জালাল উদ্দিন আহমেদ
ব্রেকিং বিবেক
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ১ জানুয়ারী,রবিবার,২০২৩ | আপডেট: ০৬:৪১ এএম, ১৯ ডিসেম্বর,বৃহস্পতিবার,২০২৪
একজন বয়োঃবৃদ্ধ ইঞ্জিনিয়ার অন্য এক উন্নয়নের পতাকাবাহী (?) রাজনীতিকের কাছে রাজধানীর রাজপথে প্রকাশ্য চড় খেয়েছেন!!!
*জাতির বিবেক কি বলে?
*গনপ্রজাতন্ত্রী সরকারের জনস্বার্থ সেল থেকে কিছু শোনা গেল কি?
*উচ্চ ন্যায়ালয়ে একজন মঞ্জিল মোরশেদ নামক জনসচেতন আইনজীবির নাম শুনেছিলাম। ওখান থেকে কোন খবর এল কি?
*একটি ইঞ্জিনিয়ারস ইনস্টিটিউশন আছে বলে শুনেছি। ওরা কি নিয়ে ব্যস্ত এখন?
*দেশের রাজনৈতিক নৈতিকতা কি বলে?
*আর যেসব সাংবাদিকের ক্যামেরার বদৌলতে আমরা এই মধ্যযুগীয় আচরন প্রত্যক্ষ করলাম সেই চতুর্থ স্তম্ভের পিলারগুলোই বা কি ভাবছেন?
একজন প্রবীন ইঞ্জিনিয়ার ম ইনামুল হক যাকে নিয়ে আমাদের গর্ব করার অনেক কিছুই আছে, যিনি তার কর্মজীবনের সর্বস্ব নিংড়ে দিয়েছেন তার প্রিয় জন্মভূমির জন্য। তাকে নিয়ে তো আমরা গর্ব করতেই পারি। বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে এধনের অভিজ্ঞ পেশাজীবি বাঙালী সন্তানের বড়ই অভাব। তিনি তার কর্ম জীবনের শেষ প্রান্তে নদী গবেষনা ইনস্টিটিউটের মহা পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন। শুধু তাই নয় বাংলাদেশের হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন অধিদপ্তর এবং পানি সম্পদ পরিকল্পনা সংস্থার মহাপরিচালক হিসাবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন। এরকম একজন প্রথিতযশা এবং কর্ম জীবনের বর্নাঢ্য অভিজ্ঞতার বাঙালী সন্তান তার অবসরের দিনগুলিতে যদি দেশ নিয়ে ভাবতে গিয়ে রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে কথা বলেন বা সমাজ ও রাজনীতির অসংগতির কথা বলতে চান সেতো গর্ব করার বিষয়। বাম ঘরানার মতাদর্শী সত্তোর্ধ একজন সিনিয়র সিটিজেন সাম্য ঐক্য ও দেশের শৃংখলা নিয়ে কথা বলতেই পারেন। এটা তার সাংবিধানিক অধিকার। সম্ভবতঃ নব্য রাজনীতিবিদ হয়ে প্রকাশিত যে মানুষটি ওই সম্মান্নিত যশস্বী বাঙালীর গন্ডদেশে প্রকাশ্য জনবহুল রাজপথে ঠাস ঠাস করে দুটো চড় লাগিয়ে দিলেন প্রকারান্তরে তিনি বাংলা মায়ের পবিত্র ভূমিকে অসম্মান করলেন। জাতির স্রষ্ঠা বঙ্গবন্ধুকে অপদস্থ করলেন। ওই ছেলেটি (এখানে ছেলেই প্রযোজ্য কারন দাম্ভিকতা দেখানো রাজনীতির পক্ষটির বয়স পঞ্চাশের নীচেই হবে) কি জানে আজ আমরা যার রাজনীতির গর্বে গর্বিত হয়ে হাতাকাটা কাল কোট গায়ে জড়িয়েছি, সেই মানুষটি কত কষ্ট করে বাঙালীর দ্বারে দ্বারে ঘুরে তাদেরকে বাঙালীয়ানায় উদবুদ্ধ করেছেন! বাংলার মানুষের মুখে হাসি দেখার জন্য তিনি ১৮ বার জেলে গেছেন এবং ১৪ বছর জেলের কাল কুঠরীতে বন্দি জীবন কাটিয়েছেন। সেই মহামানবের উত্তরসুরী হওয়ার দৌড়ে এটাই কি আমাদের উন্নয়ন? বয়োঃবৃদ্ধ ইঞ্জিনিয়ার সাহেব তো আজকের প্রচলিত রাজনীতির ধারায় গা ভাসিয়ে কাউকে গালমন্দ করেন নি। কাউরি বাপদাদা চৌদ্দগুষ্টির শ্রাদ্ধও করেননি। তিনি রাস্তা বন্ধ করে জনজীবনে দুর্ভোগেরও কারন হননি। এমনকি ক্ষমতার হিসাব নিকাশে কাউরি বাড়া ভাতে ছাই দেয়ার সেরকম যৌক্তিক জন বেষ্টিত কোন বিশৃংখলাও তৈরী করেন নি। দেশকে নিয়ে, সচেতন একজন বাংলাদেশ অন্তঃপ্রান অবসরের মানুষ যদি মনের শান্তি ও স্বস্তির জন্য রাজপথে দাঁড়িয়ে তার মনের কথাগুলি জনপদের সাধারন মানুষকে জানাতে চান তাতে আপত্তিটা কোথায়?
মানুষের নৈতিক অবক্ষয় কোন্ পর্যায়ে এলে সমাজ তথা রাষ্ট্রে এধরনের আচরন পরিলক্ষিত হয়! যেটা দেখলাম সেটা কি এমনি এমনি এসেছে। এই অমানবিক ও অপকর্ম সৃষ্টির অঙ্কুর স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর হতেই শুরু হয়েছে। সেদিনের জন্ম নেয়া শিশুটি যে অভ্যারন্যে বড় হয়ে আজকে মুজিব কোটের উত্তরাধিকারী হতে চায় সেই শিশুটির বেড়ে উঠার পর্বগুলি কি বাঙালীর শাশ্বত আহ্বানের মসৃন পথ বেয়ে এগিয়েছে? মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী সময়গুলিতে বাঙালীর বাঙালীয়ানা উঠানের লালন পালন কি সাবলীল ছিল? যাদের ত্যাগ তিতিক্ষায় এবং জীবন বলিদানের বিনিময়ে সেদিনের সাড়ে সাতকোটি বাঙালী মুক্ত জমিনের মালিক হোল তার পরিচর্যা ও পুনর্গঠনে যারা সম্মুখ সারিতে ছিলেন তাদের প্রশাসনিক অজ্ঞতা ও ব্যর্থতা এবং পরবর্তী প্রশাসকদের ধারাবাহিক অপকর্মের জেরেই তো আজকের সমাজ কাঠামো দাঁড়িয়ে আছে। যারা আজ দাম্ভিকতা ও মাসলম্যান দাদাগিরির রাজনীতির ধারক হতে এগিয়ে আসছেন তারা তো ওই তাদেরই উত্তর পুরুষ যারা চেতনার ঝান্ডা উঁচিয়ে সদ্য স্বাধীন দেশে হেন অপকর্ম নাই যা করতে পিছপা হননি। এবং সেই তাদেরই উত্তর পুরুষরাই তো আজকের অমুক ভাই তমুক ভাই হয়ে চারিদিকে চেতনার বিকিকিনি করছে। তাছাড়া স্বাধীনতার চার বছরের মাথায় দেশের শিরোমনিকে যে কায়দায় নির্বংশ করে আয়ুবীয় শাসনের পুনর্জন্ম হোল তা ছিল বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে নৃসংশ ও লোমহর্ষক ঘটনা। এভাবেই পনেরটি বছর সামরিক মিশ্রিত সিভিল প্রশাসন আরব্য রজনীর ঘোর সৃষ্টি করে বাংলার বাঙালীত্বে নতুন মেরুকরন তৈরী করে। আর তার পরবর্তী সময়ে তথাকথিত গনতান্ত্রিক আচরনের বংশ পরপম্পরার গনতান্ত্রিক আচরনে পিষ্ট হয়ে এখন আমরা অর্থাৎ সাধারন বাঙালীরা এনামুল হক সাহেবদের মত গিনিপিগের আদলে পথে ঘাটে চড় থাপ্পড় সহ হাজারো হেনস্থার শিকার হচ্ছি।
কোন্ দিকে তাকাবেন! শুধু কি রাজনীতির নৈতিকতা, সহমর্মিতা, অসহিষ্ণুতা, পারস্পারিক শ্রদ্ধাবোধ এমনকি মানবিক মুল্যবোধের অবক্ষয়ের জেরেই এর বিস্তার ঘটেছে? তবে বিচার বিশ্লেষন করে দেখলে এই দায়ের সিংহভাগই কিন্তু রাজনীতির ঘাড়েই বর্তাবে। কারন দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে শুরু করে রাজনীতি ও প্রশাসনের সর্বস্তরে যখন এই মাসলম্যান দাদাগিরি ও চেতনার বিকিকিনি দেদারসে অভয়ারন্যের ওজিএল পায় তখন বাঙালীর শাশ্বত বাঙালীয়ানা ও তার সামাজিক আবাহন পথে ঘাটে গড়াগড়ি খায়। নইলে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হয়ে একজন জেলা আধিকারিক যখন সংবাদ সংগ্রহকারী সাংবাদিককে পিটিয়ে নিজ কর্মস্থলে বন্দি করে রাখেন কিংবা একজন উপজেলা আধিকারিক গ্রামের সাধারন কৃষককে প্রকাশ্যে মাঠেঘাটে কান ধরে উঠবস করায় তখন আর বুঝতে বেশী দেরী হয়না যে রাজনীতির বিষাক্ত হাওয়ায় তারাও যেন দোল খাচ্ছেন। শুধু কি তাই, নৈতিক অবক্ষয়ের ভারে জর্জরিত প্রশাসনের জেলা আধিকারিক যখন তার অফিস চেম্বারের পাশে ব্যক্তিগত খাস কামরা বানিয়ে সেখানে তার অফিস সহকর্মীর সাথে অনৈতিক কর্মে লিপ্ত থাকেন তখন আর বুঝতে বাকী থাকেনা দেশের অলিগলিতে আজ নৈতিক অবক্ষয়ের সুবাতাস বইছে।
এত যে হতাশার কথকতা, দৃশ্যমান নৃশংস ঘটনাপুঞ্জ দেখছি বা শুনছি তার সুত্র সরল পাঠেই পড়া যায়। ষাটের দশকের দেয়াল লিখনের সেই চল এখন উঠে গেছে। ভদ্রলোক বিল গেটস আর জ্যাকার বার্গের বদৌলতে আমরা এখন সামাজিক যোগাযোগের মহা মোক্ষম এক মিডিয়া পেয়েছি। প্রিয় 'গুগল খালা' এবং 'ইউ টিউব' প্রতি নিয়ত আমাদের সমাজের সুখ দুঃখের খবরগুলো বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে জানিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু প্রিয় বিবেক মশাইয়ের কি হবে! যে বিবেকের তাড়নায় সত্য কথাটি বলার জন্য একজন অধ্যাপককে থানার চৌদ্দ শিকের অন্দরে দাগি আসামীদের সঙ্গে রাত কাটাতে হয়(এটা অবশ্য মুক্তিযুদ্ধকালীন একাত্তরের একটি গ্রাম্য বিবাদের ঘটনা)। যার তাড়নায় পক্ষ নিতে গেলে হরহামেশাই জনপদে আতংক আশংকার ঘটনাগুলি ঘটে চলে। সত্যি কথা বলতে কি 'বিবেক' এখন ব্রেকিং নিউজ এর ফ্রেমে পড়ে ছটপট করছে। ওকে উদ্ধার করে সুস্থ্য করার সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। বিবেকের আয়নায় নিজেকে পরিশুদ্ধ করার দায়িত্ব আপনার আমার সকলের।