আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ দিবসে স্বজনদের আর্তি
আর কাঁদতে চাই না তাঁদের ফেরত চাই
ডেস্ক রিপোর্ট
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ৩১ আগস্ট,মঙ্গলবার,২০২১ | আপডেট: ০১:১২ পিএম, ২৩ ডিসেম্বর,সোমবার,২০২৪
বাবার জন্য এখনো অপেক্ষায় সাফা। গুম দিবসের অনুষ্ঠানে জাতীয় প্রেস ক্লাবে মায়ের সঙ্গে এসে জানান দেয় তার কষ্টের কথা।
‘আমার আব্বু যখন নিখোঁজ হয় তখন আমার বয়স তিন বছর। আমার আব্বুর চেহারাটা আমার চোখে ভাসে না। শুধু ছবির মধ্যে আছে। আমি আমার বাবাকে দেখতে চাই। আমরা আর কাঁদতে চাই না। তাকে ফিরিয়ে দিন।’ গতকাল মঞ্চে দাঁড়িয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বাবার ছবি হাতে এই আর্তি ১১ বছরের শিশু লামিয়া আক্তার মিমের। তার বাবা কাওসার হোসেন আট বছর আগে রাজধানীতে নিখোঁজ হয়েছেন।
মিমের মতোই মঞ্চে দাঁড়িয়ে আকুতি আরেক শিশু আরিয়ানের (১৩), ‘আমি আমার বাবার সঙ্গে স্কুলে যেতে চাই। আমার বন্ধুরা যখন বাবার সঙ্গে স্কুলে যায়, তখন আমি তাকিয়ে থাকি। আমার অনেক খারাপ লাগে।’ আরিয়ানের বাবা খালিদ হাসান সোহেল ২০১৩ সালের ২৮ নভেম্বর নিখোঁজ হয়েছেন।
একই বছরের ডিসেম্বরে হারিয়ে যাওয়া সেলিম রেজা পিন্টুর বড় বোন রেহানা বানু মুন্নি বলেন, ‘আমার ভাইয়ের খোঁজ না পেয়ে আমার বাবা মরে গেছে। আমার মাকে কিছু বলতে পারছি না। আটটি বছর কাঁদছি। আর কাঁদতে চাই না। এভাবে আর বাঁচতে চাই না। তাদের ফিরিয়ে দিন। না হলে আমাদেরও গুম করুন। মেরে ফেলুন। আপনারা আর কানে তুলো দিয়ে রাখবেন না।’
গতকাল সোমবার আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ দিবসে জাতীয় প্রেস ক্লাব মিলনায়তনে ‘গুম হওয়া ব্যক্তিদের স্মরণে মায়ের ডাক’ শিরোনামে এক সভায় স্বজনদের হাহাকার উঠেছিল নিখোঁজদের জন্য। বাবার ছবি হাতে কেঁদে আকুতি জানিয়েছে ছোট্ট শিশুরা। ভাইকে ফিরে পেতে চেয়েছেন বোন। সন্তানের জন্য কেঁদেছেন মা। স্বজনদের বক্তব্যে ক্ষণে ক্ষণে শোকভারাতুর হয়ে ওঠে পরিবেশ। সভায় নিখোঁজদের পরিবারগুলোর সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেন মানবাধিকারকর্মী, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীসহ বক্তারা এই শোককে শক্তিতে রূপান্তর করে স্বজনদের ফিরে পাওয়ার দাবি অব্যাহত রাখার আহ্বান জানান। বক্তারা বলেন, কোনো ব্যক্তিকে গুম বা নিখোঁজ করে ফেলা মানবতার বিরুদ্ধে গুরুতর অপরাধ। এই অপরাধের সুষ্ঠু তদন্ত প্রয়োজন। স্বজনদের কাছে নিখোঁজদের ফিরিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি স্বাধীন তদন্ত কমিশন করে দায়ীদের বিচার নিশ্চিত করার দাবিও জানান তাঁরা।
বক্তব্য দেওয়া শিশু আরিয়ানের মা সৈয়দা শাম্মী সুলতানা কালের কণ্ঠকে বলেন, তাঁর স্বামী খালিদ হাসান সোহেল ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে থেকে নিখোঁজ হন। তিনিই ছিলেন পরিবারের বড় সন্তান। তিন বোন, চার ভাই, মা-বাবাসহ সংসারে পুরো দায়িত্ব ছিল সোহেলের কাঁধে। সোহেল নিখোঁজ হওয়ার পর সংসারে দেখা দেয় চরম বিপর্যয়। অসুস্থ হয়ে পড়েন তাঁর বাবা ফিরোজ উদ্দিন। সংসারে সহায়তার জন্য শাম্মী বনানীর একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি নিয়েছেন। আরিয়ান এখন ঢাকা গভ. মুসলিম স্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র। শাম্মী বলেন, ‘ছেলেটা বাবার ব্যাপারে বারবার প্রশ্ন করে। সে বুঝতে চায় তাকে আর ফিরে পাব কি না। বন্ধুদের বাবারা ছেলেকে কিছু দিলেই তার সেটা সামনে আসে। আমি তো জবাব দিতে পারি না।’
বংশালের নিখোঁজ মাহফুজুর রহমান সোহেলের ছয় বছরের মেয়ে সাদিকা সরকার সাফা বাবার ছবি নিয়ে মঞ্চে দাঁড়িয়ে বলে, ‘আমি আর কিছু জানতে চাই না। আমি আমার বাবাকে ফিরে পেতে চাই। আমার বাবাকে ফিরিয়ে দিন।’
২০১৩ সালের ৪ ডিসেম্বর সাজেদুল ইসলাম সুমনসহ আটজন রাজধানীর শাহীনবাগ এলাকা থেকে নিখোঁজ হন। সাজেদুল ইসলামের মেয়ে হাফসা ইসলাম রাইতা বলে, ‘আমি আট বছর ধরে এখানে দাঁড়িয়ে একই কথা বলছি। আমি আমার বাবাকে ফেরত চাই। আমি গত বছর বলেছিলাম, আমার বাবাকে ফিরিয়ে দিতে না পারলে আমাকেও গুম করে দিন। আমি আজও একই কথা বলছি। আমি এখানে আর আসতে চাই না। আমি শুধু আমার বাবাকে ফিরে পেতে চাই। প্রধানমন্ত্রী আপনি কি আমাদের কান্না শুনতে পাচ্ছেন না, স্বজন হারানোর ব্যথা কি অনুভব করতে পারছেন না?’
২০১৫ সালের ২১ আগস্ট গাজীপুর থেকে নিখোঁজ হয়েছেন কুষ্টিয়ার স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন সবুজ। তাঁর স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস জিনিয়া বলেন, ‘আমার স্বামীর সঙ্গে স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি আকতারুজ্জামান লাবুকেও র্যাব আটক করে। ছয় দিন পর সে ফিরে আসে। কিন্তু আমার স্বামীকে আর পেলাম না। দুই সন্তান নিয়ে আমি কত কষ্টে দিন কাটাচ্ছি। কেউ তার খোঁজ দিতে পারছে না।’
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ডা. জাফরুল্লাহ বলেন, ‘একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বজন হারানো এই পরিবারগুলোর কাছে ক্ষমা চাইতে হাজির হয়েছি। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সবার কাছে এসব গুমের তথ্য নিশ্চয় আছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এদের ফিরিয়ে দিন। মাননীয় প্রধান বিচারপতির কাছে একটি আবেদন, ড. আসিফ নজরুল, নূর খান লিটনদের মতো লোককে দিয়ে একটি স্বাধীন তদন্ত কমিটি গঠন করে দিন। প্রতিটি ঘটনার তদন্ত করুন।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল বলেন, ‘একটা প্রশ্ন মনের মধ্যে আসে, গুম কারা করে? এই গুম সরকারি বাহিনী করেছে, সরকার করেছে—এটা বিশ্বাস করার বহু কারণ রয়েছে। যদি গুম, খুন ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সরকারি বাহিনী না করে থাকে, তাহলে যাঁরা গুম হয়েছেন, তাঁদের খুঁজে বের করছেন না কেন?’
নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘উন্নয়নের নামে মানুষ গুম-খুন এমন রাষ্ট্র আমরা দেখতে চাই না। এই কান্না, শোক আর না। চোখের পানিকে বারুদে রূপান্তর করতে হবে। এদের ফিরে না পাওয়া পর্যন্ত দাবি চালিয়ে যেতে হবে।’
মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন বলেন, ‘জাতিসংঘ যে ৩৪ জনের খোঁজ চেয়েছে, তাঁদের মধ্যে একজন ভারতীয় রয়েছেন, যাঁকে ভারতে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। এখন গুম-খুনে বহিঃশক্তিও জড়িত। এ ব্যাপারে স্বাধীন আস্থাভাজন তদন্ত কমিটি গঠন করতে হবে। সবারই মনে রাখতে হবে, এই দিন দিন না, আরো দিন আছে।’
খ্যাতিমান আলোকচিত্রী শহিদুল আলম বলেন, ‘যত দিন না বিচার হবে, তত দিন এই সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে।’ গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি বলেন, ‘একজন মানুষকে নিখোঁজ করে ফেলা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ। নিকৃষ্ট কাজ। চোখের পানিকে শক্তিতে রূপান্তর করে বিচারের দাবিতে সবাইকে সোচ্চার হতে হবে।’
নিখোঁজ সাজেদুল ইসলাম সুমনের বড় বোন হাজেরা ইসলামের সভাপতিত্বে সভা শেষে স্বজনরা ছবি হাতে নিয়ে প্রেস ক্লাবের সামনের রাস্তায় মানববন্ধনে অংশ নেয়। সেখানে বিএনপির নেতাকর্মীরাও সংহতি প্রকাশ করে বক্তব্য দেন।