারা বলে এই কমলা বিক্রি করতে পারছি না, কমলা আর পাঠানোর দরকার নেই। পারলে অন্য কোনো ফল পাঠান।
আসাদুজ্জামান বলেন, বাগানের ১০ কাঠা (২০ শতক) জমিতে প্রায় ২০ মণ কমলা আসছিল। এই কমলা বিভিন্ন লোকজন দিয়ে গ্রামে, হাটে-বাজারে হকারি করে ৫০-৬০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করতে হয়েছে। বাগানের বেশিরভাগ কমলা খেতে তেমন সুস্বাদু ছিল না। একটু হালকা তিতা, টক ও ভিতরে বড় বড় বীজ। ১০টি কমলায় যদি রস থাকলে ১৫টি কমলার রস শুকিয়ে গেছিল। আমাদের পার্শ্ববর্তী যশোরের চৌগাছাতে আমার মত অনেক কৃষক কমলা চাষ করেছেন। তারাও আমার মত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তাদের বাগানগুলো তারা কেটে দিয়েছেন। সেখানে তারা ড্রাগন ফল চাষ করবেন।
ক্ষতিগ্রস্ত এই কৃষক বলেন, তিন বছর আগে চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার কৃষি অফিসার তালহা জুবাইর মাসরুরের ইউটিউব চ্যানেল কৃষি বায়োস্কোপে একটি ভিডিও দেখতে পাই। সেখানে চুয়াডাঙ্গার জীবননগরের নিধিকুন্ডু গ্রামের ওমর ফারুকের নার্সারিতে চায়না কমলার চাষ নিয়ে একটি প্রতিবেদন দেখানো হয়। সেই প্রতিবেদন দেখে উদ্বুদ্ধ হই। এরপর এক বন্ধুর মাধ্যমে খুলনার অভয়নগর এলাকা থেকে চায়না ও মেরিন্ডা কমলার চারা কিনে আনি। চারাগুলো দুই বিঘা জমিতে রোপণ করি। এরপর ভালোভাবে পরিচর্যা করি। এক বছর পর অল্প কিছু ফল আসছিল। তবে এ বছর বাগানে প্রচুর ফলন হয়েছে। একই ইউনিয়নের ত্রিলোচনপুর গ্রামে যারা কমলা বাগান করেছেন তারাও একই ভিডিও দেখে করেছেন। তাদের চারাগুলো চুয়াডাঙ্গা থেকে নিয়ে এসেছেন। তারাও একই সমস্যায় আছেন।
কৃষি বিভাগের কোনো পরামর্শ নিয়েছিলেন কিনা- জানতে চাইলে আসাদুজ্জামান জানান, যখন কমলা চাষ শুরু করি তখন কোনো কৃষি কর্মকর্তা বা কৃষি বিভাগের সঙ্গে কোনো পরামর্শ করিনি। তবে গাছে ফল আসলে আমাদের ব্লকের উপ-সহকারী কৃষি অফিসার জহরুল ইসলামকে দেখিয়েছিলাম। তিনি আমাদের এ বছর দেখার পরামর্শ দিয়েছিলেন। তারপরও আশপাশের বাগান যখন কেটে দিচ্ছিল তখন আমিও তাদের সঙ্গে পরামর্শ করে বাগান কেটে দিই।
তিনি বলেন, আমার মতো কেউ শুধু ইউটিউব দেখে উদ্বুদ্ধ হবেন না। আপনার নিকটতম কৃষি কর্মকর্তা বা কৃষি অফিসে গিয়ে জেনে বুঝে শুনে তারপর এই ধরনের ফলের বাগান করবেন।
ঝিনাইদহ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, ঝিনাইদহে মোট আবাদযোগ্য কৃষি জমি রয়েছে ১ লাখ ৫০ হাজার ২৩৫ হেক্টর। যার মধ্যে ১১ হাজার ৭৯৫ হেক্টর জমিতে বাণিজ্যিকভাবে বিভিন্ন ধরনের ফল চাষ করা হচ্ছে। কৃষি প্রধান এই জেলায় বেশি পরিমাণে উৎপাদন হয় কলা, আম ও পেয়ারা ফল। যার মধ্যে কুল ৪৪৬ হেক্টর, কমলা ৬২ হেক্টর, মাল্টা ১৪৬ হেক্টর, ড্রাগন ১৫১ হেক্টর, শরিফা ১৭ হেক্টর, কদবেল ২৩ হেক্টর, কলা ৪ হাজার ৬৩০ হেক্টর, আম ২ হাজার ২২১ হেক্টর, লিচু ৩২০ হেক্টর এবং পেয়ারা ১ হাজার ২৭৯ হেক্টর জমিতে বাণিজ্যিকভাবে চাষ হচ্ছে। এর মধ্যে নতুন বিদেশি ফল হিসেবে যোগ হয়েছে চায়না ও কাশ্মীরি কমলা, মাল্টা, ড্রাগন এবং উন্নত জাতের হাইব্রিড কুল। যা জেলার চাহিদা মিটিয়ে দেশের বিভিন্ন জেলায় বিক্রি করা হচ্ছে।
কালীগঞ্জ উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অফিস সূত্রে জানা যায়, কালীগঞ্জ উপজেলায় ২০২০-২০২১ অর্থবছরে ১ হাজার ৩৪৬ হেক্টর জমিতে বিভিন্ন ধরনের ফল চাষাবাদ হয়েছে। যেখানে আম, কাঁঠাল, লিচু, পেয়ারা, কলা, পেঁপে, কুল, মাল্টা, লেবু, কদবেল, বাংগী ও ড্রাগন ফলসহ বিভিন্ন ধরনের ১ হাজার ৩৯৬টি ফল বাগান রয়েছে। এর মধ্যে আম, পেয়ারা, কলা, কুল, মাল্টা ও লেবু বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদ হচ্ছে।
ত্রিলোচনপুর গ্রামের কমলাচাষি মো. সোহেল রানা পেয়ার ঢাকা পোস্টকে জানান, ১১৫টি চায়না কমলা গাছ দিয়ে তিনি বাণিজ্যিকভাবে বাগান শুরু করেছেন। এ বছর তিনি ২০ কেজি ফল পেয়েছেন। নিজেরা খেয়েছেন ও গ্রামের মানুষকে দিয়েছেন। সবাই ফলাফল দিয়েছে, বাজারের যে কমলাটা পাওয়া যায় তার সমপরিমাণ স্বাদ তার বাগানের কমলায় আছে।
তিনি জানান, একই ইউনিয়নের আসাদুজ্জামানও চায়না কমলা চাষ করেছিলেন। তিনি কী কারণে গাছগুলো কেটে দিয়েছেন তা তার ব্যক্তিগত বিষয়। সঠিক চারা যদি না পাওয়া যায় তাহলে ফলও ভালো হবে না। তিনি চুয়াডাঙ্গার নিধিকুন্ডু গ্রামের ওমর ফারুকের নার্সারিতে করা যে চায়না কমলা দেখে এসেছেন তার বাগানেও একই কমলা ধরেছে। স্বাদ ও গন্ধ একই।
গোবরডাঙ্গা গ্রামের কমলাচাষি ওমর ফারুক টোকন ঢাকা পোস্টকে জানান, ১৮ মাস আগে কমলা বাগান শুরু করেছেন। প্রথমে ৫০টা গাছ দিয়ে শুরু করেন, এখন ৪৮টি গাছ আছে। তিনি শুনেছেন পাশের গ্রামের একজন চাষি একই জাতের কমলা বাগান কেটে দিয়েছেন। তার অভিযোগ ছিল পাকার পর ফলে কোনো রস থাকে না। তার বাগানে এবার যে ফল এসেছে সেগুলো দেখেও তার মনে হয়েছে একই রকম সমস্যা। যেসব কমলাগুলো একটু সাইজে বড় সেগুলোতে একটু রস কম ছিল। তবে যে, তিতার কথা বলা হয়েছে তার বাগানের কমলাগুলোতে তিতার মাত্রা সহনীয় ছিল। এই কমলায় রস থাকলে বাণিজ্যিকভাবে চাষ করা সম্ভব। যদি পাকার পর রস না থাকে তাহলে কমলা বাজারজাত করা সম্ভব হবে না।
ত্রিলোচনপুর ইউনিয়নের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো. জহুরুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে জানান, এই ইউনিয়নে ১ হেক্টরের বেশি জমিতে ৮ জন কৃষক চায়না কমলা চাষ করেছেন। এ বছরেই প্রথম কমলার ফলন পাওয়া গেছে। দাঁদপুর গ্রামের আসাদুজ্জামান তাকে ফোন দিলে তিনি দেখেন ফলগুলো কাঁচা এবং টক। তখন তাকে বলেন ফল পাকলে ভালো হবে। পরে ফল পাকার সময় বরিশাল থেকে একটি মোটিভিশন টিম তার বাগানের ফল খেয়ে জানায়- মিষ্টি একটু কম থাকলেও ফলের রসটা ঠিক আছে। এরপর আর আসাদুজ্জামান কোনো যোগাযোগ করেননি। তিনি কমলা বাজারে বিক্রি করতে পারছেন না অভিযোগ করে বাগানের সব গাছ কেটে দিয়েছেন। তবে এই ফলের ভবিষ্যৎ ভালো। বাগানটা না কাটাই ভালো ছিল।
কালীগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শিকদার মো. মোহায়মেন আক্তার ঢাকা পোস্টকে বলেন, উপজেলার কয়েকজন কৃষক পার্শ্ববর্তী জেলার কৃষকদের বাগান দেখে উৎসাহিত হয়ে চায়না কমলার আবাদ করেছেন। তবে যে ৬-৭ জন কৃষক চায়না কমলার চাষ করেছেন তারা কখনো আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেননি। এমনকি কমলা বাগান হয়েছে সেটি জানিও না। যখন তারা বাজারে বিক্রি করতে পারছেন না তখন ইউটিউবে একটি নেগেটিভ রিপোর্ট আসে, সেখান থেকেই জানতে পারি।
তিনি বলেন, এই চায়না কমলার আবাদ সম্পর্কে আমাদের কাছে কোনো তথ্য নেই। তবে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, ফল গবেষণা ইনস্টিটিউটের মাধ্যমে আমরা বিভিন্ন ধরনের নতুন নতুন চারা পাই। হর্টিকালচার সেন্টারগুলোর মাধ্যমেই চারাগুলো সম্প্রসারণ করা হয়। আমরা চাই না কোনো কৃষক কৃষিকাজ করে ক্ষতিগ্রস্ত হোক। তবে কৃষক ভাইয়েরা যদি আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতো তাহলে হয়তো তাদেরকে সহযোগিতা করতে পারতাম, কিংবা বিপণনের জায়গাগুলো খুঁজে দিতে পারতাম।