জালাল উদ্দিন আহমেদ
বাঙালীর বাংলাদেশ
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ২৭ ডিসেম্বর,মঙ্গলবার,২০২২ | আপডেট: ০৭:৫৮ এএম, ২২ ডিসেম্বর,রবিবার,২০২৪
আক্ষেপটা বহুদিনের। একটি জাতি যখন কোন উটকো ধর্মান্ধতার অজুহাত তৈরী করে তার বুনিয়াদের উৎসে আঘাত করে তখন স্বাভাবিক নিয়মে সেই জাতির বৃহত্তর আঙ্গিকের আঁতুড় ঘরে রক্তক্ষরন হয়। ধর্ম মানুষের আত্মশুদ্ধি বা আত্মিক বিকাশের ব্যক্তিগত সোপান। ধর্ম নিয়ে জাতি হয় না। যদি তাই হোত তাহলে চীন জাপান না হয়ে ওসব দেশের নাম হোত বৌদ্ধস্তান বা বুদ্ধভূমি। আরব দেশের সৌদি ইরাক ইরান ফিলিস্তিন লেবানন না হয়ে সেটা ইসলামী কোন নাম নিয়ে সামনে আসতো। সুতরাং ধর্মের হীনমন্যতায় জাতি বা রাষ্ট্র গঠনে এগিয়ে যাওয়ার নজির খুব আছে বলে মনে না। যদি কেউ ধৃষ্টতা দেখিয়ে থাকে তবে সেটার ফল যে ভাল হয়না তা চোখে আঙ্গুল দিয়েই দেখানো যায়। হিন্দুস্তান তাহলে কিভাবে এল। হিন্দুস্তান বলে কোন দেশ আদৌ আছে কি? তাহলে এই চলনটা এল কোত্থেকে! এটা কি ধর্ম নিয়ে হয়েছে? অনেকেই চমকে উঠবেন। তাইতো! আগে তো খেয়াল করিনি। আসলেই তাই। হিন্দুস্তানের নামটি ধর্ম নিয়ে হয়নি। আর হিন্দু কোন ধর্ম কি না সেতো এক সমুদ্র জিগ্যাসা। তাছাড়া হিন্দুস্তান বলে কোন রাষ্ট্র আছে কিনা সেটাও তো অজুত জিগ্যাসার একটি। কারন ভারত বলে একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র আছে - এটা সর্বজনবিদিত। আবার সিন্ধু যার উচ্চারনের ফেরে ইন্ডাস থেকে এসেছে ইন্ডিয়া। এটাও সহি। তবে হিন্দুস্তান সহি বা সঠিক বলে রায় দেয়ার সুযোগ খুব কম। উৎপত্তির ডামাডোলে পড়ে এসব অসম নামগুলি সামনে এসেছে বা আসতে চায়। আর ভারত বা সেই শৌর্যবীর্যের ভারতবর্ষ রাষ্ট্রের পেট চিরেই তো এসব ধর্মীয় লেবাসের নাম উচ্চারিত হয়েছে। ক্ষেত্রবিশেষে বাস্তবায়িত হয়েছে। একই জলবায়ুর ভূখন্ড বেষ্টিত আদিবাসীয় আবাহনের সুর অধিবাসীদের একসুতোয় বেঁধে তার জাতিগত ঔজ্জ্বল্যতাকে আপন শিকড়ে একাট্টা করে। আবার ধর্মান্ধতার কলুষতা নিয়ে নিজের ঘর ভাঙ্গা মানুষেরা যখন আপন জাতীয়তার অস্তিত্ত্বে উজ্জ্বল হতে চায় তখন তাদের পুর্ব পুরুষ সৃষ্ট ধর্মভেদের রাষ্ট্র গঠনের সেই বিষবায়ু তাড়া করে ফিরে। ফলে জাতীয়তার একাত্মতা সৃষ্টিকারী আকাঙ্ক্ষা তখন ফিকে পানসে হয়ে যায়।
বাঙালীর ক্ষেত্রেই এটা ঘটেছে বেশী করে। আপন ধর্মের সাম্প্রদায়িক আচরনকে বৃহত্তর আঙ্গিকের হীনমন্যতায় ফেলে বাঙালী জাতির একটি গোষ্ঠী এখন রীতিমত খাবি খাচ্ছে। বাঙালী নিজের ঘর নিজেই ভেঙ্গেছে। অথচ ভারতবর্ষের প্রেক্ষিতে বাংলা ছিল একটা গর্ব করার জায়গায়। বৃটিশরা এটা বুঝেছিল বলেই হয়তো একটা আলাদা অথচ স্পেশাল কেয়ার নিয়েই তারা বাংলা শাসন করেছিল। একসময় পুর্ব বাংলার অবহেলিত জনপদের ভাগ্য উন্নয়নের লক্ষ্যে তারা বঙ্গ ভংগ করে তার উত্তরন ঘটাতে চেয়েছিল। কিন্তু কোলকাতা কেন্দ্রিক ধর্মান্ধতার ব্রাহ্মন্য জমিদারী এবং ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজা ও ভুঁইয়াদের পাশা খেলার চালে তা ভেস্তে যায়। এমনকি সাম্প্রদায়িক আগ্নেয়গিরির ভিস্যুভিয়াসে দাঁড়িয়ে সাতচল্লিশের দেশ ভাগের সময় তারা যখন দেখলো তাদের আম-ছালা দুটোরই সর্বনাশ হতে চলেছে, তখন তারা শুধুমাত্র ক্ষমতার হিসাব কষতে গিয়ে ছালাটা নিয়েই কোলকাতা কেন্দ্রিক হলো। বাংলার মেরুদন্ডে আঘাত হেনে রাইটার্সের মালিক হতে যাওয়া ঐ ব্রাহ্মন্য সাম্প্রদায়িক মানুষগুলো সে সময় বাঙালীর জাতিগত সমগ্রতার কথা একবারও ভাবেনি। সময়টা বোধ হয় এমনই ছিল। ঊনিশ শতকের একপেশে সংস্কৃত মাখা শিল্প সংস্কৃতির বিকাশে ব্রাহ্মন্য শাসক* ও পন্ডিতেরা হয়তো ভেবেছিলেন কোলকাতা মানেই তো বাংলা, মুর্শিদাবাদ মানেই তো অবশিষ্টের আকর্ষন। ফলে জাতিগত অহংকারের সলতেই আগুন জ্বালিয়ে তারা বাংলার দুধের হাঁড়ি থেকে সরটুকু তুলতে চেয়ে বড় ভুল করে ফেললেন। ফল হলো উল্টো। হিন্দুস্তানীয় বৃহত্তর সাম্প্রদায়িক থাবার নীচে পড়ে এখন তাদের খাবি খাওয়া ছাড়া আর কিইবা করার আছে! (*শাসক বলা হলো এই কারনে যে, সময় এবং স্রোত তখন ঐসকল ব্রাহ্মন্য জমিদারীর অনুকূলে ছিল। তাছাড়া মুসলমানদের পরাজিত করেই বৃটিশরা ভারতের শাসন দন্ড হাতে নিয়েছিল। সিপাহি বিদ্রোহে মুসলমানরা সামনের সারিতে থাকার ফলে ইংরেজরা এমনিতেই মুসলিম বিদ্বেষী হয়ে উঠে। ফলে হিন্দুত্ববাদী নেতা ও বিজ্ঞজনেরা ইংরেজদের কাছের মানুষ হওয়ার সুযোগটা ভালভাবেই কাজে লাগিয়ে শাসকের মতই বিচরন করেছে সে সময়)।
বৃহত্তর বাংলার কথা চিন্তা করলে যে চিত্রটি পাওয়া যায় তার সার সংক্ষেপ বড়ই সুষম ছিল। কিন্তু ধর্মভেদের জটিলতায় ফেলে বাংলার সগ্রতার যে অঙ্গ হানি করা হোল তা পুর্ব পশ্চিমের দুই বাংলাকে পরাশ্রয়ী এক ভঙ্গুর সীমানায়** আবদ্ধ করলো। হয়তো পশ্চিমের বাংলা তার কোলকাতাময় উষ্ণতায় আপতকালীন এক তৃপ্তির ঢেকুর তোলার উপলক্ষ্য পেয়েছিল। কিন্তু পুবের বাংলা এক 'পাক সারজমিন' আর উটকো ধর্মীয় শংকর জাতিস্বত্ত্বা ছাড়া অন্য কিছু পেয়েছে কিনা জানা নেই। ধর্মকে সামনে রেখে ভারত ভাগের বদান্যতায় বাংলাও খন্ডিত হোল। তবে যে খোঁড়া যুক্তি সামনে এনে বাংলাকে দ্বিখন্ডিত করা হয়েছিল তা এতদাঞ্চলের সিংহভাগ মানুষের অপছন্দনীয় ছিল। একই ভাষা, একই গোত্র, একই মাটি ও আবহাওয়ার সহোদর ভাই কিভাবে দুটি আলাদা রাষ্ট্রে অঙ্গীভূত হয়ে নতুন জাতীয়তার পরিচয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়, তা ভাবলেই মনটা বিমর্ষ হয়ে যায়। অখন্ড বাংলার বাঙালীকে ধর্মভেদের খোড়া যুক্তিতে পুর্ব ও পশ্চিমে ভাগ করা হোল। পুবের মুসলিম সংখ্যা গরিষ্ঠের বাঙালী পাকিস্তানী জাতীয়তায় শেকলবদ্ধ হল। আর পশ্চিমের হিন্দু গরিষ্ঠের বাঙালী ভারতীয় জাতীয়তায় থিতু হল। কিন্তু সামগ্রিকতার নাড়ির টানে তৎসময়ে ধর্মভেদের সিংহভাগ হিন্দু-মুসলমানের যে রক্তক্ষরন হয়েছিল তা কি ইতিহাসে লেখা থাকবে? (** ভঙ্গুর সীমানা = ভারত পাকিস্তান সীমারেখা টেনে আলাদা রাষ্ট্র হলেও জাতিগত বিভাজনের রেশে দুই দেশের সীমান্তরেখাটি বরাবরই বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরোর মতই অবস্থান করেছে। ফলে ধর্মভেদের জাতি পুনর্গঠনে বাঙালীর সীমান্ত পারাপারের কার্যক্রম নীরবেই সংঘটিত হয়েছে)।
বাঙালী বীরের জাতি। পুর্ব বাংলা ধর্মের আচার বিচারের গরিষ্ঠতায় পাকিস্তান নাম নিয়ে তার পথ চলা শুরু করেছিল। তবে তারা বরাবরই স্বাধীনচেতা বাঙালীয়ানায় উজ্জ্বল ছিল। আগেই বলেছি কাদা মাটি নদী নালার পলি বিধৌত পুর্ব বাংলা, বাঙালীয়ানার অস্মিতায় একটা নিজস্ব ঘরানার উঠান তৈরী করেছিল। তবে এই উঠান এমনি এমনি তৈরী হয়নি। পুর্ব বাংলা কাদামাটির কৃষিনির্ভর একটি ভূখন্ড। শহর বন্দর হয়তো ছিল কিন্তু নগরায়নের কোন উদ্যোগ বা সুযোগ এতদাঞ্চলে ছিলনা বললেই চলে। বার ভুঁইয়ার দেশ ছিল বটে কিন্তু কোলকাতা কেন্দ্রিকতায় জর্জরিত এই বাংলা ভূখন্ড তাদের বেসিক বুনিয়াদ বিনির্মানে কখনোই মাথা তুলে দাঁড়াতে শিখেনি বা তাদেরকে সে পথে মাড়াতে হাজারো বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে। হিন্দু ধর্মের নামে ব্রাহ্মন্য আধিপত্যে বাঙালী আদিবাসীরা মূলতঃ বিভিন্ন বর্ন গোত্রের সমন্বয়ে এতদাঞ্চলে সংখ্যা গরিষ্ঠ জনপদ হিসাবেই বিবেচিত ছিল। কিন্তু ব্রাহ্মন্য বর্ন বৈষম্য ও একই ধর্মের মধ্যে জাত পাতের হাজারো বিধি নিষেধে তারা অতিষ্ঠ এবং জর্জরিত হয়ে উঠেছিল। ঠিক সেই সময়গুলিতে মধ্য এশীয় ও আরব দেশের মুসলমান ধর্ম প্রচারকদের আগমন ঘটে। ইসলামের সাম্যের বাণী এবং সামাজিক সুষম বন্টন ব্যবস্থা ও ভেদাভেদহীন আচার অনুষ্ঠানের ইসলামী দাওয়াতে এখানকার বর্ন বৈষম্যের শিকার মানুষগুলো আকৃষ্ট হয়। ফলে পুর্ব বাংলার বাঙালী দলে দলে ইসলামের পতাকাতলে সমবেত হওয়া শুরু করে। এভাবেই আস্তেধীরে গোটা পুর্ব বাংলা মুসলিম সংখ্যগরিষ্ঠ জনপদে রূপান্তরিত হয়। ইসলামের সংস্পর্শে এসে তারা ধর্ম গুরুদের সাহচর্যে নৈতিক শিক্ষায় আপন উঠানে বেড়ে উঠেছে। ওইসব ভিন ভাষীয় ধর্ম প্রচারকদের সংস্পর্শে এসে তারা মানবিক মুল্যবোধ ও আপন অস্তিত্ত্বের শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছে। তারা আপন অস্তিত্ত্বে বাঙলার প্রকৃত বাঙালী হওয়ার অহংকারে তৃপ্ত থাকার শিক্ষা পেয়েছে। ইসলামী শিক্ষার নৈতিকতা এবং সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সুষম বন্টন ব্যবস্থার শিক্ষার আলোকে তারা আপন অস্তিত্ত্বের দীক্ষায় সব সময় সচেতন থেকেছে। ফলে সময়ের চাহিদায় বাঙালী তার আপন উঠান তৈরীতে যত্নবান হয়েছে। বাঙালী জাতীয়তাবোধে নিজেদের পরিচয় পুনরুদ্ধারের স্বপ্নে বিভোর হয়েছে।
ধর্মের ভিত্তিতে গঠিত অসম জাতি গঠনের মোহে রনভঙ্গ দিয়ে পুবের বাঙালী অর্থাৎ মুসলিম গরিষ্ঠের পুর্ব পাকিস্তানের বাঙালী, জাতিধর্ম নির্বিশেষে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে নিজের আপন ঠিকানার পত্তন ঘটিয়েছে। বাঙালী তার স্বপ্নের বাংলাদেশ ছিনিয়ে এনেছে। পৃথিবীর বুকে লাল সবুজের পতাকায় বাঙালী তার আপন ভূখন্ড স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের গর্বিত বাঙালী হয়েছে। ধর্মীয় জাতিস্বত্ত্বার শিকল ছিঁড়ে তারা ভূখন্ডে বসবাসকারী জাতি ধর্ম নির্বিশেষে বাংলাদেশী জাতীয়তাবোধে উচ্চকিত হয়েছে। আজ পৃথিবীর বুকে স্বাধীন সার্বভৌম লাল সবুজের বাংলা বাঙালীর গর্ব হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। তাইতো আমরা সমস্বরে বলতে পারি আমার দেশ বাংলাদেশ। বাঙালীর বাংলাদেশ।