avertisements 2

খুলনা-যশোর গ্যাস সঞ্চালন ও বিতরণ

‘আমুদে’ গ্যাস প্রকল্প হেসেখেলে কোটি কোটি টাকার নয়ছয়

ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ৩১ আগস্ট,শনিবার,২০২৪ | আপডেট: ০৯:১৪ পিএম, ২০ ডিসেম্বর,শুক্রবার,২০২৪

Text

ফাইল ছবি

সব প্রকল্পের উদ্দেশ্য হবে ব্যর্থ জানাই ছিল; তবু কোটি কোটি টাকা হরিলুটের আয়োজন। গ্যাস ও বিদ্যুৎ খাতে উন্নয়নের ধুয়া তুলে আওয়ামী লীগ সরকার গেল সাড়ে ১৫ বছর রাষ্ট্রীয় টাকা নয়ছয় করেছে হেসেখেলে। আমদানি করেও গ্যাস সংকট যেখানে বাগে আসছিল না, সেখানে খুলনা-যশোর অঞ্চলে অপরিকল্পিতভাবে নেওয়া হয় গ্যাস সঞ্চালন ও বিতরণের জন্য ‘আমুদে প্রকল্প’। গ্যাসের খবর নেই, এর আগেই বিপুল উৎসাহে খুলনায় হাজার হাজার কোটি টাকায় দাঁড় করানো হয় তিনটি গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। শুধু দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলই নয়, গ্যাস প্রকল্প হাতে নিয়ে উত্তরের মানুষকেও দেখানো হয় অলীক স্বপ্ন। প্রকল্পের টাকা লুটেপুটে উত্তরের সেই গ্যাসের গল্পও একসময় হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। এমনকি গ্যাস পাওয়া যাবে না– নিশ্চিত জেনেও প্রকল্প বানিয়ে অগভীর সমুদ্রে করা হয় অযৌক্তিক কূপ খনন।
এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে ১২ হাজার কোটি টাকার বেশি রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে খরচা করে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা সরকার। অভিযোগ আছে, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের বিশেষ বিধানের সুযোগ নিয়ে এসব প্রকল্পের অধিকাংশ কাজ দেওয়া হয়েছে দরপত্র ছাড়াই। কখনও ভোটের রাজনীতি চাঙ্গা রাখতে, কখনও লুটপাট করতে, আবার কখনও বিশেষ গোষ্ঠীকে সুবিধা দিতে এসব প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল। মন্ত্রী, আমলা ও সুবিধাভোগী ব্যবসায়ী গোষ্ঠী মিলেমিশেই এসব অপকর্মে নামেন।

যেমন খুলনা-যশোর অঞ্চলে গ্যাস দিতে প্রায় ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা খরচায় নির্মাণ করা হয়েছিল সঞ্চালন ও বিতরণ অবকাঠামো। পরে গ্যাস সংকটের মুখে ওই প্রকল্প বাতিল করে সরকার। এ বিপুল বিনিয়োগ এখন পড়ে আছে মাটির নিচে। ঋণ করে নেওয়া এই টাকার ঘানি টানছে সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলো। 
খাত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দিন দিন কমছে দেশীয় গ্যাসের উৎপাদন। বর্তমানে গ্যাসের চাহিদা দৈনিক ৪২০ কোটি ঘনফুট। আমদানিসহ গড়ে মিলছে ৩০০ কোটি ঘনফুট। গ্যাসের সমস্যা সমাধানে যেখানে গলদঘর্ম হতে হচ্ছে, সেখানে অনেক অপ্রয়োজনীয় ও অপরিকল্পিত প্রকল্প বাস্তবায়ন করেই যাচ্ছিল আওয়ামী লীগ সরকার।  

কূপ খননে শতকোটি টাকা গচ্চা
অগভীর সমুদ্রের ১৬ নম্বর ব্লকের ইজারা ছিল অস্ট্রেলীয় কোম্পানি সান্তোসের। এ ব্লকে গ্যাস পাওয়ার তেমন কোনো সম্ভাবনা পায়নি কোম্পানিটি। ফলে উৎপাদন অংশীদারিত্ব চুক্তির (পিএসসি) মেয়াদ ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে শেষ হওয়ার পর তারা ব্লকটি ছেড়ে দিতে চেয়েছিল। পরে সান্তোসের চুক্তির মেয়াদ বাড়ানো হয়। সান্তোস ২০১৬ সালে বাপেক্সের সঙ্গে যৌথভাবে মগনামা-২ গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের প্রস্তাব দেয়। যদিও বাপেক্সের পক্ষ থেকে এই কূপ খননের বিরোধিতা করা হয়। 
২০১৬ সালের ২৪ মার্চ বাপেক্সের পরিচালনা পর্ষদের ৩৭১তম বোর্ড সভায় এ প্রস্তাব তোলা হয়। সে সময় দায়িত্বে থাকা বাপেক্সের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, বোর্ড সভায় সান্তোসের প্রস্তাবটির নেতিবাচক দিকটি জোরালোভাবে তুলে ধরা হয়েছিল, যেন পাস না হয়। কারণ বাপেক্সের ভূতত্ত্ববিদরা নিশ্চিত ছিল মগনামায় গ্যাস নেই। বাপেক্সের তরফ থেকে বলা হয়েছিল, সান্তোস এর আগে মগনামা-১ কূপ খনন করেছিল সেখানেও গ্যাস পায়নি। ওই কূপ থেকে মাত্র ২ হাজার ২০০ মিটার উত্তর-পশ্চিমে মগনামা-২ কূপের অবস্থান। এখানে গ্যাস থাকার বৈজ্ঞানিক তথ্য-উপাত্ত নেই। গ্যাস না পেলে কূপ খনন বাবদ সুদে-আসলে বাপেক্সের আর্থিক ক্ষতি হবে ২৬২ কোটি টাকা। তবু সভায় সেই প্রস্তাব পাস হয়। ২৩০ কোটি টাকায় সান্তোস গ্যাস কূপ খননের কাজ পায়। খনন শুরুর ১৩ দিনের মধ্যেই তারা পেট্রোবাংলাকে জানায়, মগনামা-২ এ গ্যাস নেই। চুক্তি অনুসারে গ্যাস না পেলে কোনো টাকা দেওয়ার বিধান না থাকলেও ১২৯ কোটি টাকা সান্তোস আগেভাগেই নিয়ে নেয়। অভিযোগ রয়েছে, নিয়ম ভেঙে সান্তোসকে প্রকল্প গছিয়ে দিতে ভূমিকা রাখেন সবেক জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহীসহ বড় একটি সিন্ডিকেট। বোর্ডে সান্তোসের প্রস্তাব পাস করতে ভূমিকা রাখেন তৎকালীন সচিব নাজিমউদ্দিন চৌধুরী। তিনি তখন বাপেক্সেরও চেয়ারম্যান ছিলেন। ভোক্তা অধিকার সংগঠন বাংলাদেশ কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) এ নিয়ে তাদের একটি প্রতিবেদনে বলেছিল, নাইকো চুক্তির মতো সান্তোস চুক্তিতে দুর্নীতি হয়েছে। 

খুলনায় পড়ে আছে পাইপলাইন
খুলনাসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের পাঁচ জেলায় গ্যাস সরবরাহে ৮৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে ১৬৫ কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন নির্মাণ করা হয়। পরে নেওয়া হয় ৬০০ কোটি টাকার একটি বিতরণ প্রকল্প। ওই প্রকল্পে ৩৫০ কোটি টাকা দিয়ে বিতরণ লাইনের সরঞ্জাম কেনা হয়, করা হয় জমি অধিগ্রহণ। তবে গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত না হওয়ায় ২০১৬ সালে এই প্রকল্প বাতিল হয়ে যায়। এডিবির ঋণনির্ভর এই প্রকল্প নিয়ে সরকারের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) ২০১৭ সালে একটি পরিদর্শন প্রতিবেদন দেয়। এতে বলা হয়েছিল, উৎস পাইপলাইনে গ্যাসের প্রাপ্যতা না থাকার পরও ‘অবাস্তব পরিকল্পনা’ করে ‘দায়িত্বহীন’ একটি প্রকল্প প্রস্তাব করা হয়েছিল। পেট্রোবাংলার এক তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, গ্যাসের প্রাপ্যতার যে ধারণা করা হয়েছিল, এর চেয়ে গ্যাসের বিপুল ব্যবহারের হিসাবটি একেবারেই সামঞ্জস্যহীন ছিল। কেন এসব প্রকল্প  নেওয়া হয়, এমন প্রশ্নের জবাবে জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা এক সাবেক সচিব সমকালকে বলেছিলেন, ‘জ্বালানি বিভাগের অধিকাংশ সিদ্ধান্ত নিতেন তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী। তিনি যা বলতেন, যেভাবে নির্দেশনা দিতেন সেভাবেই প্রকল্প নিতে হতো।’

গ্যাস ছাড়াই বিদ্যুৎকেন্দ্র
গ্যাসের সরবরাহ নিশ্চিত না করেই আট হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে খুলনায় তিনটি গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ শুরু করেছিল আওয়ামী লীগ সরকার। এগুলো হলো নর্থ ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানির (এনডব্লিউপিজিসিএল) ৮০০ মেগাওয়াট ও ২০০ মেগাওয়াট এবং  বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) ৩২৫ মেগাওয়াট সক্ষমতার গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, গ্যাস সংকটের কারণে যেখানে খুলনার সঞ্চালন ও বিতরণ প্রকল্পই পরিত্যক্ত হয়েছে, সেখানে এক হাজার ৩২৫ মেগাওয়াটের  তিনটি বিদ্যুৎ প্রকল্প অযৌক্তিভাবে হাতে নেওয়া হয়েছে। 
গত বুধবার এক ব্রিফিংয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান সাংবাদিকদের বলেন, ‘খুলনাতে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে, কিন্তু গ্যাস তো যাবে না। এটা কোন ধরনের পরিকল্পনা হলো? গ্যাসের সংস্থান না করেই বিদ্যুৎকেন্দ্র কেন নির্মাণ করা হলো?’

‘ভোটের লাইন’ উত্তরবঙ্গে
আওয়ামী লীগ সরকার তার নির্বাচনী ওয়াদায় বলে‌ছিল উত্তরবঙ্গে গ্যাস দেবে। এ জন্য ১ হাজার ৪৯০ কোটি টাকার প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হয় ২০১৮ সালের অক্টোবরে। বগুড়া থেকে রংপুর হয়ে নীলফামারীর সৈয়দপুর পর্যন্ত ১৫০ কিলোমিটার পাইপলাইন স্থাপন করা হয়‌েছে। ৩০ ইঞ্চি ব্যাসের এ পাইপলাইনের মাধ্যমে গ্যাস যাবে রংপুর, নীলফামারীসহ উত্তরের ১১ জেলায়। খাত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গ্যাস সংকটে ঢাকা ও এর আশপাশের কারখানাগুলো বন্ধের পথে, সেখানে নতুন এলাকায় গ্যাস সরবরাহ প্রকল্প কে‌ন নেওয়া হলো– সেটাই প্রশ্ন‌বিদ্ধ।

হাজার কোটি টাকার কম্প্রেসার অব্যবহৃত
পর্যাপ্ত চাপে গ্যাস সরবরাহের উদ্দেশ্যে আওয়ামী লীগ সরকার ২০১৬ সালে দুটি কম্প্রেসার স্টেশন নির্মাণ করে। খরচ হয় ১ হাজার ৩৩১ কোটি টাকা। একটি বসানো হয় টাঙ্গাইলের এলেঙ্গায়, অন্যটি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জে। চাহিদা অনুসারে গ্যাসের সরবরাহ না থাকায় এলেঙ্গার কম্প্রেসার স্টেশনটি গত ৮ বছরে চালুই হয়নি। আশুগঞ্জের কম্প্রেসারটি গত বছর মাত্র ১০ শতাংশ সময় সচল ছিল। অর্থাৎ কম্প্রেসার স্টেশন দুটি গ্যাসের চাপ বাড়াতে কোনো ভূমিকাই রাখেনি। কাজে না লাগলেও এগুলোর রক্ষণাবেক্ষণে এ পর্যন্ত প্রায় ৩৫০ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। অর্থাৎ স্টেশন দুটি পেট্রোবাংলার জন্য এখন ‘শ্বেতহস্তী’।
 
সংশ্লিষ্টরা যা বলছেন
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. ম. তামিম সমকালকে বলেন, দেশের অধিকাংশ এলাকায় গ্যাস পাইপলাইন বসানো হয় রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে। আদতে এসব প্রকল্পের প্রয়োজন আছে কিনা, সে জন্য আর্থিক ও কারিগরি সমীক্ষা করা হয় না। রাজশাহীতে গ্যাস নেওয়া হয়েছে রাজনৈতিক কারণে। খুলনায় হাজার কোটি টাকা খরচ করে লাইন ফেলে রাখা হয়েছে। এখন উত্তরাঞ্চলে গ্যাস নিতে আবার লাইন করা হয়েছে, যা কোনো কাজে আসবে না। তিনি বলেন, সরকার আবাসিকে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ রেখেছে, তবু অবকাঠামো উন্নয়নে হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্প কেন নেওয়া হয়েছে– এর জবাব নেই।
পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জননেন্দ্র নাথ সরকার সমকালকে বলেন, ‘কোন প্রকল্প, কেন নেওয়া হয়েছে– আমরা তা যাচাই-বাছাই করে দেখছি। আদৌ এসবের প্রয়োজন ছিল কিনা। এর জন্য দায়ী কারা, সেটাও খোঁজা হবে। এখন প্রকল্পগুলো কোনো কাজে লাগানো যায় কিনা, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। বিশেষ করে খুলনার পাইপলাইনটি দিয়ে ভোলার গ্যাস বা পায়রার যে এলএনজি টার্মিনাল হবে, সেটির গ্যাস সরবরাহ করা যাবে।

বিষয়:

আরও পড়ুন

avertisements 2