জালাল উদ্দিন আহমেদ
অবহেলিত মানব সম্পদ
প্রকাশ: ১২:০০ এএম, ২৯ নভেম্বর,মঙ্গলবার,২০২২ | আপডেট: ০২:০৬ এএম, ২২ ডিসেম্বর,রবিবার,২০২৪
১
বাঙালী জাতি তার আপন অস্তিত্বে সব সময় সজাগ থেকেছে। কিন্তু ভূ-ভৌগলিক জটিলতায় আপন অস্তিত্বের ঠিকানা খুঁজে পায়নি। সঠিক শিক্ষা ও নেতৃত্বের শুন্যতায় বার বার হোঁচট খেয়েছে। হাজার বছরের ফালনামা ও তার ঘাত প্রতিঘাতের সন্ধিক্ষনে অবশেষে বাঙালীর নেতৃত্বে ধুমকেতুর আগমন ঘটেছে। সেই তেজস্বীয়তায় বাঙালী অবশেষে তার আপন ঠিকানা খুঁজে পেয়েছে। খুঁজে পেয়েছে বলাটা এখানে প্রযোজ্য হবে কিনা জানিনা। তবে বাঙালী তার আপন ঠিকানা তৈরী করে নিয়েছে বলাটাই শ্রেয়তর এবং যুক্তিযুক্ত বলে আমি মনে করি। হিন্দু মুসলিম ব্যবচ্ছেদ ঘটিয়েও বাঙালীকে দমিয়ে রাখা যায় নি। সর্ব ভারতীয় উঠানে বাঙালীর তেজস্বীয়তা উপমহাদেশে জেঁকে বসা জালিম শাসকেরা দেখেছে। বহিরাগত শাসক ও শোষকেরা দেখেছে বাঙালীর বুদ্ধিমত্তা ও নেতৃত্ত্বের স্ফুরন। ভারত আন্দোলনের নেতৃত্ত্বে বাঙালী কি করতে পারে তা এক বাঙালী মহাপুরুষ নেতাজীই দেখিয়ে গেছেন। অবশেষে বিজাতীয় শাসন শোষনের নাগপাশ থেকে কিভাবে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে নিজের আঙ্গিনা তৈরী করতে হয় তা দেখিয়েছেন আরেক বাঙালী মহামানব, বাঙালীর মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান।
একটি দেশ ও জাতি যখন আপন অস্মিতায় উচ্চকিত হতে চায় তখন অভ্যন্তরীন সম্পদের সুষম বন্টন বা শ্রেনীবিন্যাসে মনোযোগী হতে হয় সর্বাগ্রে। অর্ধ শতাব্দী আগে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে জয়ী হয়ে বাংলাদেশ তার ইস্পিত স্বাধীনতা অর্জনে সক্ষম হয়েছিল। যুদ্ধ বিদ্ধস্ত এক প্রতিকুল পরিবেশে বাঙালী তার আপন অস্তিত্ত্বের উঠানে যখন দেশ গঠনে ব্রতী হোল তখন চারিদিকে শুন্য হাহাকার ছাড়া কিছুই অবশিষ্ট ছিল না। আপন ঘরানায় দেশ গড়ার উদগ্র মনোবাসনা নিয়ে মহান নেতা যখন এক দেশ এক জাতি গড়ার কর্মযজ্ঞে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়লেন ঠিক তখনই বাঙালী চেতনার বিপরীত এক বিষাক্ত স্রোত সব লন্ডভন্ড করে দিল। তবুও ভাগ্য ভাল যে মাস তিনেকের ভিতর বাঙালী তার আপন স্রোতের মহান মুক্তিযোদ্ধাকে সামনে পেল। তবে পঁচাত্তর পরবর্তী দু'টি বছরে সামরিক আবহের বাংলাদেশ ততদিনে একাত্তরের চেতনার যতটুকু সর্বনাশ করার দরকার তার সিংহভাগই করে দিয়েছিল। সামরিক খোলস ছেড়ে স্বাধীনতা ঘোষনা পাঠের মহান সিপাহসালার রাজনীতির উঠানে এলেও একাত্তর পুর্ববর্তী তেইশ বছরের স্বাদে গন্ধে স্বাধীন বাংলার রাজনীতি ও শাসন কাঠামোর পুনর্জন্ম হয়। অর্থাৎ পঁচাত্তর পরবর্তী পনেরটি বছর বাংলাদেশ নিজস্ব অস্তিত্ত্বে থাকলেও এক মিশ্র আবহের সামরিক-আধা সামরিক ও মিশেল গনতন্ত্রের ডামাডোলে দেশ পরিচালিত হয়। নব্বইয়ের গন-অভ্যুত্থানের পর দেশে গনতন্ত্রের পুনর্জন্ম হয়েছিল বটে তবে তা পিতা ও ঘোষকের পারিবারিক বলয়ের গোলক ধাঁধায় প'ড়ে দেশে বংশ পরম্পরার এক যুযুধান গনতন্ত্রের পাকাপোক্ত বন্দোবস্ত করে দেয়। সেই যে শুরু তার লালন পালন ও পরিচর্যায় এখনকার দিনে তা এক মহীরুহে রূপ নিয়েছে। গনতন্ত্রের ভিত এখন রাজদন্ডের আদলে দুটি মাথার শক্ত পিলারে এই অর্ধ শতাব্দীর বাংলাদেশে রাজ করছে। আর রাজনীতিবিদ নামক কিছু পরজীবি মানুষ নিজেদের মোসাহেবী আচরনে দেশের সরলমনা বাঙালীর কাঁধে মধ্যযুগীয় আচরনের উজির, নাজির, দেওয়ান, পাইক, পেয়াদা ও মোসাহেবের আসনে নিজেদেরকে পুষ্ট করছেন। প্রসঙ্গের জনসম্পদকে ব্যাখ্যায় আনতে গেলে এতটুকু পট ভূমিকা সামনে আনতেই হয়। নইলে রাজপথের শাখা প্রশাখায় সৃষ্ট চোরাগলিগুলো খুঁজে পেতে কষ্টকর হবে বৈকি!
আমরা একাত্তরের কথা বলি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে আস্ফালন করি। বঙ্গবন্ধুর জনবান্ধব রাজনীতি ও তাঁর নেতৃত্ত্ব নিয়ে হাজারো অহমিকা ও অহংকারে আমাদের মাটিতে পা পড়ে না। নিজেদেরকে বঙ্গবন্ধুর সৈনিক জাহির করে আমরা খাঁটি বাঙালীত্বের পাঞ্জাবী-পাজামা ও হাতা কাটা কাল কোট পরে স্টেজে জায়গা দখল করার চেষ্টা করি। কিন্তু আমরা আজকের আঙ্গিকে কোন্ প্যারা মিটারে ঐ মহা মানবের পায়ের নীচে বসার যোগ্যতা রাখি, তার হিসাব কে রাখে? আমরা মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডারদের কথা বলে তাদেরকে নিয়ে গর্ব করি( জানিনা এই আবহ এখন আছে কিনা?)। বঙ্গবন্ধুর বিশ্বস্ত সৈনিক ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেই অকুতোভয় সিপাহশালার মেজর জিয়াকে নিয়ে আমাদের উচ্ছ্বাসের শেষ নেই(যদিও রাজনীতির দূরাচারী আচরনে তা এখন বিষাক্ত গালি গালাজে রূপান্তরিত হয়েছে)। কিন্তু সেই উচ্ছ্বাস ও আবেগের ধারকদের নিয়ে আমাদের অর্জনের খাতাটি কতটুকু সমৃদ্ধ করেছি? দেশে রাজনীতি বা গনতন্ত্র এখন একপেশে ব্যক্তি পুজার আচরনে থিতু হয়েছে কি না - সে হিসাব কেউ কি করেছেন! দেশে এখন ব্যক্তি পছন্দের অযোগ্য মোসাহেবী কালচারের গনতন্ত্র মহা সমারোহে বিকশিত হচ্ছে বলেই মনে হয়। এ হিসাব পঞ্চাশ বছরের। স্বাধীনতা লাভের পঞ্চাশটি বছর এই ঝাড়া-বাছাইয়ের ঘুর্নিপাকে আমাদের অধিকাংশ সময় পার করেছি আমরা। সুতরাং দেশ গড়ার আর্থ-সামাজিক পটভূমির কোন্ গলিপথের মেরামতে আমরা কতটুকু সময় দিয়েছি তার ঠিকুজি দেখলেই সব পরিস্কার হয়ে যায়।
যাহোক যুদ্ধ বিদ্ধস্ত সদ্য স্বাধীন দেশ পুনর্গঠনে তৎসময়ের ক্ষমতাপ্রাপ্ত শাসকেরা খুব বেশী সময় না পেলেও লজিষ্টিক সাপোর্টের অপ্রতুলতায় তারা কোনঠাসা অবস্থায় পড়েছিলেন - এটা অনুমান করেই বলা যায়। মানুষের মুখে ভাত তুলে দেয়াটাই ছিল তখনকার সরকারের মুখ্য দায়িত্ব। আবার সামরিক কাঠামোর বছরগুলিতে মেরুকরনের রাজনীতির মচ্ছবে দেশ ও জাতির বুনিয়াদ বিনির্মানে খুব বেশী কাজ হয়েছে বলে মনে হয়নি। পরবর্তীতে গনতন্ত্রের উত্তরাধিকারীয় পরম্পরার এখনকার দিনে পিতা ও ঘোষকের প্রতিষ্ঠা লাভের ডামাডোলে দেশ এক অনিশ্চিত গন্তব্যে এগিয়ে চলেছে। সে ক্ষেত্রে মানব সম্পদ উন্নয়নের ন্যুনতম অনুশীলন দেশে হয়েছে কিনা তা বর্তমানের বাস্তবতাই বলে দেয়। যে জাতির উত্থান ঘটেছিল ভাষা ও শিক্ষা ব্যবস্থার অনিয়মের বিরুদ্ধে, সেই জাতি তার স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরেও একটি সুষম শিক্ষানীতি দেশের জনগনের জন্য উপহার দিতে পারেনি। যদিও প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ ও বিজ্ঞানীর নেতৃত্ত্বে বাংলাদেশে একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করা হয় এবং সেই সম্মানিত শিক্ষাবিদ তার জীবদ্দশায় দেশে একটি সুষম শিক্ষানীতির সুপারিশও করে গেছেন। কিন্তু দুর্ভাগা বাঙালী সেই মনীষীর সুপারিশের শিক্ষানীতি বাস্তবায়নে কোন পদক্ষেপ নিতে পেরেছেন কিনা তা আমাদের জানা নেই। শিক্ষার বুনিয়াদী কাঠামোটাই এখনও পর্যন্ত আমরা স্বাধীন স্বত্ত্বায় দাঁড় করাতে পারিনি। ফলে আমাদের বাপ-দাদাদের চিন্তা চেতনার সেই প্রাক আধুনিক যুগেই আমরা খবি খাচ্ছি। বৃটিশদের গড়ে দেয়া সেই শিক্ষাচক্রেই আমাদের গতানুগতিক যাত্রা।
বাঙালীর আপন স্বত্ত্বা তৈরী হওয়ার সুচনালগ্নে আমাদের সার্বিক সূচকে কিছুটা ঘাটতি ছিল তা মানতেই হয়। কেননা বৃটিশ বিতাড়নের পর ধর্মস্বত্ত্বা নিয়ে সৃষ্ট স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তানের প্রশাসন, অর্থ, শৃংখলা ও আইন কানুনের সার্বিক ব্যবস্থাপনার দন্ডটি ধরা ছিল পশ্চিমা ভিন ভাষীয় শাসকদের হাতে। ফলে বৃহত্তর পাকিস্তান রাষ্ট্রের পরিচালনা পর্বে বাঙালী সেক্ষেত্রে প্রজা হিসাবেই পাকিস্তানী হয়ে বিচরন করেছে। ফলে দেশ পরিচালনার সার্বিক সূচকে বাঙালীর অংশগ্রহন ন্যুনতম পর্যায়ে ছিল। সেক্ষেত্রে স্বাধীনতার পর এই প্রশাসনিক শুন্যতার বিষয়টি অস্বীকার করার উপায় ছিল না। দেখা যায় বাংলাদেশের উত্থান পর্বে অনেক বড় বড় যুগান্তকারী রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। কিন্তু প্রশাসনিক ও আইন প্রয়োগকারী অনেক ক্ষেত্রেই দুর্বলতার মাসুল দিয়ে সেসব জনকল্যানমুখী সিদ্ধান্তে ভাল ফল আসেনি। লক্ষ্য করা যায় সদ্য স্বাধীন দেশের বিভিন্ন কারিগরি ও পেশাজীবি ক্ষেত্রে নিজেদেরকে অংশীদার করার জন্য উন্নত বিশ্বে কার্মরত বিভিন্ন পেশাজীবি মানুষ বাংলাদেশে এসে কাজ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু প্রাশাসনিক অদক্ষতা ও যোগানের অপ্রতুলতা হেতু তারা আবার তাদের কর্মস্থলের পরদেশে ফিরে যান। কারন তারা যে সুযোগ সুবিধা ও স্বাধীনতা নিয়ে বিদেশে তাদের মেধার বিকাশ ঘটাচ্ছেন তার ন্যুনতম সম্মানীটুকু পেলেও তারা মাতৃভূমির জন্য বিসর্জন দিতে প্রস্তুত ছিলেন। কিন্তু সুর্যোদয়ের সেসময়ের বাংলাদেশ তা সংকুলান করতে পারেনি। ফলে মেধার সুর্য সন্তানেরা বাংলা বিনির্মানে তাদের শ্রমকে কাজে লাগাতে পারেন নি। পরবর্তী সময়েও দেখা গেছে মেধার পরিচর্যা কিংবা সেসবের লালন পালনে কোন ভ্রুক্ষেপ না করে শাসক শ্রেনী নিজেদের ক্ষমতা ও চেয়ারকে পোক্ত করার ফন্দি ফিকিরেই দেশ শাসন করে গেছেন।
(ক্রমশঃ………)