avertisements 2

তবে কি ভয়াবহ খাদ্য সংকটে পড়তে যাচ্ছে বিশ্ব

ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ৩ আগস্ট,বৃহস্পতিবার,২০২৩ | আপডেট: ০৪:৩০ এএম, ১৫ ডিসেম্বর,রবিবার,২০২৪

Text

বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ কি অদূর ভবিষ্যতে ভয়াবহ খাদ্য সংকটে পড়তে যাচ্ছে? বেশ কিছুদিন ধরে বিষয়টি নিয়ে বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে জোর আলোচনা চলছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে খাদ্যশস্য রপ্তানি ব্যাহত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে বৈশ্বিক খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে আন্তর্জাতিক সংস্থাসহ বিশ্বনেতারা। ২০২২ সালের জুলাইয়ে যুদ্ধরত দুই দেশ কৃষ্ণসাগরের মধ্য দিয়ে শস্য রপ্তানি নির্বিঘ্নে চুক্তি স্বাক্ষর করে। কিন্তু রাশিয়া ওই শস্যচুক্তি নবায়ন থেকে সরে এসেছে। এদিকে এল নিনোর প্রভাবে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে খাদ্য উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়। এরই মধ্যে চাল রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে ভারত, যার প্রভাবে বিশ্বব্যাপী ভয়াবহ খাদ্য সংকট দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা বিশ্লেষকদের।

বিশ্বের শীর্ষ চাল রপ্তানিকারী দেশ ভারত। বিশ্বের মোট চাহিদার ৪০ ভাগই আসে এ দেশ থেকে। দেশটির রপ্তানি করা মোট চালের ২৫ শতাংশই বাসমতি ব্যতীত অন্য চাল। চাল রপ্তানির শীর্ষে থাকা অন্য দেশগুলো হলোÑ থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, পাকিস্তান এবং যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু অভ্যন্তরীণ বাজার স্থিতিশীল রাখতে জুলাইয়ের ২০ তারিখে বাসমতি ব্যতীত অন্য সব চাল রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দেয় ভারত।

আইএমএফের প্রধান অর্থনীতিবিদ পিয়ে-অলিভার গোরিনচাস সম্প্রতি সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, এই নিষেধাজ্ঞা চালের দাম বাড়িয়ে দেবে এবং বিশ্বব্যাপী শস্যের দাম ১৫ শতাংশের বেশি বাড়তে পারে। কোনো দেশ এর পাল্টা কোনো ব্যবস্থাও নিতে পারে।

চলতি বছরের বর্ষায় ভারতের রাজ্যগুলোতে বৃষ্টিপাতের ভারসাম্যে ব্যাপক অবনতি হয়েছে। জুনের শুরু থেকে এ পর্যন্ত দেশটির উত্তরাঞ্চলীয় ও কেন্দ্রীয় রাজ্যগুলোতে অতিমাত্রায় বর্ষণ ঘটলেও পূর্ব, উত্তরপূর্ব ও দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে বৃষ্টিপাত হয়েছে প্রয়োজনের তুলনায় বেশ কম।

ফলে বিগত অন্যান্য বছরের তুলনায় চলতি বছর ভারতে উৎপাদিত চালের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে হ্রাস পাবে বলে সতর্কবার্তা দেন ভারতের কৃষি বিজ্ঞানীরা। এর পরই সরকার এই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।

এদিকে ভারতের এ ঘোষণার পরেই আরেক রপ্তানিকারী দেশ ভিয়েতনামের বাজারেও চালের দাম বেড়ে যায়। তবে দেশটি রপ্তানিতে কোনো নিষেধাজ্ঞা দেবে না বলে জানিয়েছে ভিয়েতনামের শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। দেশটিতে বর্তমানে গ্রীষ্ম-শরৎকালীন ফসল কাটার মৌসুম চলছে। দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার এই দেশটি ভারত ও থাইল্যান্ডের পর বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম চাল রপ্তানিকারক।

অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাতও আগামী চার মাসের জন্য চাল রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপের ঘোষণা দিয়েছে। দেশটি ভারত থেকে আমদানি করা চালের পুনরায় রপ্তানিও নিষিদ্ধ করবে বলে জানায়। এছাড়া রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে কাখোকভা বাঁধ ধসে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয় গত জুনে। এতে কৃষির ওপর পড়েছে নেতিবাচক প্রভাব। ইউক্রেনকে বিশ্বের ‘রুটির ঝুড়ি’ বলা হয়। দেশটির ৬৪ শতাংশ গম আফ্রিকার অনেক দেশসহ উন্নয়নশীল দেশে রপ্তানি করা হয়। দেশটির কৃষিনীতি ও খাদ্য মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে জানা যায়, খেরসন অঞ্চলের ডান তীরে আনুমানিক ১০ হাজার হেক্টর কৃষিজমি পানির নিচে তলিয়ে গেছে। বাম পাশে রাশিয়ার অধিকৃত অংশে আরও বেশি জমি প্লাবিত হয়েছে। বাঁধ ধসে পড়ার পর খেরসনের ৯৪ শতাংশ, জাপোরিঝিয়ার ৭৪ শতাংশ ও নিপ্রোপেত্রোভস্ক অঞ্চলের ৩০ শতাংশ জমিতে সেচ দেওয়ার মতো পানি নেই। আগামী বছরের শুরুতে ক্ষতিগ্রস্ত ওই কৃষিজমি মরুভূমিতে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা আছে। জমিতে লবণাক্ততার ক্রমবর্ধমান বৃদ্ধির কারণে আবাদি জমি সামনের বছরগুলোতে কৃষিকাজের জন্য অনুপযুক্ত হয়ে পড়তে পারে। ইউক্রেনের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় নিপ্রো নদীর আশপাশের এলাকাজুড়ে গম ও ভুট্টা উৎপাদন হয়। এসব উৎপাদন কাখোভকা বাঁধ ধসের কারণে ব্যাহত হতে বাধ্য।

যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ইউক্রেনের আট শতাংশ সয়াবিন খেরসনে উৎপন্ন হয়। পাশাপাশি বার্লি ও সানফ্লাওয়ারও ওই অঞ্চলে উৎপাদন করা হয়। কাখোকভা বাঁধ ধসে শস্য উৎপাদন বাধাগ্রস্ত করবে, যা বিশ্বে খাদ্য সংকটকে ত্বরান্বিত করবে।

বুধবার ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি’র এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের অতি প্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্য চাল রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে ভারত। নন-বাসমতি সাদা চাল রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দেয় ভারত। মূলত অভ্যন্তরীণ বাজারে চালের দাম স্থিতিশীল রাখতে এমন উদ্যোগ নিয়েছে দেশটি। এর প্রভাবে যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডায় ভারতীয় চালের সংকট দেখা দেয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যায়, মানুষ আতঙ্কিত হয়ে চাল কিনছেন। যার প্রভাবে বেড়ে গেছে এ পণ্যের দামও।

বিশ্বব্যাপী কয়েক হাজার জাতের চাল উৎপাদন হয়। তবে আমদানি-রপ্তানি হয় মূলত চার জাতের চাল। এর মধ্যে সরু লম্বা দানার ইন্ডিকা চাল সবচেয়ে বেশি বেচাকেনা হয়। আর বাকিগুলো হলো সুগন্ধি বাসমতি, ছোট দানার জাপোনিকা; যেটি সুসি এবং রিসোটস তৈরিতে ব্যবহৃত হয় এবং আঠালো চাল; যা মিষ্টি তৈরিতে ব্যবহার করা হয়।

চাল আমদানিকারক দেশের মধ্যে শীর্ষে রয়েছে চীন, ফিলিপাইন এবং নাইজেরিয়া। এছাড়া অভ্যন্তরীণ বাজারে ঘাটতি দেখা দিলে ইন্দোনেশিয়া এবং বাংলাদেশ চাল আমদানি করে। এখন আফ্রিকা মহাদেশেও চালের চাহিদা বাড়ছে। এছাড়া কিউবা এবং পানামাতেও শক্তির মূল উৎস হলো চাল।

২০২২ সালে ভারত ১৪০টি দেশে ২২ মিলিয়ন টন চাল রপ্তানি করেছে। যার মধ্যে ৬ মিলিয়ন টন ছিল তুলনামূলক কম দামি ইন্ডিকা চাল (গত বছর বিশ্বব্যাপী চাল আমদানি-রপ্তানি হয়েছে প্রায় ৫৬ মিলিয়ন টন)। এর ৭০ শতাংশ ছিল ইন্ডিকা চাল, আর এখন ভারত সেই চাল রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছে। গত বছর দেশটি খুদের চাল এবং বাসমতি চাল রপ্তানির ওপর ২০ শতাংশ কর আরোপ করে। এরপরই এলো পুরোপুরি নিষেধাজ্ঞা। বিবিসি বলছে, প্রত্যাশিতভাবেই জুলাইয়ে ভারতের চাল রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা বিশ্বব্যাপী আতঙ্ক সৃষ্টি করে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) বাজার বিশ্লেষক সিরলে মুস্তাফা বলেছেন, ভারত এমন সময় চালের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যখন ‘সময়টা ভালো নয়।’

প্রথমত, ২০২২ সালের শুরু থেকেই চালের দাম বাড়ছে। গত জুন থেকে এখন পর্যন্ত যা ১৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। দ্বিতীয়ত, চালের সরবরাহে এখন বিঘ্ন দেখা যাচ্ছে, বাজারে নতুন চাল আসতে আরও তিন মাস বাকি আছে। দক্ষিণ এশিয়ায় অস্বাভাবিক আবহাওয়া- ভারতে অধিক বৃষ্টি ও পাকিস্তানে বন্যা চাল সরবরাহে বিঘ্ন ঘটিয়েছে। এছাড়া সারের মূল্য বৃদ্ধির কারণে চালের মূল্যও বেড়েছে।

অন্যদিকে যেসব দেশ চাল আমদানি করে তাদের মুদ্রার মান কমে যাওয়ায় আমদানি বেড়ে গেছে। মুদ্রাস্ফীতির কারণে এ ব্যবসার ব্যয়ও বেড়েছে। জাতিসংঘের বাজার বিশ্লেষক মুস্তফা বলেছেন, ‘আমরা এমন পরিস্থিতিতে আছি যেখানে আমদানিকারকরা বাধার মধ্যে পড়েছেন। এসব আমদানিকারক মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নিতে পারবেন কিনা এখন এটিই দেখার বিষয়।’

ভারতের নিজস্ব মজুতকৃত ৪১ মিলিয়ন টন চাল রয়েছে। যা প্রয়োজনের তুলনায় প্রায় ৩ গুণ। এসব চাল দেশটির ৭০ কোটি মানুষকে কম দামে দেওয়া হয়। গত বছর ভারত বড় ধরনের মূল্যস্ফীতির মধ্যে দিয়ে গেছে। গত অক্টোবর থেকে দেশের বাজারে চালের দাম বেড়েছে ৩০ শতাংশ। যা নির্বাচনের আগে দেশটির সরকারের ওপর তৈরি করেছে বাড়তি চাপ। ভারতের কৃষিনীতির বিশেষজ্ঞ দ্বেবিন্দর শর্মা বলেছেন, এল নিনোসহ অস্বাভাবিক আবহাওয়ার কারণে চালের উৎপাদনে ঘাটতি দেখা দিতে পারে। আর এ কারণে সরকার আগে থেকেই এ ব্যাপারে প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে চাইছে। তবে অনেকে মনে করেন ভারতের চাল রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া উচিত নয়। কারণ এই নিষেধাজ্ঞা বিশ্ব খাদ্য নিরাপত্তার জন্য ক্ষতিকর।

খাদ্য বিষয়ক সংস্থা ইফরি জানিয়েছে, বিশ্বের ৪২টি দেশ তাদের মোট আমদানির অর্ধেক চালই আনে ভারত থেকে। আফ্রিকার কিছু দেশ রয়েছে যেগুলো মোট আমদানির ৮০ শতাংশ যায় এশিয়ার এ দেশ থেকে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্বে খাদ্যপণ্যের ওপর নিষেধাজ্ঞা নতুন নয়। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বাধার পর ইন্দোনেশিয়া পাম ওয়েল, আর্জেন্টিনা মাংস, তুরস্ক শস্য রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দেয়। কিন্তু ভারতের চাল রপ্তানির বিষয়টি অন্য। এর বড় প্রভাব পড়বে বিশ্বে। কারণ তাদের রপ্তানির ওপর নির্ভরশীল অনেক দেশ।

বিশ্লেষকরা বলেছেন, ‘এই হঠাৎ নিষেধাজ্ঞা খাদ্য নিশ্চয়তাকে তো শঙ্কায় ফেলবেই, সঙ্গে বিশ্বে ভারতেরও সুনাম ক্ষুণ্ন হবে। কারণ বিশ্বে তখন ‘ভারতকে আর নির্ভরযোগ্য চাল রপ্তানিকারক হিসেবে বিবেচনা করবে না।’

বিষয়:

আরও পড়ুন

avertisements 2