ফিলিস্তিনি তরুণীর বর্ণনায় ইসরাইলি কারাগার
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ১ জুলাই,বৃহস্পতিবার,২০২১ | আপডেট: ০৫:২৯ এএম, ১৯ ডিসেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
মাইস আবু গুশকে হাতকড়া পরিয়ে এক লম্বা করিডর দিয়ে যখন জিজ্ঞাসাবাদের জন্য কারারক্ষীরা নিয়ে যাচ্ছিল, তখন ইসরাইলি গোয়েন্দা দফতরের অধীনে থাকা ওই ভবনে দায়িত্ব পালন করা গোয়েন্দা কর্মকর্তারা তার দুই পাশে দাঁড়িয়ে ব্যঙ্গাত্মকভাবে তালি বাজাতে থাকেন। তুর্কি বার্তা সংস্থা আনাদোলু এজেন্সিকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে মাইস বলেন, 'তারা আমার সাথে উপহাস করছিল, বলছিল জিজ্ঞাসাবাদে আমি মারা যাবো।'
মাইসকে জিজ্ঞাসাবাদে তার মাসিক চলা অবস্থাতেই চেয়ারের মধ্যে তাকে হাত ও গোড়ালি একত্রে বেঁধে কয়েক ঘণ্টা ফেলে রাখা হয়। এর ফলে তার জন্য ঘুমানো অসম্ভব ছিল। তিনি বলেন, 'আমি হাঁটতে পারছিলাম না, কারারক্ষীরা আমাকে তুলে নিয়ে যেতো।' তিনি জানান, বিশ্বের যে কোনো নারীর জন্যই গুরুতর এই অবস্থার মধ্যে প্রয়োজনীয় কোনো স্বাস্থ্য সহায়ক উপাদান তাকে দেয়া হয়নি।
মাইসের হাত শিকল দিয়ে আটকে রাখার কারণে রক্তাক্ত হয়ে গিয়েছিল। পরের দফা সামরিক জিজ্ঞাসাবাদে অংশ নিতে তিনি অস্বীকার করলে দায়িত্বশীল এক ইসরাইলি গোয়েন্দা কর্মকর্তা তাকে ধরে দেয়ালের সাথে ঠুকতে থাকেন।
২৪ বছর বয়সী মাইস আবু গুশ পশ্চিম তীরের রামাল্লার কাছাকাছি কালান্দিয়া শরণার্থী শিবিরের বাসিন্দা। বিরজিত বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম বিভাগের এই শিক্ষার্থীকে ২০১৯ সালের ২৯ আগস্ট নিজ বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে ইসরাইলি বাহিনী। ৩৩ দিন তাকে ইসরাইলি আল-মাসকোবিয়া ইন্টারোগেশন সেন্টারে নির্জন কারাবাসে নির্মম নির্যাতনের শিকার হতে হয়।
বন্দী অবস্থায় তার ওজন ১২ কেজি কমে যায়। তিনি বলেন, 'কর্মকর্তারা আমাকে বারবার বোঝানোর চেষ্টা করে আমি পাগল হয়ে গেছি এবং আত্মহত্যার চেষ্টা করছি। তাই তারা সমাজ কর্মীদের নিয়ে এসেছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তারা ছিল অন্য (গোয়েন্দা) কর্মকর্তা।'
এই কর্মকর্তারা যখন কারাকক্ষে মাইসের সাথে কথা বলে, তিনি তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদের সময় নির্যাতনের ফলে তার শরীরের ক্ষতস্থান ও দাগ দেখান। তাদের কাছে তিনি প্রশ্ন করেন, 'কে অন্য লোককে খুন করতে চায়? আমি একজন শিক্ষার্থী এবং আপনারা আমাকে বন্দী রেখেছেন।'
মাইস তার শরীরে ব্যথা উপশমে পেইনকিলার চেয়েছিলেন, কিন্তু ইসরাইলি কর্মকর্তারা তাকে তা দেয়নি। জিজ্ঞাসাবাদের সময় গোয়েন্দা কর্মকর্তারা অন্য বন্দীদের ওপর শারীরিক নির্যাতনের ফলে তাদের চিৎকার শুনতে মাইসকে বাধ্য করে। তারা হুমকি দেয় তার সাথেও এমন আচরণ করা হবে।
তিনি বলেন, 'তারা আমাকে হুমকি দেয় আমি মৃত বা প্যারালাইজড অবস্থায় এখান থেকে বের হবো। তারা আমাকে ধর্ষণেরও হুমকি দেয়।' মাইসের বিরুদ্ধে অবৈধ ছাত্র আন্দোলনের কার্যক্রমে যোগ দেয়ার অভিযোগে ১৬ মাসের কারাদণ্ড দেয় ইসরাইলি আদালত। গত বছরের ৩০ নভেম্বর তিনি মুক্তি পান।
ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ছাত্র আন্দোলন পরিচালনায় বিরজিত বিশ্ববিদ্যালয় একটি কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। গত ১০ বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ের চার শ' ১৪ শিক্ষার্থীকে ইসরাইল আটক করে বিভিন্ন আইনি হয়রানির শিকার করেছে। মাইস বলেন, ' সারাবিশ্বে ছাত্র আন্দোলনে অংশ গ্রহণ একটি অধিকার আর আমরা এখানে তার জন্য গ্রেফতার ও ইসরাইলি কারাগারে নির্যাতনের শিকার হচ্ছি।'
তিনি বলেন, জিজ্ঞাসাবাদ কেন্দ্রে গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বন্দীদের তাদের ঘরবাড়ি ভেঙ্গে দেয়ার এবং পরিবারের সদস্যদের গ্রেফতার করার হুমকি দিয়ে তাদের ওপর মানসিক চাপ সৃষ্টি করে। ২০১৬ সালে মাইসের বড়ভাইকে ইসরাইলি বাহিনীর হত্যার পর তাদের বাড়ি গুড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। ২০১৯ সালে যখন তাকে গ্রেফতার করা হয়, এক সপ্তাহ পরে তাকে চাপ দেয়ার জন্য তার ছোট ভাইকে আটক করে ইসরাইলি বাহিনী।
তিনি জানান, বন্দী অবস্থায় তিনি চুলে ফিতা বাঁধার অনুমতি পাননি। কেননা ইসরাইলি কর্মকর্তারা নির্যাতনের সময় প্রায়ই তার চুল ধরে টানাহেঁচড়া করতো। মাইস বলেন, 'নাস্তার সময় যে প্লাস্টিক ব্যাগ তারা খাবার দিত, তা ছিঁড়ে আমি চুল বাঁধতাম। কিন্তু তারা আমার কাছ থেকে তাও নিয়ে যায়।'
কয়েক দিন তাকে এমন কক্ষে ফেলে রাখা হয় যেখানে ঘুমের সময় ইদুর এসে তাকে আক্রমণ করেছিল। জিজ্ঞাসাবাদের সময় নির্যাতনের আঘাতের প্রতিক্রিয়ায় এখনো তিনি ভুগছেন।