avertisements 2

মুরগির বাচ্চা নিয়ে এবার কর্পোরেট খেলা

ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ২০ সেপ্টেম্বর, বুধবার,২০২৩ | আপডেট: ০৯:২৯ এএম, ৪ মে,শনিবার,২০২৪

Text

ডিমের পর এবার মুরগির বাচ্চা নিয়েও ব্যবসায়িক কারসাজির অভিযোগ উঠেছে বাংলাদেশের কর্পোরেট কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে। খামারিদের অভিযোগ কোম্পানিগুলো এক দিন বয়সি মুরগির বাচ্চার দাম ধাপে ধাপে প্রায় দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। এতে অচিরেই দেশের ব্রয়লার মুরগি আর ডিমের দাম আবারও বেড়ে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

গত আগস্ট মাসের মাঝামাঝি যে মুরগির বাচ্চার দাম ছিল ২৭ থেকে ৩৫ টাকার মধ্যে সেই মুরগির বাচ্চা এখন বিক্রি হচ্ছে ৪২ থেকে ৫২ টাকায়। এর কারণ হিসেবে কোম্পানিগুলো আগের ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার কথা বললেও একে কোম্পানিগুলোর পরিকল্পিত সিন্ডিকেট কারসাজি বলে দাবি করছেন খামারিরা।

মুরগির দাম বাড়েনি
প্যারাগন হ্যাচারি লিমিটেডের পক্ষ থেকে প্রান্তিক খামারিদের পাঠানো ক্ষুদে বার্তা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, গত ২০ আগস্ট প্রতিটি ব্রয়লার মুরগির বাচ্চার বিক্রয়মূল্য ছিল গ্রেড ভেদে ২৭ থেকে ৩৫ টাকা। লেয়ার বাচ্চার দাম ধরা হয়েছিল ৫৬ থেকে ৫৮ টাকায়। কক বাচ্চার দাম ছিল ১৩ থেকে ১৪ টাকা। প্যারাগন কালার ও সোনালি মুরগির বাচ্চা বিক্রি হয়েছে যথাক্রমে ৪৫ ও ২৩ টাকায়।

অথচ ১৮ সেপ্টেম্বর প্যারাগনের এক দিন বয়সি ব্রয়লার বাচ্চার বিক্রয়মূল্য বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৪ থেকে ৫২ টাকায়। লেয়ার বাচ্চা ও কক বাচ্চা বিক্রি হয়েছে যথাক্রমে ৬৬ ও ২২ টাকা এবং কালার মুরগির বাচ্চার দাম ধরা হয়েছে ৫৬ টাকা। মুরগির বাচ্চার দাম বাড়লেও খামার পর্যায়ে ব্রয়লার মুরগির দাম আগের মতোই আছে। এতে লাভ তো দূরের কথা বরং লোকসানের আশঙ্কায় আছেন প্রান্তিক খামারিরা।

নরসিংদীর খামারি অলি উল্লাহ বলেন, “গত মাসে মুরগির বাচ্চার কিনেছি ৩৬ টাকায়। তখন বাজারে রেডি ব্রয়লার মুরগির কেজি ছিল ১৩৮ থেকে ১৪০ টাকা। এখন বাচ্চার দাম ৫২ টাকা হয়ে গিয়েছে। বাড়তি দাম দিয়ে বাচ্চা কিনলেও বাজারে মুরগির দাম আগের মতোই। এভাবে লাভ করার তো অবস্থা নাই। খামারই চালাতে পারব না।”

সাধারণত একটি ব্রয়লার বাচ্চা মুরগির পরিণত হতে বা দেড় কেজির মতো ওজনে আসতে ৩০ থেকে ৩২ দিনের মতো সময় লাগে। তাতে মুরগির বাচ্চা, ফিডসহ যাবতীয় খরচ মিলিয়ে ১৫৫ টাকা ছাড়িয়ে যায় বলে খামারিরা জানিয়েছেন।

কর্পোরেট কারসাজিতে মুরগির বাচ্চা

আগস্টে খাদ্য খাতে রেকর্ড ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশ মূল্যস্ফীতি হয়েছে। এর জন্য মুরগি ও ডিমের দামকে দায়ী করেছেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান। আর মুরগি ও ডিমের দাম বাড়ার পেছনে খামারিরা অভিযোগের তীর ছুড়ছে সংশ্লিষ্ট কর্পোরেট কোম্পানিগুলোর দিকে।

আগে বাংলাদেশের কর্পোরেট গ্রুপগুলো শুধুমাত্র ফিড ও বাচ্চা উৎপাদন করত। তখন বাজারে স্থিতিশীলতা ছিল বলে দাবি করেছেন খামারিরা। কিন্তু ২০২০ সালের করোনা মহামারির পর থেকে কর্পোরেট গ্রুপগুলো ডিম-মুরগি উৎপাদন শুরু করে। এরপর থেকেই ইচ্ছামতো মুরগির ফিড নাহলে বাচ্চার দাম বাড়িয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণে চেষ্টা করছে বলে খামারিরা জানাচ্ছেন।

সাম্প্রতিক সময়ে মুরগির বাচ্চার দাম বাড়িয়ে এই কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো দিনে সাড়ে ছয় কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (বিপিএ) সভাপতি মো. সুমন হাওলাদার।

তিনি জানান, বাংলাদেশে প্রতিদিন ২৪ লাখ ব্রয়লার মুরগির বাচ্চা এবং দুই লাখ লেয়ার বাচ্চা উৎপাদিত হয়। সব মিলিয়ে হয় মোট ২৬ লাখ।

তিনি বলেন, সে হিসাবে একটি বাচ্চায় যদি গড়ে ২৫ টাকার বেশি নিলে দেখা যাচ্ছে, কর্পোরেট গ্রুপগুলো সিন্ডিকেট করে প্রতিদিন ৬ কোটি ৫০ লাখ টাকার বেশি হাতিয়ে নিচ্ছে।
বাজারে কেমন প্রভাব পড়তে যাচ্ছে

বাংলাদেশের বাজার পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে মুরগির বাচ্চার দাম নির্ধারণ করে থাকে বাংলাদেশ ব্রিডার্স অ্যাসোসিয়েশন। এই সংস্থার আওতায় থাকা শতাধিক কোম্পানি মুরগির বাচ্চা উৎপাদন করে থাকে। কিন্তু এর মধ্যে কাজি ফার্মস, আফতাব, প্যারাগন, নারিশসহ হাতে গোনা কয়েকটি কোম্পানি মুরগি, ডিম ও ফিডসহ পোল্ট্রি শিল্পের পুরো বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে বলে অভিযোগ খামারিদের।

মুরগির বাচ্চার দাম বাড়ার এই প্রভাব খুব শিগগিরই বাজারের ওপর পড়তে যাচ্ছে বলে আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. রিপন কুমার মণ্ডল। তার মতে, ‘ব্রয়লার মুরগি ২৮ থেকে ৩৫ দিনের মধ্যে পরিণত হয় তাই মুরগির বাচ্চার দাম বাড়ার এই ওপর প্রভাব সামনের এক দেড় মাসের মধ্যেই মুরগির বাজারে দেখা যাবে।’

‘অন্যদিকে ডিমের ক্ষেত্রে চার মাসের মধ্যেই প্রভাব পড়বে। কিন্তু বাংলাদেশের বাজার ব্যবস্থার যে প্রবণতা, একবার দাম বাড়ানোর কথা উঠলে সাথে সাথে বিদ্যমান পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়া হয়।’

এই অবস্থায় সরকারের কঠোর নজরদারির মাধ্যমে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা খুব জরুরি বলে তিনি জানিয়েছেন। না হলে এক থেকে ছয় মাসের মধ্যে বাজার আবার অস্থিতিশীল হয়ে পড়বে বলে তিনি আশঙ্কা করছেন। এদিকে মুরগির বাচ্চার দাম বাড়লে সেটার প্রভাব মুরগি ও ডিম দুটার ওপরেই পড়বে বলে জানিয়েছেন মি. মণ্ডল।

তার মতে, ‘মুরগির বাচ্চার দাম বেড়ে গেলে অনেক প্রান্তিক খামারি বাচ্চা কিনতে চাইবে না, উৎপাদন থেকে সরে আসবে। এতে চাহিদা অনুযায়ী মাংস ও ডিমের উৎপাদন কমে যাবে। ফলে দাম আবার বেড়ে যাবে।’ বাংলাদেশ পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যমতে, বাংলাদেশে প্রতিদিন মুরগির চাহিদা সাড়ে চার হাজার টনের মতো হলেও বাংলাদেশে উৎপাদন হয় দৈনিক পাঁচ হাজার ২শ’ টন মুরগি।

যার কারণে বাজার স্থিতিশীল থাকে। কিন্তু এই উৎপাদন পাঁচশ টন কমে গেলেই মুরগির দাম অনেকটা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হবে।

কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের দাবি এদিকে কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর দাবি বিগত সময়কার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে এবারে মুরগির বাচ্চার দাম বাড়ানো হয়েছে।

প্যারাগন কোম্পানির বিপণন বিভাগের কর্মকর্তা এস এম হেলালুদ্দিন রাজু জানান, ব্রিডার্স অ্যাসোসিয়েশন বাজার পরিস্থিতি, বাজারে মুরগির বাচ্চার চাহিদা আর যোগান, উৎপাদন খরচ সবকিছু বিবেচনা করে বাচ্চার দাম নির্ধারণ করে দেয়।

কিন্তু গত বছর থেকে চলতি বছরের শুরুতে চাহিদা অনেক কমে যাওয়ায় মুরগির বাচ্চার দামে এর বিরূপ প্রভাব পড়ে। জনাব রাজু বলেন, ‘গত বছরের নভেম্বর থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাজারে মুরগির বাচ্চার চাহিদা না থাকায় এই ব্রিডার প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যাপক লোকসান গুনতে হয়েছিল। একটা বাচ্চা উৎপাদনে খরচ আছে ৩৫ টাকা।’

তিনি বলেন, কিন্তু বাজারে চাহিদা না থাকায় ৭ থেকে ১৫ টাকায় বাচ্চা দিতে হয়েছে। তখন কোম্পানিকে প্রতিটা বাচ্চা বাবদ ২০ থেকে ২৮ টাকা ভর্তুকি দিতে হয়েছে। আমরা এবার সেই লোকসান কিছুটা পুষিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছি। বাংলাদেশে মুরগির বাজারে অস্থিরতার পেছনে এ সংক্রান্ত কোনো বিধিমালা না থাকাকে দায়ী করেছেন কৃষি অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. রিপন কুমার মণ্ডল।

তিনি বলেন, গুটিকয়েক কর্পোরেট হ্যাচারি এই মুরগির বাচ্চাগুলো উৎপাদন করে থাকে। এই হ্যাচারিগুলো কীভাবে চলবে, এখানে মুরগির বাচ্চার মান কেমন হবে, কী দামে বিক্রি হবে, কোথায় বিক্রি হবে তার কোনো বিধিমালা এতদিন ছিল না। সম্প্রতি এ নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে বলে তিনি জানান।

অবৈধভাবে লাভ করার অভিযোগ নিত্যপণ্যের দাম যেন কেউ লাগামহীনভাবে বাড়াতে না পারে সেজন্য ২০২১ সালের নভেম্বরে কৃষি মন্ত্রণালয় বিধিমালা করে কৃষিপণ্যে লাভের সর্বোচ্চ সীমা বেঁধে দেয়।

মুরগি ও ডিমের বাজারদরও এই বিধিমালার অন্তর্ভুক্ত।

এই কৃষি বিপণন বিধিমালা অনুযায়ী, নির্ধারিত হারের থেকে বেশি লাভে এসব পণ্য বিক্রি করলে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে জেল-জরিমানা করা হবে।

এজন্য উৎপাদক পর্যায়ে ৩০ শতাংশ, পাইকারিতে ১৫ শতাংশ ও খুচরায় সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ হারে মুনাফা বেঁধে দেয়া হয়েছে।
কৃষি উপকরণ ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করলে বা সরকার-নির্ধারিত হারের বেশি মুনাফা করলে সর্বোচ্চ এক বছরের কারাদণ্ড বা ১ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে কৃষি বিপণন আইনে।

দ্বিতীয়বার একই অপরাধ করলে সাজা হবে দ্বিগুণ। বিধিমালায় উৎপাদকের সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ লাভ করার কথা থাকলেও মুরগির বাচ্চার ক্ষেত্রে কর্পোরেট গ্রুপগুলো প্রায় একশ’ শতাংশ লাভ করছে বলে অভিযোগ করেছেন খামারিরা।

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট সুমন হাওলাদার বলেন, ‘একটি মুরগির বাচ্চা উৎপাদনের সর্বোচ্চ খরচ ২৮ থেকে ৩০ টাকা। কিন্তু তারা দাম রাখছে প্রায় দ্বিগুণ। শতভাগ লাভ। যে লাভের কিছু অংশ প্রান্তিক খামারির করার কথা ছিল, সেই মুনাফা কোম্পানিগুলো আগেই তুলে নিচ্ছে।’

সরকারকে এ বিষয়ে তদারকি করার তাগিদ দেন তিনি।

এক্ষেত্রে মুরগির খাদ্য, বাচ্চা, ওষুধ সব একই কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে না দিয়ে ভাগ ভাগ করে দেয়ার পরামর্শ দিয়েছে বাংলাদেশ পোল্ট্রি এসোসিয়েশন।

প্রতিষ্ঠানটির মতে, একই প্রতিষ্ঠান পোল্ট্রির সব উপাদানের নিয়ন্ত্রণে থাকলে তাদের নিজেদের ইচ্ছামতো দাম বাড়িয়ে দেয়ার সুযোগ থাকে।
এ নিয়ে সুমন হাওলাদার বলেন, ‘একই বাজারে দুই রকম দামে বাচ্চা বিক্রি হচ্ছে। মুরগির বাচ্চার দাম বেশি হলে প্রান্তিক খামারিরা আর মুরগি কিনবে না, উৎপাদন করবে না। তখন মুরগির দাম বেড়ে যাবে। এভাবে ধীরে ধীরে মুরগির বাজার কর্পোরেট কোম্পানি তাদের হাতে নিয়ে নেবে। ভোক্তাদের জিম্মি করবে।’

তার অভিযোগ সরকার শুধু খুচরা বাজারে অভিযান চালাচ্ছে। কিন্তু মূল সমস্যা তো উৎপাদন পর্যায়ে, সেখানে তো সরকার কিছু করছে না। বাংলাদেশে মুরগির বাচ্চা আমদানির অনুমতি আছে। সরকার মুরগির বাচ্চা আমদানির সিদ্ধান্ত নিলে বাজারের অস্থিরতা কাটানো সম্ভব বলে তিনি জানান।

এক্ষেত্রে মুরগি ও ডিমের উৎপাদন খরচ নিয়ন্ত্রণে রাখতে স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হাতে নেওয়ার কথা জানিয়েছেন প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের পরিচালক মো. রেজাউল হক।

তিনি বলেন, ‘স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনার মধ্যে আছে কেউ যেন বাচ্চার উৎপাদন একচেটিয়া বেশি করতে না পারে আবার কম উৎপাদন করে কৃত্রিম সংকট তৈরি করতে না পারে সেজন্য ব্যবস্থা নেওয়া। আর দীর্ঘমেয়াদে মুরগি উৎপাদনের পুরো ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা আছে।’

তিনি জানান, কেউ যেন অযাচিত মুনাফা করতে না পারে, আমরা সেটা খতিয়ে দেখবো। এজন্য আমরা ব্যবসায়ীদের সাথে আলোচনা করছি। একে সাময়িক সমস্যা উল্লেখ করে তিনি বলেন, দ্রুত এই সমস্যা কেটে যাবে।

জনাব হকের মতে, পোল্টি ব্যবসা কিছু ঝুঁকিপূর্ণ। এখানে চাহিদা অনেক ওঠানামা করে। সে অনুযায়ী উৎপাদন হঠাৎ বাড়ানো কমানো যায় না। এমন অবস্থায় সব পক্ষের স্বার্থ রক্ষা করে সমাধানের পথে হাঁটার কথা জানান তিনি।

বিষয়:

আরও পড়ুন

avertisements 2