জালাল উদ্দিন আহমেদ
পাতার অপর পৃষ্ঠা
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ১৫ জানুয়ারী,রবিবার,২০২৩ | আপডেট: ০৬:৪০ এএম, ১৯ ডিসেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
ভদ্রলোক বেশ উত্তেজিত ভাবেই কথাগুলো বলছিলেন। আবার মাঝে মাঝে আক্ষেপও করছিলেন। কি চেয়েছিলেন। কি হোল! এক্ষেত্রে রাজনীতি আনতে না চাইলেও তার কথাবার্তায় রাজনীতির প্রতি ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশও লক্ষ্য করলাম। তার ক্ষোভ মিশ্রিত কথাবার্তায় রাজনীতির দুর্বৃত্যায়নের কিছু উদগীরনও হলো। স্বাধীনতার পর থেকেই একসঙ্গে বসবাস। কর্মজীবন শেষ করেছি দশ এগার বছর হয়ে গেল। এখন ঘন ঘনই দেখা সাক্ষাৎ হয়। তখন এলাকাটা ছোটই মনে হোত। দোতলা বাড়ি বলতে হাতে গোনা কয়েকটি। দোতলার ছাদে উঠলে পুরো এলাকাটাই মেপে নেয়া যেত। এক আধা কিলোমিটার দূরত্বে থাকা মানুষটিও যেন আপন মনে হোত। সালাম বিনিময় হোত। কুশল বিনিময়ও হোত। ঢাকায় তখনও এখনকার মত এত মনুষ্য কোলাহল এবং যন্ত্রযানের দাপাদাপি ছিল না। মানুষ মানুষকে চিনতে চেষ্টা করতো। মানবিক ও সামাজিক মূল্যবোধের বড় একটা জায়গা ছিল তখন। আমরা আমাদের সেই কৈশর জীবনে বিকেল হলেই বল হাতে মাঠে হাজির হতাম। একই মাঠে নিজেদের মত করে একদল ফুটবল খেলছে, একদল মাঠের একপাশে ভলিবল কোর্ট বানিয়ে ভলিবল খেলছে। ছোটরা মাঠের কোনা ঘেষে তাদের মত করে ফুটবল নিয়ে দৌড়ঝাঁপ করছে। তখন ক্রিকেটের অত চলন হয়নি। মাগরিবের আযানের সাথে সাথে মাঠ ফাঁকা। অর্থাৎ সন্ধ্যে হলে আর কোন অজুহাত চলবে না। বাসায় ফিরে হাতমুখ ধুয়ে সোজা পড়ার টেবিলে।
এভাবেই বেড়ে উঠে আজ আমরা সিনিয়র সিটিজেনের খাতায় নাম লিখিয়েছি। আগে থাকতাম খোলামেলা এক বা দেড় তলা বাড়ীতে। আর এখন থাকি বাড়িতে, তবে ফ্লাট বাড়িতে। আগে মিউনিসিপ্যাল করপোরেশনকে ট্যাক্স দিতাম বার'শ টাকা। পরে সিটি করপোরেশন হওয়াতে সেই ট্যাক্স বেড়ে দাঁড়াল চব্বিশ'শ টাকা। আর এখন সেই একই জমিতে ফ্লাট প্রতি ট্যাক্স দিতে হয় তিন/চার হাজার টাকা। অর্থাৎ সাত তলা বিল্ডিং এর হোল্ডিং ট্যাক্স পঁচিশ থেকে আটাশ হাজার টাকা। এই ট্যাক্স ও নাগরিক সেবা সুবিধা নিয়েই যত কথা যত ক্ষোভ। ভদ্রলোক ক্ষোভের সঙ্গেই বলছিলেন তার অসহায়ত্বের কথা। খুব বড় কিছু নয় কিন্তু সেই 'ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বালুকনা বিন্দু বিন্দু জলের সমীকরনে' এটাকে ফেললে অযৌক্তিক মনে হবেনা। আগে অবশ্য শহর জীবনে এসব উটকো বোঝাগুলো ততটা চোখে পড়তো না। আটাত্তর পরবর্তী নগর জীবনে নাগরিক সেবার বাহারী আয়োজনে কিছুটা হলেও আমরা নাভিশ্বাসে আছি - একথা আস্বীকার করার উপায় নেই। খুব বড় কোন সমস্যা না হলেও আমার কাছে কিন্তু এটা ওই ছোটবেলায় শেখা এ প্লাস বি হোল স্কয়ারের ফর্মুলার মতই মনে হয়েছে।
এই তো কিছুদিন আগে সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন হয়ে গেল। নির্বাচনের প্রাক্কালে জন সংযোগ জনসভা ইত্যাদির ব্যাপারগুলো চিরায়িত একটা চিত্র। সেইসব জনসংযোগে স্থানীয় স্থায়ী বাসিন্দা হওয়াতে আমাদের তো একটা আলাদা অবস্থান থাকে। ফলে আমাদের পছন্দের প্রার্থীকে কাউন্সিলর করে জিতিয়ে আনতে কিছুটা প্রকাশ্য তো হতেই হয়। এবং এখানেই ভদ্রলোকের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশটা একটু বেশী। একে তো সিটির মাথাভারি হোল্ডিং ট্যাক্স, তার উপরে রয়েছে স্থানীয় কাউন্সিলারের জমা খরচের হিসাব নিকাশ।এখানে ব্যাপারগুলো যেহেতু ওয়ার্ড কাউন্সিলরের জ্ঞাতস্বারেই হয়ে থাকে বিধায় সরাসরি 'হিসাব নিকাশ' বলেই তা সাধারনে প্রচলিত। আগে অর্থাৎ সিটির তকমা লাগানোর আগে নৈশ প্রহরী বা নাইট গার্ডের জন্য প্রতিমাসে পনের বিশ টাকা দিতে হোত। পরবর্তীতে জনজীবনে ফ্লাট সিষ্টেমে বসবাসের চাপ সৃষ্টি হওয়ার ফলে আবাসিক এলাকায় সৃষ্ট বর্জ্য অপসারনের একটি দৈনন্দিন চাহিদা সৃষ্টি হয়। কারন, খোঁজ খবর নিয়ে দেখা যায় একটি মহল্লা বা ব্লকে নব্বই পুর্ববর্তী সময়ে যেখানে সাকুল্যে তিন হাজার মানুষের বসবাস ছিল, এখনকার দিনে আবাসিক এলাকায় উর্ধমুখী উন্নয়নের(বহুতল)ফলে সেসব মহল্লা বা ব্লকে কমপক্ষে চল্লিশ হাজার লোকের বসবাস। ফলে জনাধিক্যের কারনে স্বাভাবিক নিয়মেই কঠিন বর্জ্য অপসারনের প্রয়োজনীয়তা জোরেশোরেই উচ্চারিত হয়। ফলে এসব কাজ করার জন্য চ্যানেল তৈরী করে গড়ে উঠে সেবাদানকারী প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান। এসব কাজে সিটি করপোরেশনের কোন নতুন বিধিমালা আছে কি না তা অবশ্য আমাদের জানা নেই। তবে স্থানীয় কমিশনার বা কাউন্সিলরদের সম্মতিতেই এসব কর্মগুলি পরিচালিত হয়। গত নির্বাচনের আগেও এসব স্থানীয় পরিসেবা যেমন নাইট গার্ড ও সুইপার ম্যানেজমেন্টের কাজগুলি প্রাইভেট পদ্ধতিতে চলেছে। সেখানে অবশ্যই তা কাউন্সিলরের অফিস তদারকিতেই হোত বলে আমরা তা জেনেছি। প্রথমদিকে নাইট গার্ড ও সুইপারের জন্য সাকুল্যে তিরিশ টাকা মাসিক চাঁদা দিতে হোত। সর্বশেষ অর্থাৎ গত সিটি নির্বাচনের আগে তা বেড়ে দাঁড়ায় এক'শ বিশ টাকা।
এসব নিয়েই আমার প্রতিবেশী বন্ধুর যত আপত্তি। দৈনন্দিন ময়লা অপসারন ও আনুসাঙ্গিক বিল মাসে তিরিশ টাকা ফ্লাট প্রতি ধার্য করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন বর্তমান কাউন্সিলর। তার নির্বাচনী ইস্তেহারেও সেসবের প্রতিশ্রুতি ছিল। কিন্তু নির্বাচিত হওয়ার কয়েক মাস পরেই দেখা গেল কাউন্সিলর অফিস থেকে চিঠি দিয়ে সেই সেবা কার্যক্রমের বিল গিয়ে দাঁড়াল এক'শ নব্বই টাকা। ময়লা অপসারনের জন্য ফ্লাট প্রতি এক'শ টাকা আর নাইট গার্ডের জন্য নব্বই টাকা। সেবাটি কি ব্যবসায় পরিনত হোল? এটাই তার জিগ্যাসা। তিনি আরও যোগ করলেন, যে মানুষটি নির্বাচনের সময় কাউন্সিলরের পিছনে পিছনে মাইক নিয়ে প্রতিটি সভায় উপস্থাপক হিসাবে গলা ফাটাচ্ছিলেন তিনি এখন এসব কার্যক্রমের হর্তাকর্তা। তার জন্য কাউন্সিলর অফিসে আলাদাভাবে সাজানো গোছানো চেম্বার করে দেয়া হয়েছে। সে এক চমক লাগানো বিষয় বটে। তিনি বলেই চলেছেন, আচ্ছা বলুন তো একটি ওয়ার্ডে কতগুলি বাড়ি ও ফ্লাট থাকতে পারে? এখনকার ফ্লাট সিস্টেমের যুগে প্রতিটি বাড়িতেই তো এখন সিকিউরিটি গার্ড থাকে। তাহলে মহল্লার সিকিউরিটি কে দেখে? এই যে মহল্লার অলিগলিতে দোকানপাট, ফুটপাত এমন কি গাড়ির গ্যারেজ ওয়ার্কশপ অযাচিতভাবে গঁজিয়ে উঠছে, তাছাড়া আবাসিক এলাকায় ঘরে ঘরে কোচিং সেন্টার ও কিন্টার গার্ডেন ভাড়া নিয়ে চালু হচ্ছে - এটা দেখার দায়িত্ব কার? তাছাড়া হোল্ডিং ট্যাক্সের সঙ্গেই তো এসব সেবা পরিসেবার হিসাব করা থাকে। এন্তার প্রশ্ন তার মনে এবং এসব প্রশ্ন থেকেই ক্ষোভের সঞ্চার। তিনি আরো যোগ করলেন আগে তো সুইপার ও নাইট গার্ডের জন্য বাড়ি হিসাবে চাঁদা নেয়া হোত। এখন সেটা নতুন রূপে ফ্লাট প্রতি ধরে ধরে রীতিমত বাধ্যতামুলক একটি আইন সিদ্ধ ব্যাপার হিসাবে দাঁড় করানো হয়েছে। এ কোন মহাজনী চক্রবৃদ্ধির ব্যবসা? ভদ্রলোকের শেষ কথা ছিল একই প্রতিষ্ঠানে দু'রকম রাজস্ব আদায়ের ব্যাপার। Overlapping নয় তো?
আমি অবশ্য এসবের খোঁজ খবর খুব বেশী রাখতাম না। আমার ঘরওয়ালীই এসব সামাল দেন। তবে ভাবনার বিষয় বটে। সরকারী সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানে যদি এরকম কোন ভীমরুলের চাক বসে থাকে তবে তা অপসারনের দায়িত্ব তো আমাদের সকলের। সরকারী গেজেটভুক্ত স্বায়ত্ব শাসিত সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান হিসাবে দেশের মিউনিসিপ্যালিটি বা সিটি কর্পোরেশনের সৃষ্টি হয়েছে। স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় তা পরিচালনার জন্য সরকারের বাজেটে তা গেজেটভুক্ত। সুতরাং হোল্ডিং ট্যাক্স দেয়ার পর সেখানে অন্য কোন খাতে চাঁদা বা ট্যাক্স কেন দিতে হবে সেটাই তো মাথায় আসে না। এক্ষেত্রে যিনি আমাদের ওয়ার্ডের অভিভাবক হিসাবে সম্মানিত হয়েছেন তারও একটা নৈতিক দায়িত্ব থেকে যায় এসব নিয়ে চিন্তা ভাবনা করার। সামান্য এসব ছোটখাট সেবা পরিসেবায় যদি নয়ছয় হয়েই থাকে তবে নিজ বিবেচনায় এমনকি ওয়ার্ডের মুরুব্বী বা গন্যমান্যদের নিয়ে এসবের পর্যালোচনায় বসা উচিত বলে মনে হয়। নইলে বর্তমান সময়ের এই আকালে জনজীবনে যে অভাব অনটন ও দৈব দুর্বিপাকের আলামত শুরু হয়েছে তাতে করে সরকারী সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান হিসাবে সিটি করপোশনের ইজ্জত কমবে বৈ বাড়বে বলে মনে হয় না।