পাকিস্তানের কোনো প্রধানমন্ত্রী কেন পাঁচ বছর মেয়াদ শেষ করতে পারেননি?
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ৪ এপ্রিল,সোমবার,২০২২ | আপডেট: ০৫:৫৩ পিএম, ২৫ ডিসেম্বর,
বুধবার,২০২৪
জাতীয় পরিষদের নিম্ন কক্ষে অনাস্থাভোটের দাবি তুলেছিলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের বিরুদ্ধে বিরোধীরা । কিন্তু সেই আজ ৩ এপ্রিল সে অনাস্থা-প্রস্তাব বাতিল করেন ডেপুটি স্পিকার। এর পরেই প্রেসিডেন্টের কাছে ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি ভেঙে ভোট করানোর আহ্বান জানান ইমরান। তার প্রস্তাবমতো অ্যাসেম্বলি ভেঙেও দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট। ফলে মেয়াদ শেষ করতে পারছেন না তিনি।
পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকে কোনও প্রধানমন্ত্রীই নিজেদের পাঁচ বছরের পূর্ণ মেয়াদ সমাপ্ত করেননি। কখনও সামরিক অভ্যুত্থানে, আবার কখনও বিরোধী দলের অনাস্থার মুখে পড়ে গদি ছাড়তে হয়েছে দেশটির প্রধানমন্ত্রীদের।
লিয়াকত আলি খান
স্বাধীন পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হন লিয়াকত আলি খান। ১৯৪৭ সালের ১৪ অগস্ট অর্থাৎ পাকিস্তানের স্বাধীনতার দিন তিনি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার নেন। কিন্তু ১৯৫১ সালের ১৬ অক্টোবর এক জনসভায় বক্তৃতা দেওয়ার সময় আততায়ীর গুলিতে প্রাণ হারান তিনি। মোট চার বছর ৬৩ দিন তিনি ক্ষমতায় ছিলেন।
খাজা নাজিমুদ্দিন
লিয়াকতের পর ক্ষমতাসীন হন খাজা নাজিমুদ্দিন। তিনি ১৯৫১ সালের ১৭ অক্টোবর থেকে ১৯৫৩ সালের ১৭ অগস্ট পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর পদে বহাল ছিলেন। তাঁর সময়কালে বাংলা ভাষা আন্দোলন নিয়ে লাহোরে একাধিক সহিংসতার ঘটনা ঘটে। পরিস্থিতি সামলাতে ব্যর্থ হওয়ার কারণ দেখিয়ে তাঁকে গদি ছাড়ার নির্দেশ দেন পাকিস্তানের গর্ভনর জেনারেল মালিক গোলাম। কিন্তু তিনি এই নির্দেশ না মেনে নিতে চাওয়ায় নিজের বিশেষ ক্ষমতা ব্যবহার করে নাজিমুদ্দিনকে ক্ষমতাচ্যূত করেন মালিক। নাজিমুদ্দিন মোট এক বছর ১৮২ দিন ক্ষমতায় ছিলেন।
মোহম্মদ আলি বোগরা
এর পর প্রধানমন্ত্রী হন মোহাম্মদ আলী বোগরা। তিনি ১৯৫৩ সালের ১৭ এপ্রিল থেকে মোট দু’বছর ১১৭ দিন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শাসন করেন। নিয়োগের পরপরই, আঞ্চলিক বৈষম্য নিয়ে তৎকালীন গভর্নর-জেনারেল ইসকান্দার মির্জার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বোগরার সমস্যা শুরু হয়। এর পরই বোগরাকে একপ্রকার ইস্তফা দিতে বাধ্য করেন ইসকান্দার।
চৌধুরী মোহাম্মদ আলী
পাকিস্তানের চতুর্থ প্রধানমন্ত্রী হন চৌধুরী মোহাম্মদ আলী। ১৯৫৫ সাল থেকে শুরু করে মোট এক বছরের কিছু বেশি সময় পাকিস্তানের মসনদে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বহাল ছিলেন আলী। দলবিরোধী কাজকর্মের জন্য তাকে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরানো হয়।
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী
পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। তিনি ১৯৫৬ থেকে শুরু করে এক বছর ৩৫ দিন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তবে গভর্নর জেনারেল ইসকান্দারের চাপের মুখে পড়ে তিনি ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন।
ইব্রাহিম ইসমাইল চুন্দিরগার
পাকিস্তানের ষষ্ঠ প্রধানমন্ত্রী হন ইব্রাহিম ইসমাইল চুন্দিরগার। মাত্র দু’মাস পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন চুন্দিরগার। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনার কথা বলার পর তাঁকেও অনাস্থা ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতা থেকে সরানো হয়।
ফিরোজ খান নুন
এর পর প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পাকিস্তানের শাসনের ভার নেন ফিরোজ খান নুন। তার শাসনকালের সময় ছিল ২৯৫ দিন। খুব কম সময়ে ফিরোজের জনপ্রিয়তা তুঙ্গে পৌঁছায়। ধারণা করা হয়, পাকিস্তানের সম্পূর্ণ ক্ষমতা দখলের ইচ্ছায় ফিরোজ বাধ সাধতে পারেন, এই ভয়ে তাকেও গদিচ্যূত করেন ইসকান্দার।
নুরুল আমিন
অষ্টম পাক প্রধানমন্ত্রী হন নুরুল আমিন। তিনিই পাকিস্তানের ইতিহাসে সব থেকে স্বল্পমেয়াদী প্রধানমন্ত্রী। মাত্র ১৩ দিনের জন্য ক্ষমতায় ছিলেন নুরুল। তবে পাকিস্তানের দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খানের সঙ্গে মনোমালিন্য হওয়ায় তিনি নিজের পদ ছাড়েন। তিনিই পাকিস্তানের প্রথম এবং শেষ ভাইস প্রেসিডেন্ট। তিনি পাকিস্তানের শেষ বাঙালি নেতা হিসেবেও পরিচিত।
নুরুলের পর ক্ষমতায় আসেন পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলি ভুট্টো। ১৯৭৩ সাল থেকে শুরু করে তিনি তিন বছর ৩২৫ দিন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। ১৯৭৭ সালের ৫ জুলাই জেনারেল মোহাম্মদ জিয়াউল হকের নেতৃত্বে সামরিক বাহিনী ভুট্টোকে ক্ষমতাচ্যূত করে। তাঁকে এক মাসের জন্য আটকও করা হয়।
মোহাম্মদ খান জুনেজো
জুলফিকারকে সরিয়ে ক্ষমতায় আনা হয় মোহাম্মদ খান জুনেজোকে। তিনি তিন বছরের কিছু বেশি সময় ক্ষমতায় ছিলেন। তবে তাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অযোগ্য এবং পাকিস্তানের অর্থনৈতিক দুরাবস্থার জন্য দায়ী করে পদ থেকে সরান রাষ্ট্রপতি জিয়া। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে খুনের নির্দেশ দেওয়ার অভিযোগ তুলে ১৯৭৮ সালের ১৮ মার্চ তার ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়। এরপর ১৯৭৯ সালের ৪ এপ্রিল সর্বোচ্চ আদালতের সম্মতিতে কার্যকর হয় তার ফাঁসি।
বেনজির ভুট্টো
পাকিস্তানের একাদশ এবং প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতায় আসেন জুলফিকারের মেয়ে বেনজির ভুট্টো। তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে প্রায় দু’বছর ক্ষমতায় ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর তিনি দাবি করেন, রাষ্ট্রপতি গোলাম ইসহাক খান এবং শক্তিশালী সামরিক বাহিনী-সহ রক্ষণশীল এবং ইসলামপন্থী শক্তি তাঁর নতুন চিন্তাভাবনার প্রচেষ্টা রোধ করছে। বেনজিরের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগ এনে ১৯৯০ সালে ইসহাক তাকে বরখাস্ত করেন।
নওয়াজ শরিফ
১৯৯০ সালে পাকিস্তানের দ্বাদশ প্রধানমন্ত্রী হন নওয়াজ শরিফ। ১৯৯৩ সালে রাষ্ট্রপতি ইসহাক পাক সংসদ ভেঙে দেওয়ার পর তিনি গদিচ্যূত হন এবং বিরোধী নেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।
ত্রয়োদশ এবং চর্তুদশ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আবারও পাকিস্তান শাসনের ভার পান বেনজির এবং নওয়াজ। ১৯৯৬ সাল থেকে বেনজির ৩ বছর ১৭ দিন ক্ষমতায় ছিলেন। কিন্তু দ্বিতীয় বারেও তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতি, হত্যার চক্রান্ত-সহ একাধিক অভিযোগ আনা হয়। রাষ্ট্রপতি ফারুক লেগহারি তাঁর সরকার ভেঙে দেন। নওয়াজের দ্বিতীয় বারের শাসনকাল চলে দু’বছর ২৩৭ দিন। এর পর ১৯৯৯ সালে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর অভ্যুত্থানের ফলে তার শাসনকালের অবসান ঘটে।
বেনজির এবং নওয়াজের পতনের পরে ক্ষমতায় আসেন মির জাফারুল্লাহ খান জামিলি। তবে প্রায় দু’বছরের শাসনকালের পর হঠাৎই নিজের পদ থেকে ইস্তফা দেন তিনি। ইস্তফা দেওয়ার আগে জামিলি প্রায় ৩ ঘণ্টা তৎকালীন সেনাপ্রধান পারভেজ মোশারফের সঙ্গে বৈঠক করেন। তবে পাকিস্তানের বিভিন্ন বিষয়ে মোশারফের মতের সঙ্গে জামিলির মতের মিল না হওয়ায় তাঁকে পদত্যাগের জন্য বাধ্য করা হয় বলেও সংবাদ মাধ্যমগুলি দাবি করে।
পাকিস্তানের ষষ্ঠদশ প্রধানমন্ত্রী হন চৌধুরী সুজাত হোসেন। তাঁর শাসনের সময়কাল ছিল মাত্র ৫৭ দিন। এর পর তিনি নিজেই শওকত আজিজকে নিজের পদ ছেড়ে দেন।
এর পর প্রধানমন্ত্রী মনোনীত হন শওকত আজিজ। মোশারফের ডান হাত হিসেবে পরিচিত ছিলেন শওকত। তিনি তিন বছর ক্ষমতায় থাকার পর নিজে থেকেই সরে যান। তবে শওকতের আমলে পাক অর্থনীতির ব্যাপক উন্নতি হয় বলে মনে করা হয়।
শওকতের পর পাক প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতায় আসেন ইউসুফ রাজা গিলানি। ২০০৮ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত তিনি মোট চার বছর ৮৬ দিন ক্ষমতায় ছিলেন। পাকিস্তানের রাজনৈতিক ইতিহাসে প্রধানমন্ত্রী পদে গিলানিই সব থেকে বেশি দিন বহাল ছিলেন। তবে একাধিক দুর্নীতির মামলায় যুক্ত থাকার অভিযোগে সুপ্রিম কোর্ট তার প্রধানমন্ত্রী পদ খারিজ করেন।
পাকিস্তানের উনিশতম প্রধানমন্ত্রী হন রাজা পারভেজ আশরাফ। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার শাসনের সময়কালও এক বছর পার করেননি। আশরাফ মোট ২৭৫ দিন ক্ষমতায় ছিলেন। তবে ২০১৩ সালে ২৪ মার্চ তিনি তার পদ ছাড়েন। তাকেও একাধিক দুর্নীতির মামলায় যুক্ত থাকার অভিযোগে গ্রেফতারের নির্দেশ দেন দেশটির সুপ্রিম কোর্ট।
এর পর ২০১৩ সালে ফের ক্ষমতায় ফেরেন আগে দু’বার প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসা নওয়াজ। তৃতীয় বারে চার বছর ৫৩ দিনের জন্য ক্ষমতায় ফেরেন তিনি। তবে ২০১৭ সালে পানামা পেপার দুর্নীতিতে যুক্ত থাকার অভিযোগে তাঁকে ক্ষমতাচ্যূত করেন সুপ্রিম কোর্ট। সুপ্রিম কোর্ট ২০১৮ সালে তাঁকে ১০ বছরের জন্য কারাবাসে পাঠানোরও নির্দেশ দেন।
নওয়াজের পর ৩০৩ দিনের জন্য একুশতম প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন শাহিদ খাকান আব্বাসি। তবে ২০১৮ সালে নির্বাচনের মুখে তাকে প্রধানমন্ত্রী পদ ছাড়তে হয়।
২০১৮ সালের নির্বাচনে জিতে প্রধানমন্ত্রীর পদে বসেন ইমরান খান। নির্বাচনে তাঁর জোট সঙ্গী ছিল মুত্তাহিদা কওমি মুভমেন্ট পাকিস্তান (এমকিউএম)। পাকিস্তানের রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার ধারা বজায় রেখে পূর্বসূরিদের মতো ইমরানও মেয়াদ শেষ করতে পারলেন না।