ইরানে ভয়াবহ পানি সঙ্কট, কেন এই হাহাকার?
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ৪ আগস্ট,
বুধবার,২০২১ | আপডেট: ০৪:০৪ পিএম, ২০ ডিসেম্বর,শুক্রবার,২০২৪
ইরানে তীব্র জলাভাব এবং বিদ্যুতের সঙ্কট নিয়ে সম্প্রতি বেশ কিছু অসন্তোষ ও প্রতিবাদ বিক্ষোভের ঘটনা ঘটেছে। এমনকী বিক্ষুব্ধ জনতার ওপর গুলি চালানোর ঘটনাও ঘটেছে গত মাসের শেষ দিকে। একজন বিক্ষোভকারীর গুলিতে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে।
এই সঙ্কটের জেরে সরকারের বিরুদ্ধে অসন্তোষ দানা বেঁধেছে। প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়েছে দেশটির বিভিন্ন শহরে। বিশেষজ্ঞরা ইরানের পানি পরিস্থিতি নিয়ে বহু বছর ধরে উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছিলেন। তাহলে পরিস্থিতি এই উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছল কেন ও কীভাবে?
অতি শুষ্ক বছর
এপ্রিল মাসে ইরানের আবহাওয়া দপ্তর "নজিরবিহীন খরা" সম্পর্কে হুঁশিয়ার করে দেয় এবং জানায় যে দীর্ঘ মেয়াদে গড়পড়তা বৃষ্টিপাতের হারের থেকে বৃষ্টি হয়েছে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কম।
খুজেস্তান প্রদেশ, যেটি তেল উৎপাদনকারী এলাকা, সেখানকার বাসিন্দারা পানির সঙ্কট নিয়ে প্রতিবাদ জানাতে পথে নামে। অন্যান্য শহরগুলোতে বিক্ষোভ হয় জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে তৈরি বিদ্যুতের সরবরাহ হ্রাসের বিরুদ্ধে।
সরকার সবচেয়ে বেশি সঙ্কটে পড়া এলাকাগুলোয় জরুরি সহায়তা পাঠায়। ইরান এখন অতিরিক্ত তাপমাত্রা, দূষণ, বন্যা এবং হ্রদ নিশ্চিহ্ণ হয়ে যাওয়ার মত বিশাল পরিবেশগত চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে। রয়েছে আরও নানা চ্যালেঞ্জ।
১৯৯৪ থেকে ২০২০এর মধ্যে হ্রদের পানি যেভাবে শুকিয়ে গেছে ইরানের জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটের উপাত্ত থেকে দেখা যাচ্ছে, দেশটির প্রধান নদী অববাহিকার বেশিরভাগ অঞ্চলে ২০২০এর সেপ্টেম্বর আর ২০২১এর জুলাইয়ের মধ্যে যে পরিমাণ বৃষ্টিপাত হয়েছে, তা ছিল গত বছর একই সময়ের তুলনায় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কম।
ইরানে বৃষ্টিপাতের ইতিহাস সংক্রান্ত তথ্যউপাত্ত সরকারি সূত্র থেকে বিবিসি পায়নি, তবে যুক্তরাষ্ট্রের গবেষকরা উপগ্রহ চিত্র থেকে বৃষ্টিপাতের উপাত্ত সংগ্রহ করেছেন।
এই তথ্যউপাত্ত থেকে গত ৪০ বছরের গড় বৃষ্টিপাতের হারের বিপরীতে গত মার্চ পর্যন্ত দেশটিতে বৃষ্টিপাতের হারের তুলনা করা হয়েছে - যা তুলে ধরা হয়েছে নিচের গ্রাফে।
যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, আরভিনের সেন্টার ফর হাইড্রোমেটেরিওলজি বিভাগের এই তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে ২০২১ সালের প্রথম তিন মাসে ইরানে বৃষ্টিপাত হয়েছে গড় বৃষ্টিপাতের তুলনায় অনেক কম।
ইরানে ৪০ বছরের গত বৃষ্টিপাতের তুলনায় ২০২০ অক্টোবর থেকে ২০২১এর এপ্রিল পর্যন্ত বৃষ্টিপাতের হার ১৯৮৩ সালের পর জানুয়ারি ছিল সবচেয়ে শুষ্ক মাস মার্চ মাস ছিল সবচেয়ে শুকনো মাসগুলির একটি নভেম্বর মাসে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়েছে, তবে অক্টোবর ছিল গত ৪০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে শুষ্ক মাস
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি বিষয়ক সংস্থার হিসাব অনুযায়ী ইরানে যেসব গমের ক্ষেতের ফলন খুবই মূল্যবান, তার মধ্যে এক তৃতীয়াংশ অনাবৃষ্টিতে সেচের সমস্যায় পড়বে। যার জন্য ইরানে কৃষি কঠিন সমস্যার মুখে পড়তে পারে।
'আমি তৃষ্ণার্ত'
খুজেস্তান প্রদেশে চলছে তীব্র খরা। খরায় বিপর্যস্ত স্থানীয় মানুষ পথে নেমে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছে- অনেকের কণ্ঠে স্লোগান ছিল "আমি তৃষ্ণার্ত!"
এই অঞ্চলে আগে পানির কোন অভাব ছিল না। ওই প্রদেশের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত কারুন নদীতে প্রচুর পানি ছিল। এখন সেই নদী বেশিরভাগ সময়ই শুকনো ।
উপগ্রহ চিত্রে দেখা গেছে, এই নদীর পানি গত বছর ক্রমান্বয়ে কমেছে। জার্মানির স্টুটগার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগৃহীত তথ্য উপাত্তে খুজেস্তানের খরার এই চিত্র দেখা গেছে।
সেখানে নদীপ্রবাহে ২০১৯ সালে একটা স্ফীতি দেখা গিয়েছিল, কিন্তু তার কারণ ছিল ব্যাপক বন্যা। মোমবাতির সামনে দুজন নারী ইরানে জলবিদ্যুত উৎপাদনের সঙ্কট সারা দেশে পানি ও বিদ্যুতের অভাব সৃষ্টি করেছে
খুজেস্তান প্রদেশের এই সরকারি মানচিত্রে দেখা যাচ্ছে ২০২১ সালের জুলাই মাসে এলাকার বাঁধগুলোতে পানির মাত্রা কতটা। হালকা নীল রং-এ আঁকা রেখা পানির মাত্রা কোথায় তা ইঙ্গিত করছে।
বেশির ভাগ গুরুত্বপূর্ণ বাঁধগুলোতে বর্তমানে পানির স্তর খুবই নিচে নেমে গেছে। এই বাঁধগুলোর নিচের এলাকায় ধান চাষ ও গবাদি পশুর জন্য সংরক্ষিত পানি ছেড়ে দেবার জন্য দাবি ক্রমেই বাড়ছে।
পরিস্থিতি ভয়াবহ পর্যায়ে গেল কীভাবে?
কেউ কেউ বলছে এর জন্য দায়ী তেল উৎপাদন শিল্প। তাদের যুক্তি পরিবেশের ভারসাম্য ব্যাহত হয়েছে তেল উৎপাদন শিল্পের জন্য।
অনেকে বলছে বর্তমানের খরা পীড়িত এই এলাকাগুলো থেকে দেশটির মধ্যাঞ্চলে মরু এলাকায় পানি টেনে নেয়ার কারণে এই সমস্যা তৈরি হয়েছে।
"জলবায়ু পরিবর্তন এবং খরা এই পরিস্থিতির প্রধান অনুঘটক,'' বলছেন ইরানের পরিবেশ দপ্তরের সাবেক উপ প্রধান কাভে মাদানি। বর্তমানে তিনি কাজ করেন ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে।
"তবে সমস্যার শিকড় আরও অনেক গভীরে। কয়েক দশক ধরে অপরিকল্পিত পানি ব্যবস্থাপনা, পরিবেশগত বিষয়গুলো নিয়ে পর্যালোচনা ও দূরদৃষ্টির অভাব এবং এরকম একটা পরিস্থিতি যে হতে পারে তার জন্য কোনরকম আগাম প্রস্তুতি না রাখা এখন পরিস্থিতিকে এরকম ভয়াবহ করে তুলেছে," বলছেন মি. মাদানি।
পানি সঙ্কট আরও গুরুতর হয়ে উঠছে
ইরানে পানি সরবরাহের স্বল্পতা ক্রমশই গুরুতর হচ্ছে, যা দেশটির জন্য বড় একটা চ্যালেঞ্জ।
ইরানে প্রায়ই খরা হয় এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এখন দেশটির আবহাওয়ায় চরম পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। আবহাওয়ায় অতিমাত্রায় বদল ঘটছে।
আবহাওয়া এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি উষ্ণ ও শুষ্ক হয়ে ওঠায় জলবিদ্যুৎ শক্তি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ওপর এর বড়ধরনের প্রভাব পড়ছে।
২০১৮-র খরায় শুকিয়ে পুরো চড়া পড়ে গেছে অনেক নদীতে, যেমনটা দেখা যাচ্ছে ইসফাহানের জায়ান্দে রাড নদীতে।
এবছর গ্রীষ্ম মরশুমে ইরানে তীব্র বিদ্যুৎ সঙ্কট দেখা গেছে। অনেক সময় শহরগুলো ঘন্টার পর ঘন্টা বিদ্যুতের অভাবে অন্ধকারে ডুবে থেকেছে।
গত মাসের শুরুতেই তেহরান, শিরাজ এবং ইরানের অন্যান্য শহরে ব্যাপক বিক্ষোভ হয়েছে।
সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে মানুষকে চিৎকার করে বলতে শোনা গেছে "স্বৈরশাসকের মৃত্যু চাই"এবং "খামেইনির মৃত্যু চাই"।
সরকার বিদ্যুৎ ঘাটতির জন্য তীব্র খরা ও উচ্চ চাহিদার দোহাই দিয়ে জনগণের কাছে ক্ষমা চেয়েছে।
সেসময় প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি টেলিভিশনে বলেছেন, খরার কারণে দেশের অধিকাংশ জলবিদ্যুত উৎপাদন কেন্দ্রগুলো কাজ করছে না।
প্রচণ্ড গরম থেকে বাঁচতে এয়ারকন্ডিশনিং-এর ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় বিদ্যুৎ গ্রিডের ওপর বাড়তি চাপ জ্বালানি সরবরাহ ব্যাপকভাবে বিঘ্নিত হয়েছে।