avertisements 2

গাজা কি বিশ্বনেতাদের তুরুপের তাস?

ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ৫ জানুয়ারী,শুক্রবার,২০২৪ | আপডেট: ০৬:৩২ এএম, ২২ ডিসেম্বর,রবিবার,২০২৪

Text

পৃথিবীর একমাত্র উন্মুক্ত কারাগার মুসলমান অধ্যুষিত গাজা অঞ্চল। ইসরাইল রাষ্ট্র হচ্ছে ইহুদি-খ্রিষ্টান চক্রান্তের ষড়যন্ত্রের ফল। ১৯৪৮ সালে ইসরাইল রাষ্ট্রের জন্মের পর তা বিশ্বের মুসলমান তথা আরববিশ্বের জন্য বিষফোড়া হয়ে দাঁড়ায়।

ইসরাইল রাষ্ট্রের গোড়াপত্তনকে ফিলিস্তিনিরা তাদের জন্য একটি বিপর্যয় মনে করে। যে জায়গাটিতে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়, সেখান থেকে প্রায় সাড়ে সাত লাখ ফিলিস্তিনি পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। সে জায়গায় তারা আর কখনো ফিরে আসতে পারেনি। এ ক্ষোভ বংশানুক্রমে ফিলিস্তিনিদের মাঝে বিরাজ করতে থাকে। তারা মাতৃভূমি উদ্ধারে যুদ্ধের পথ গ্রহণ করে।

ইহুদিদের জন্য ইসরাইল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা আরব দেশগুলো মেনে নিতে পারেনি। সামরিক শক্তিতে দুর্বল আরব জগতে ইসরাইল দিন দিন ফুলেফেঁপে উঠতে থাকে। ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের মিত্রদের যোগসাজশে সামরিক শক্তিতে বলীয়ান হয়ে ওঠে। সমরাস্ত্র, অর্থ, শিল্প, বাণিজ্য সব ক্ষেত্রে চাঙা হতে থাকে।

ইসরাইল জোর করে একের পর এক ফিলিস্তিনি বসতি উচ্ছেদ করতে থাকে। নারী-শিশু-বৃদ্ধ বাদ যায় না তাদের অত্যাচার-নির্যাতন থেকে। যৌন নির্যাতনের শিকার হয় ফিলিস্তিনি নারীরা। চলতে থাকে ভূমি দখল আর ইহুদি গৃহ নির্মাণ। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের ইহুদিরা ইসরাইলে গিয়ে গৃহ নির্মাণ করতে থাকে। ফিলিস্তিনিদের ওপর নির্যাতনের মাত্রা বিশ্বব্যাপী ক্ষোভ ও ঘৃণার জন্ম দেয়। কিন্তু রাবণের চিতা নেভায় কে? এ আগুন ছড়িয়ে পড়ে ফিলিস্তিনজুড়ে। বানরের রুটি ভাগ করার মতো গ্রাস করতে থাকে ফিলিস্তিনকে। প্রথমে ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ, পরে ভূমি দখল-ইহুদি বসতি নির্মাণ।

১৯৬৭ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত আরব-ইসরাইল যুদ্ধ হয়। পশ্চিমা পরাশক্তির সাহায্যে ইসরাইল যুদ্ধে জয়লাভ করে। যুদ্ধে আরব দেশগুলোর সামরিক দুর্বলতা প্রকাশ পায়। ইসরাইল দখল করে নেয় পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রের গাজা উপত্যকা, মিসরের সিনাই মরুভূমি, সিরিয়ার গোলান মালভূমি, জর্ডানের পশ্চিমতীর ও পূর্ব জেরুজালেম। পবিত্র জেরুজালেম ইসরাইলের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আসে। সেখান থেকে তারা বহু ফিলিস্তিনিকে বিতাড়িত করে। এভাবে সম্প্রসারণ হয় ইসরাইল রাষ্ট্রের।

গোলান মালভূমি ছেড়ে দেওয়ার জন্য জাতিসংঘে প্রস্তাব পাশ হলেও বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে দখল করে আছে তারা। আজ ইসরাইল পারমাণবিক শক্তির অধিকারী। এর পেছনে শক্তি জোগাচ্ছে ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্র। তারা গাজায় পারমাণবিক বোমা ফেলতে চায়। পৃথিবীর বুকে আরেকটি হিরোশিমা-নাগাসাকি সৃষ্টি করতে চায়। ইসরাইলের এক মন্ত্রীর এহেন বক্তব্যে পশ্চিমারা ইসরাইলকে কোনো নিষেধাজ্ঞা দেয়নি। তারা ইরানকে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে দমাতে চায়। গণবিধ্বংসী অস্ত্র তৈরির মিথ্যা বুলি ছড়িয়ে দিয়ে ইরাকে হামলা করে সেখানে তাদের পুতুল সরকার বসিয়েছে। এভাবে সিরিয়া-লিবিয়ায় হামলা ও সেখান থেকে খনিজসম্পদ চুরি করছে তারা। বিশ্বের কাছে তাদের ঘৃণ্য চরিত্র উন্মোচিত হয়েছে। এসব যুদ্ধের পেছনে তাদের যে দুরভিসন্ধি লুকিয়ে ছিল তা হলো, অর্থনীতিতে আরব বিশ্বকে দুর্বল ও ইসরাইলকে শক্তিশালী করা, যাতে ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে যে কোনো সংঘাতে আরব লীগ মায়াকান্না ছাড়া অন্য কোনো পদক্ষেপ নিতে না পারে। এছাড়া আরববিশ্ব যাতে ফিলিস্তিন ইস্যু নিয়ে মাথা ঘামাতে না পারে, ইসরাইলকে মেনে নিয়ে তার সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে, এটাও তাদের উদ্দেশ্য। পশ্চিমা চক্রান্তে আরব লিগের কিছু দেশ ইসরাইল রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিয়েছে, কেউ কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেছে, কেউ তাদের সঙ্গে বাণিজ্য, পর্যটন ইত্যাদি ক্ষেত্রে গলা ধরাধরি করে চলছে।

ইসরাইলের সঙ্গে হামাসের কয়েকবার যুদ্ধ হয়েছে। যুদ্ধে হাজার হাজার ফিলিস্তিনি শহিদ হয়েছেন। ইহুদি সৈন্যও মারা গেছে। সর্বশেষ ৭ অক্টোবর হামাসের অতর্কিত হামলা ও ২৪০ জন ইহুদিকে বন্দি করার ঘটনা ইসরাইল ও তার মিত্র দেশগুলোর জন্য চরম অপমান এবং ইসরাইলের সব গোয়েন্দা সংস্থার চরম ব্যর্থতার ফল ছিল। ফলে নেতানিয়াহু সরকার নিজের গদি ঠিক রাখা ও ২৪০ জনকে উদ্ধার করার জন্য হাজার হাজার টন বোমা ফেলে উত্তর গাজাকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে। হাসপাতাল, মসজিদ, গির্জা, শরণার্থী শিবির, আবাসস্থল-সবকিছুকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে। উত্তর গাজার মানুষ ছুটে যায় দক্ষিণ গাজায়। ক্ষুধা, তৃষ্ণায়, বিনা চিকিৎসায় মারা যায় ১৮ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি। কিন্তু তারা একজন বন্দিকেও উদ্ধার করতে পারেনি। বাধ্য হয়ে যুদ্ধবিরতি ও বন্দিবিনিময়ের শর্তে কিছু বন্দিকে মুক্তি করে। এখন ইসরাইল দক্ষিণ গাজায় হামলা শুরু করেছে। সেখানে শহিদ হচ্ছে হাজার হাজার নিরীহ ফিলিস্তিনি। তারা আবার ছুটে চলছে উত্তর গাজায়। বৃষ্টি, শীতে গৃহহারা ফিলিস্তিনিরা যেন শকুনের সামনে জীবন্ত-মৃত প্রাণী। আজ আরব বিশ্ব, মুসলিম বিশ্ব সেই শকুনের ভক্ষণ ও থাবা নির্বাক চোখে দেখছে।

ইরান মধ্যপ্রাচ্যে নিজের সামরিক শক্তি, কূটনৈতিক মতাদর্শ প্রচারে সরাসরি ইয়েমেনের হুতি, লেবাননের হেজবুল্লাহ, গাজার হামাস, ইরাক ও সিরিয়ার শিয়া মতাদর্শের সংগঠনকে সমর্থন ও সামরিক সহযোগিতা করে থাকে। ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের বৈরিতা দীর্ঘদিনের। কয়েক হাজার নিষেধাজ্ঞায় ইরান জর্জিত। এ সুযোগে রাশিয়া ও চীন ইরানের পাশে দাঁড়ায়। এ দুটি দেশ বাণিজ্য-সামরিকসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ইরানকে সাহায্য করতে থাকে। যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা এটাকে ভালো চোখে গ্রহণ করেনি। ধীরে ধীরে ইরান শক্তি অর্জন করে চলেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলকে বন্দুকের নিশানা বানায়।

বিশ্ব রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের বৈশ্বিক ক্ষতি মোকাবিলায় যখন ব্যবসা-বাণিজ্যে হিমশিম খাচ্ছে, আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম রাশিয়া-ইউক্রেনের জয়-পরাজয়ের হিসাব মেলাতে ব্যস্ত, ঠিক তখনই হামাস ইসরাইলে হামলা করে। বিশ্বের সবার দৃষ্টি ফিরে যায় গাজার দিকে। পত্রিকা খুললেই নিরীহ ফিলিস্তিনির আর্তনাদের খবর পড়তে হয়। ইউক্রেন যুদ্ধের খবর চাপা পড়ে যায়। ইউক্রেনে রাশিয়া সফলতার ছবি দেখতে থাকে। ইউক্রেন যুদ্ধের সময় হামাসের ইসরাইলে হামলা দাবার চালের খেলার মতোই মনে হয়। যে খেলায় রাজা, মন্ত্রী, হাতি, ঘোড়া, কিস্তি ও সৈন্য সবাই জড়িত। আর গাজাবাসী সেখানে ‘তুরুপের তাস’ হয়ে যুদ্ধ লিপ্ত এবং ‘বলির পাঁঠা’য় পরিণত।

ইসরাইল আধুনিক সামরিক শক্তির অধিকারী। একটা ক্ষুদ্র শক্তি হামাস কেনইবা ইসরাইলে হামলা করতে গেল? উত্তর গাজার মতো দক্ষিণ গাজাকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে ইসরাইল তা দখল করে নিলে ফিলিস্তিনিদের কী হবে? রাশিয়া ইউক্রেনের ভূমি দখল করে নিজের ভূমি হিসাবে আইন পাশ করেছে। ইসরাইল এ রকম করবে না, তার নিশ্চয়তা কে দেবে? নেতানিয়াহু লেবাননের হিজবুল্লাহকে হুমকি দিয়ে বলেছে, গাজার মতো অবস্থা লেবাননেরও হবে। এ ধরনের হুমকি কি ইসরাইলি রাষ্ট্র সম্প্রসারণের ইঙ্গিত?

আরব শাসকরা যুদ্ধ বন্ধে কিছুই করতে পারছেন না। জাতিসংঘে যুদ্ধ বন্ধের প্রস্তাব অধিক ভোটে পাশ হলেও যুক্তরাষ্ট্রের ভেটোতে তা পাশ হচ্ছে না। জাতিসংঘপ্রধান গুতেরেস ৯৯ ধারা প্রয়োগ করেও ব্যর্থ হয়েছেন। নেতানিয়াহুর অভিযান থামায় কে? তার নৃশংসতা চলছেই। শকুনের দৃষ্টি সব গাজায় নিমজ্জিত। এ শকুন গাজাকে খাবে, না ছাড়বে, তা সময়ে বলে দেবে।

ইহুদিবাদীদের ঘৃণ্য চরিত্র ইতিহাসখ্যাত। তারা রাষ্ট্র গঠন করে, রাজ্য বিস্তার করে, শাসন করে। আবার তাদের পরাজয় হয়। তাদের চাকচিক্য সাময়িক দৃষ্টি আকর্ষণ করে। আবার সময়ের ঘূর্ণিপাকে বিলীন হয়ে যায়। মুসলিম বিশ্বের কয়েকটি দেশ সামরিক শক্তিতে এগিয়ে আছে। তারা পরাশক্তিদের সমকক্ষ হতে চায়। এক্ষেত্রে মুসলিম বিজ্ঞানীরা যথেষ্ট অবদান রাখছেন। শিয়া-সুন্নির বিভেদ ভুলে একদিন হয়তো তাদের মধ্য থেকে কেউ ইসরাইল জয় করবে। তারা বিশ্বনেতাদের ‘তুরুপের তাস’ হয়ে জীবনযাপন করবে না। তারা একেকজন সালাউদ্দীন আইয়ুবী হয়ে ইতিহাসে নাম লেখাবে।

বিষয়:

আরও পড়ুন

avertisements 2