বানেশ্বরে গাড়ি গাড়ি আম, শুধু নেই ক্রেতা
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ৪ জুন,শুক্রবার,২০২১ | আপডেট: ০৮:২১ এএম, ১৯ ডিসেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
রাজশাহীর সবচেয়ে বড় আমের হাট বানেশ্বরে। এখানে প্রতিদিন শত কোটি টাকার আমের বাণিজ্য হয়ে থাকে। তবে সম্প্রতি আমচাষিদের চোখেমুখে দেখা গেছে হতাশা। তাদের ভাষ্য, ‘হাটে গাড়ি গাড়ি আম আছে, কিন্তু ক্রেতা নেই।’
সকাল ৮টা থেকেই রাজশাহীর আনাচে-কানাচে থেকে আম নিয়ে বানেশ্বর বাজারে আসতে শুরু করেন চাষিরা। এর আগে ভোর থেকে বাগানে আম পেড়ে ক্যারেট ভর্তি করেন। পরে একটি ভ্যান ভাড়া করে ছোটেন রাজশাহীর সবচেয়ে বড় আমের বাজার বানেশ্বরে।
পবা উপজেলার হরিয়ান থেকে বানেশ্বর কলেজ মাঠে আমের হাটে আম বিক্রি করতে এসেছেন আবুল কালাম নামের এক চাষি। আক্ষেপের স্বরে তিনি বললেন, ‘আম এনেছি ৫৫ ক্যারেট। দুপুর একটার দিকে এসেছি। ব্যাপারিরা কেউ নাই। এখন পর্যন্ত একটা লোকও জিজ্ঞাসা করল না আমের দাম কত? হাটে সব আমওয়ালাতেই ভর্তি। আমার মতন অনেকেই এমন বসে আছেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা।’
আম নিয়ে অপেক্ষমান মো. শাহজাহান আলী তার (আবুল কালাম) কথায় সাই দিয়ে জানান আরও বিভিন্ন অভিযোগ। তিনি বলেন, ‘বাজারে ক্রেতা নাই। এই সুযোগে ৪৮-৫২ কেজিতে মণ নিচ্ছে ব্যাপারিরা। সার, কীটনাশকের দাম অনেক। আবার ধরেন প্যাট-পাটাল ৫০০ টাকা, লেবারে লাগে ৬০০, দু’তিন জন দুপুরবেলা ভাত খেলে আবার খরচ হয় ৫০০ টাকা। আবার এখানকার স্থানীয় ব্যবসায়ীরা আম নেয়ার পর টাকা বাকি রেখে দেয়, টাকা দিতে চাই না।’
তিনি বলেন, ‘আমচাষে যে টাকা খরচ করছি, সে টাকা পাচ্ছি না। এবার আমের দাম একেবারেই কম। এমন অবস্থা ক্রেতাদেরকে ধরে ধরে নিয়ে এসে আম দেখাতে হচ্ছে। সব মিলিয়ে আমে বিশাল লস এবার।’
কাটাখালী এলাকার সুজন আলী নামের স্থানীয় এক আমচাষি বলেন, ‘আমাদের এখানে ক্রেতা অনেক কম। সাধারণ ক্রেতা নাই বললেই চলে। ঢাকাসহ অন্যান্য জেলার যেসব বাইরের ব্যাপারিরা আছেন তারা আবার স্থানীয় ব্যাপারিদের সঙ্গে করে নিয়ে আসেন। হাটে যখন দেখে আম অনেক বেশি তখন তারা দাম দিতে চাই না। আবার ৫২ কেজি আমে মণ হিসেব করে। এতে ১২ কেজিই পুরাই লস, এটা আমাদের চাষিদের জন্য বিশাল সমস্যা।’
বানেশ্বর বাজারের আবু সুফিয়ান নামের এক ব্যাপারি বলেন, ‘বাইরের পার্টিরা ৪৫ কেজিতে মণ নেয়। কম দিলে নিতে চাই না। আবার ৪৫ কেজি আম পাঠালে সেটা পেকে গেলে ওজন কমে ৪৩ কেজি কমে যায়। তখন তারা আবার আপত্তি জানায়। তাই আমাদেরও এখানে চাষিদের কাছে থেকে মণপ্রতি বেশি নিতে হয়। তবে ৪৮ থেকে ৫২ কেজিতে মণ ধরার বিষয়টি সত্য নয়।’
সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, রাজশাহীর হাইওয়েগুলোতে একের পর এক আমের ক্যারেট ভর্তি ভ্যান। তাদের গন্তব্য বানেশ্বর আমের হাট। রাজশাহী থেকে পুঠিয়ার বানেশ্বর হাটে যাওয়ার পথে হাইওয়ের বেশ কিছু জায়গাতে কিছু কিছু আমের দোকান চোখে পড়ে। আবার অনেকে রাস্তার পাশে ক্যারেটে এমনকি ভ্যানের ওপর ক্যারেভর্তি আম নিয়ে বিক্রি করছেন। অনেকেই গাড়ি থামিয়ে কিনছেনও তাদের আম।
এবারে আমের হাট সম্পর্কে জানতে জাইলে পুঠিয়া উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নুরুল হাই মোহাম্মদ আনাস জানান, গতবারের তুলনায় এবারে আমের জোগান অনেক বেশি। তবে সেই তুলনায় ক্রেতা নেই। করোনার কারণে বর্তমানে অনেক আমচাষি ও উদ্যোক্তার সৃষ্টি হয়েছে। এটি একদিক দিয়ে ভালো হলেও চাষিদের জন্য সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ, এবার অনেক ব্যবসায়ীই অনলাইনে অর্ডার দিয়ে আম কিনছেন। অন্যদিকে, যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হওয়ায় এবং ম্যাংগো স্পেশাল ট্রেন চালু হওয়ায় অনেকেই অনলাইনে অর্ডার করে কুরিয়ার অথবা ট্রেনযোগে সংগ্রহ করছেন।
তিনি জানান, গতবছর প্রতিদিন বানেশ্বর থেকেই প্রায় ৩০০টি আমভর্তি ট্রাক ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় যেত। কিন্তু এবছর মাত্র ৩০ থেকে ৪০টি ট্রাক প্রতিদিন বানেশ্বর বাজার থেকে রাজশাহীর বাইরে যাচ্ছে। এখনো বাগানে প্রচুর আম রয়েছে। আবার হাটেও প্রচুর আম, কিন্তু সেই তুলনায় ক্রেতা নেই।
সম্প্রতি করোনার ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও রাজশাহীতে করোনার আক্রান্তের হার অনেক বেশি হওয়ায় বাইরের অনেক ব্যাপারিরা রাজশাহীতে আসতে ভয় পাচ্ছেন বলেও জানান ইউএনও।
ঢলন বা সোলা প্রথার উচ্ছেদের কথা থাকলেও তা মানছে না আড়তদার বা ব্যাপারিরা। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ঢলন প্রথার উচ্ছেদ করে মেট্রিক পদ্ধতিতে আম ব্যবসা পরিচালনার কথা বলা হয়েছে। এ নিয়ে বাজার মনিটরিং করা হচ্ছে। এ নিয়ে আমাদেরকে কেউ অভিযোগ করেনি। অভিযোগ পেলে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
বানেশ্বর হাটের ইজারাদার ও ব্যবসায়ী মালিক সমিতির সভাপতি মো. ওসমান আলী বলেন, অতিরিক্ত আম (মণে কেজি বেশি ধরা) নেয়ার অভিযোগ এখন পর্যন্ত কোনো আমচাষিদের কাছে পাইনি। পেলে অবশ্যই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। তবে তারা যদি ব্যাপারি বা আড়তদারদের সঙ্গে সমঝোতা করেন তবে সেক্ষেত্রে বলার কিছু নেই।
ক্রেতা সঙ্কটের বিষয়ে তিনি বলেন, গতবছরের তুলনায় এবার ক্রেতা একেবারেই নেই। এর কারণ হিসেবে করোনাকেই দায়ী করেছেন ব্যবসায়ী সমিতির এই সভাপতি।